আর্থিক দৈন্যতা আর অসুস্থতার জন্য শরীর না চাইলেও এখনও ছুটে চলেছেন আরও একটা বাবলুকে সুব্রত ভট্টাচার্য বানানোর লক্ষ্যে
ভারতীয় ফুটবলের মক্কা বলে পরিচিত কলকাতায় এখন নামী দলগুলোতে বাঙালি ফুটবলার খুঁজতে গেলে বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী দূরবীনও ফেল মেরে যাবে। তারকা বাঙালি ফুটবলার আর পাঞ্জাবি ট্রাম চালক কথাটা ক্রমশ যেন সমার্থক হয়ে উঠছে। কিন্তু এই বাংলাই একদিন দেশকে দিয়েছিল একের পর এক তারকা ফুটবলার। আসলে বাংলায় এখনও প্রতিভার অভাব নেই। অভাব রয়েছে মুরারি শূরের মতো প্রশিক্ষকদের। শ্যামনগরের রোগা-পটকা বাবলুর সুব্রত ভট্টাচার্য হয়ে ওঠার কারিগরকে আজ আর কে মনে রেখেছেন? অবশ্য শুধু ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার সুব্রত নন, মুরারি শূরের কাছে পায়ে-বলে সম্পর্কের হাতেখড়ি পর্ব সম্পন্ন হওয়ার পরই কলকাতা ময়দান কাঁপানোর পাশাপাশি জাতীয় দলেও অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন প্রশান্ত মিত্র, দুলাল বিশ্বাস, রহিম নবিরা। অবশ্য শুধু এই কয়েকটি নাম লিখলেই মুরারি শূরের অবদান শেষ হবে না। তাঁর হাতে তৈরি প্রচুর ফুটবলার ময়দানের বিভিন্ন ক্লাবে দাপটের সঙ্গে বছরের পর বছর খেলে গিয়েছেন। কিন্তু ভারতের মতো ক্রিকেট সর্বস্ব দেশে শচীন তেন্ডুলকরের কোচ হিসাবে রমাকান্ত আচরেকর যে প্রচার পেয়েছেন ভারতীয় ফুটবলে একের পর এক প্রতিভার জোগান দিয়েও তার এক অংশও জোটেনি শ্যামনগরের এই মানুষটির জীবনে।
ফুটবল কেরিয়ারে ছিলেন গোলরক্ষক। কিন্তু কোচ হিসাবে তৈরি করেছেন নানা পজিশনের ফুটবলার, যাঁরা গোটা দেশ জুড়ে দাপিয়ে খেলে বেড়িয়েছেন বছরের পর বছর জুড়ে। নিজে ময়দানের রাজনীতির শিকার হয়ে প্রতিভা থাকা সত্বেও নাম করতে পারেননি। জীবনের এই আক্ষেপ মুরারি শূর মিটিয়েছেন ছাত্রদের সাফল্য দেখে।
শ্যামনগর স্টেশনে নেমে টোটো চালককে মুরারি শূরের নাম বলতেই তিনি বললেন. আপনি কি সাংবাদিক? ঘাড় নাড়াতেই কপালে জোড়া হাত ঠেকিয়ে বললেন, ‘নমস্য মানুষ। জানেন আমিও একদিন মুরারি স্যারের ছাত্র ছিলাম। ময়দানে প্রথম ডিভিশন খেলেছি। এই এলাকার কতো ছেলেকে যে স্যার ফুটবল শিখিয়েছেন গুণে শেষ করা যাবে না।’ স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে ঠিকানা বলতে হয়নি। দশ মিনিটের পথ শেষে টোটো থামল মুরারিবাবুর বাড়ির সামনে, টোটো চালক যাত্রা পথের পুরো সময়টাই তাঁর এক সময়কার কোচের কথা বলে গেলেন। সটান বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে নিজের প্রাক্তন কোচের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আমকে বসিয়ে দিয়ে তারপর বিদায় নিলেন। আমার সামনে তখন বসে আছেন একজন আশি ছুঁই ছুঁই অশক্ত বৃদ্ধ। বযেসের ভারে নুব্জ। পরিচয় পর্ব সারার পর শুরু হল আলাপচারিতা। কয়েক বছর আগে সেরিব্রাল অ্যাটাক হওয়ার পর থেকে কথা জড়িয়ে যায়। একদিক অসাড় হয়ে গিয়েছিল। নিজেই রীতিমত এক্সারসাইজ করে কিছুটা হলেও চলাফেরার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছেন।
মুরারিবাবু প্রথমেই একরাশ অভিমান নিয়ে বললেন, ‘এখন তো আর কেউ খবরই নেয়না। নবি তাও গত বছর পর্যন্ত খবর নিত, টাকা দিয়ে সাহায্যও করত। কিন্তু ও-ও এখন ভুলে গিয়েছে। তবে বাবলু এখনও শ্যামনগরে এলে আমার বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে ক্লাবে ডেকে নিয়ে দেখা করে।’
নিজে একসময় ফুটবলটা ভালোই খেলতেন গোলকিপার পজিশনে. টালিগঞ্জ অগ্রগামীর হয়ে। তবে ময়দানের রাজনীতির শিকার হয়ে প্রতিভা থাকা সত্বেও ফুটবলার মুরারি শূর বেশিদূর যেতে পারেননি। এরপর ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার টানে চলে আসেন কোচিং-এ। একসময় ফুটবলের পাশপাশি অ্যাথলেটিক্সেও কোচিং করিয়েছেন। তারপর শুধু ফুটবলকেই বেছে নেন।
