উত্তম কুমারের শিল্পীসত্তা , অনবদ্য হাসি , চরিত্র স্রষ্টা , অভিনয় দক্ষতা , অধ্যবসায় নিয়ে কথা বলেছেন নানা গুনীজনেরা। ইতিহাসের সেইসব পাতা থেকে মণিমুক্তো ছড়ানো কথাগুলি লিপিবদ্ধ করেছেন শ্রীজীব
মৃত্যুর ৪০ বছর পরও আজও বাঙালি মননে স্বমহিমায় বিরাজমান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আবর্তিত হয়ে চলেছে স্বপ্ন, প্রেম, বিরহ আর বিচ্ছেদের বারোমাস্য। এখনও আধুনিক প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষায় ধরায় উত্তম-সেক্স -আ্যপিল। ধরায় নেশা। সপ্তপদী, দুই পৃথিবী , ঝিন্দের বন্দি , ছিন্নপত্র, নায়ক , জতুগৃহ, আনন্দ আশ্রম , জীবন তৃষ্ণা , অমানুষের মতো ছবি আজও বাঙালির মনে গেঁথে আছে। উত্তম কুমারের শিল্পীসত্তা , অনবদ্য হাসি , চরিত্র স্রষ্টা , অভিনয় দক্ষতা , অধ্যবসায় নিয়ে কথা বলেছেন নানা গুনীজনেরা। উঠে এসেছে উত্তম প্রসঙ্গ। ইতিহাসের সেইসব পাতা থেকে মণিমুক্তো ছড়ানো কথাগুলি লিপিবদ্ধ করেছেন শ্রীজীব
আশাপূর্ণা দেবী :
উত্তম! বিস্ময়কর প্রতিভার স্বর্ণ স্বাক্ষরে সমৃদ্ধ , অফুরন্ত সম্ভাবনার অঙ্গীকারে দীপ্তিমান অনন্যসাধারণ শিল্পী উত্তমকুমার। উত্তমকুমারের শিল্পীসত্তাটি কখনও কোনও ক্ষেত্রেই ম্লান নয় , নয় নিষ্প্রভও । উত্তমকুমারের শিল্পচেতনা উত্তরোত্তর উন্নতির সোপান ধরে উঠেছে উঁচু থেকে উঁচুতে। বাইরের ঝড়ঝঞ্জা, ঘাত -প্রতিঘাত, লাভ- লোকসান সেই গতিকে কখনও ব্যাহত করে না। ঈশ্বর তাঁকে উত্তম স্বাস্থ্য দিন , উত্তম শক্তি দিন , উত্তম আয়ু দিন। আর অটুট অক্ষুন্ন রাখুন তাঁর মুখের সেই অনবদ্য হাসিটুকু।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় :
আমার একটি নয় বহু কাহিনিচিত্রের তিনি নায়ক এবং প্রাণ। তখন ১৯৫৭ সাল। টালিগঞ্জ স্টুডিয়োতে ‘জীবন তৃষ্ণা ‘ ছবির শুটিং চলছে। আমাকে একদিন বললেন , একদিন এসে দেখুন না কেমন লাগে। গেছি। তাঁর শুটিং চলছে। সুন্দর অভিনয় করলেন। সকলে বাঃ বাঃ করে উঠলেন। আমারও ভালোই লেগেছে , কিন্তু কোথায় যেন একটু অস্বস্তিও। উত্তমকুমার জিজ্ঞসা করলেন , কেমন হল ? বললাম ভালোই তো। মাত্র দু – তিনটে মুহূর্ত উত্তমবাবু মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। কি ভাবলেন একটু। তারপরই সেটে ফিরে গিয়ে বললেন, সিনটা আবার নেওয়া হোক – পরিচালক, ক্যামেরাম্যান , শব্দযন্ত্রী সকলেই আবার তৎপর। এবারের অভিনয়ে হাবভাব আর আচরণ আরও একটু শিথিল ও নিস্পৃহ করলেন তিনি। আমার মনে হল নিজেরও অগোচরে ওই চিত্রটি এবার শতকরা সবটাই সজীব হয়ে উঠল বুঝি। মনে হয় এই সূক্ষ্ম বোধশক্তিই তাঁকলে নায়কত্বের এমন অনন্য মর্যাদা দিয়েছে। চব্বিশ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে হৃদ্যতা ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তিনি নিজে আমাকে দাদার সম্মান দিয়েছেন। আমি ছোট ভায়ের।
বিমল মিত্র :
শ্রী উত্তমকুমার শুধু অভিনেতা নন , আমি তাঁকে চরিত্রস্রষ্টা বলেও মনে করি। চরিত্রস্রষ্টা বলেও মনে করি। চরিত্রস্রষ্টা উত্তমকুমারের তাই এত জনপ্রিয়তা। যে অনুভূতি আর যন্ত্রণাবোধ থাকলে শিল্পী অপরের চরিত্র নতুন করে সৃষ্টি করতে পারেন তা তাঁর নিশ্চয়ই আছে। আমরা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অন্দরমহলের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। এখন শ্রীমান গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষের অনুলেখন থেকে বুঝলাম উত্তমকুমারের এই বিস্ময়কর প্রতিভার মূল রহস্য কোথায়। উত্তমকুমারের চরিত্রের এই রহস্যলোকের সন্ধান দিতে পেরেছেন বলে শ্রীমান গৌরাঙ্গকে ধন্যবাদ। তাঁর রচনাভঙ্গি শুধু সুন্দর নয় , সাবলীল আর রসমাধুর।
সত্যজিৎ রায় :
উত্তমকুমার কোনও পরিচালকের ব্যক্তিগত সার্টিফিকেটের অপেক্ষা রাখেন না। তিনি যে বিশ বছর ধরে একশোর বেশি ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান অধিকার করে আছেন এটাই তাঁর কৃতিত্বের সবচেয়ে বড় প্রমান। এ জিনিস যে কেবল বরাতজোরে হয় না , এ বিশ্বাস আমার আগেই ছিল। আমি আশা করি তিনি আজ যে জায়গা দখল করে আছেন , সেখানে ঠিক এভাবেই আরও বহুদিন থাকবেন। ওঁর মতো ষ্টার আর হবে না। বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের দিকপাল। ওঁর সঙ্গে আমি কাজ করেছি। আশ্চর্য অভিনয় দক্ষতা। উত্তমের মতো কোনও নায়ক নেই, কেউ হবে না। উত্তমের দর্শকদের টেনে রাখার ক্ষমতা আছে। অনেক নায়ক আছেন , তাঁদের মধ্যেঅনেকেই ভালো অভিনয় করেন, কিন্তু উত্তমের মতো কেউ নেই , কেউ হবে না।