দু’বছর আগেও শ্যামনগর আর ত্রিবেনিতে কোচিং করাতেন। এখন আর ত্রিবেণী যেতে পারেন না। সপ্তাহে চারদিন সোম, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শুক্র- শ্যামনগরের যুগের প্রতীক ক্লাবে গিয়ে চেয়ারে বসে আরেকটা বাবলু বা নবি তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই। ছেলে কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। উপার্জন বলতে ইছাপুর রাইফেল কারখানর সামান্য পেনশন ।
আর্থিক দৈন্যতা আর অসুস্থতার জন্য শরীর না চাইলেও এখনও ছুটে চলেছেন আরও একটা বাবলুকে সুব্রত ভট্টাচার্য বানানোর জন্য, পান্ডুয়ার আরও একটি ছেলেকে ভারতীয় ফুটবলে রহিম নবির মতো অন্যতম ইউটিলিটি ফুটবলার বানানোর লক্ষ্যে। তাঁর কথা শুনেই কলকাতা ময়দানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কত কত ফুটবলার। মুরারি শূরের অসংখ্য ছাত্র ফুটবল খেলেই জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু স্ত্রী-পুত্র হারিয়ে, অর্থকষ্টের মধ্যেই অশক্ত পঙ্গু শরীরেও কোচিং করিয়ে চলেছেন মনের দিক থেকে চিরতরুণ মুরারি শূর। তবে এখনও টিভিতে নিয়মিত ফুটবল দেখেন। জাতীয় দলের কোচ ইগর স্টিম্যাচের মতো মুরারি শূরও স্বপ্ন দেখেন, ভারত খুব তাড়াতাড়িই বিশ্বকাপ খেলবে ।
স্মৃতি বেশির ভাগ সময়ই সঙ্গ দেয় না। স্মৃতির পাতা হাতড়ে বললেন, ‘ফিফা একবার স্বীকৃতি দিয়েছিল. সালটা সম্ভবত ২০০১কি ২০০৩ হবে।’
সেবার ডুরান্ডে খেলতে গিয়েছে টালিগঞ্জ অগ্রগামী। পারফরম্যান্স অনুযায়ী গোলরক্ষক হিসাবে প্রথম দলে থাকা উচিত ছিল তাঁর। কিন্তু মুরারি শূরের পরিবর্তে ম্যাচে নামানো হল কর্মকর্তাদের এক পছন্দের গোলরক্ষককে। দু’ টি সহজ গোল খাওয়ার পর সম্বিত ফেরে কর্তাদের। কিছুটা বাধ্য হয়েই শ্যামনগরের তরুণ গোলরক্ষককে নামাতে বাধ্য হন কর্তারা। এরপর লড়াইটা হল মুরারি বনাম প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডদের। সেদিন আর কোনও গোল খেতে হয়নি টালিগঞ্জকে, উলটে তারা একটি গোল শোধ করেছিল । বারবার এরকম রাজনীতির শিকার হয়ে শেষ হয়ে যায় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। নিজের খেলোয়াড়ি জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে জড়ানো গলায় স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন মুরারি বাবু। স্মরণশক্তি প্রায়ই বিশ্বাসঘাতোকতা করে বলে হাজার চেষ্টা করেও সেদিনের প্রতিপক্ষের নাম বলতে পারলেন না ।
তবে রমাকান্ত আচরেকর ও মুরারি শূরের জীবন কাহিনী কোথাও যেন এক সূত্রে বাঁধা। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার পরও মাঠের টানে প্রতিনিয়ত তাঁরা ছুটে গিয়েছেন নতুন প্রতিভা অন্বেষণে। ছাত্ররা মহাতারকা হয়ে উঠলেও নিজেরা থাকতে চাইতেন প্রচারের অন্তরালে। আসলে প্রকৃত দ্রোণাচার্যরা হয়তো এরকমই হন। মুরারি শূর, ভারতীয় ফুটবলে সরকারি ভাবে দ্রোণচার্য খেতাব না পেয়েও তিনিই যে প্রকৃত শিক্ষাগুরু সেটা তাঁর ছাত্রদের নামের তালিকা দেখলেই বোঝা যায়। তাই তো শ্যামনগরের যুগের প্রতীক ক্লাবের মাঠে গেলে এখনও দেখা যাবে বাঁশি নিয়ে কোচিং চালিয়ে যাচেছন মুরারি শূর। চলাফেরা ঠিকমতো করতে পারেন না বলে মাঠের বাইরে চেয়ারে বসে তাঁর নিমগ্ন সাধনা চলছে পরবর্তী প্রশান্ত-সুব্রত-নবি-দুলাল তৈরির লক্ষ্যে।
ভারতে ক্রিকেটের প্রচার বেশি বলে আচরেকার দ্রোণাচার্য পুরস্কার পেয়েছেন, আর মফস্বলের ফুটবল কোচ থেকে গিয়েছেন অন্তরালে, যেখানে বিচারের বাণী আজও নীরবে নিভৃতে কাঁদে।