মেট্রোর কাজে ক্ষতিগ্রস্ত বউবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকা। ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে রয়েছেন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলকাতা মেট্রোর আধিকারিকেরা।
সোমবার সকালেও বউবাজারে ভেঙে পড়ল একাধিক বাড়ি । দুর্গা পিথুরি লেন এবং স্যাকরাপাড়া লেনের পর হিদরাম ব্যানার্জী লেন এবং গৌর দে লেনেও অন্তত ১০ থেকে ১২টি বাড়িতে দেখা দিয়েছে ফাটল । বসে গেছে বেশ কয়েকটি বাড়িও । আতঙ্ক ছড়িয়েছে এলাকায় ।
সোমবার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে দিল্লি থেকে আসার কথা রয়েছে বিশেষজ্ঞ দলের । এছাড়া জার্মানি থেকেও বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয়েছে । তাঁরা এসে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেবেন ।
স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, ১৮ থেকে ২১ আগস্ট হোটেলে ছিলেন তাঁরা । তারপর বাড়ি ফেরেন । সে সময় মেট্রোর কাজ চলাকালীন বাড়িতে যা ফাটল দেখা দিয়েছিল তা মেরামত করে দিয়ে যায় কর্তৃপক্ষ । কিন্তু রবিবার রাতে ফের ওই এলাকার বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল দেখা দেওয়ায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে । কিন্তু সুড়ঙ্গ কাটার আগে তো মাটি পরীক্ষা করা হয়, তাহলে এমনটা কী ভাবে হল ? মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টানেল বোরিং মেশিন দিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার আগে মাটি পরীক্ষা করা হয়েছিল । কিন্তু তখন কোনও ওয়াটার পকেটের অস্তিত্ব ধরা পড়েনি । পরে বোঝা যায় এই এলাকায় মাটির নীচে তৈরি হয়েছিল একাধিক অ্যাকুইফার সাধারণ মাটি পরীক্ষায় এই ধরনের ওয়াটার পকেট বা অ্যাকুইফারের অস্তিত্ব টের পাওয়া য়ায় না । ওইসব অ্যাকুইফার একটি বড় এলাকা জুড়ে থাকে । ওই অ্যাকুইফার লিক করেই জল ঢুকে গিয়েছে সুড়ঙ্গে । এর ফলেই ওই ওয়াটার পকেট লাগোয়া মাটি বসে গেছে । মাটির ওপরে থাকা বাড়িতেও ফাটল দেখা দিয়েছে ।
রবিবার রাত পর্যন্ত ১৮টি বাড়ি থেকে আতঙ্কিত ২৮৪ জন বাসিন্দাকে বিভিন্ন হোটেলে সরিয়ে দিতে হয়েছে বলে জানান কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম । পুরো ধসেছে চারটি বাড়ি । ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আরও অন্তত ১৪টি । ঘটনাস্থলেই খোলা হয়েছে স্পেশ্যাল কন্ট্রোল রুম । নম্বর: ৯৪৩২৬১০৪৭২ । আগামীকাল, মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে নবান্নে বৈঠকে বসবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।
ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের প্রশ্ন, ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত সুড়ঙ্গের প্ল্যানে কোনও গলদ থেকে গেছে ? প্ল্যানে গলদ ছিল না বলে জানান কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মানস সরকার । তাঁর দাবি, মেট্রোর কাজের জন্য আগে যে ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা এবং মাটির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা প্রয়োজন, সবই হয়েছিল যথাযথ ভাবে । ভারতে মেট্রোর ইতিহাসে এটি বিরলতম ঘটনা । তবে তিনি স্বীকার করেন, এমনটা যে ঘটতে পারে, এই প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারেরা তা আন্দাজই করতে পারেননি । ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন, ‘সাধারণত ভূগর্ভে বোরিংয়ের কাজ করার সময় জল উঠতে থাকে । সিমেন্ট ও রাসায়নিক দিয়ে তা রুখে দেওয়া হয় । কিন্তু শনিবার দেখা যায়, কোনও ভাবেই সেই জল বন্ধ করা যাচ্ছে না । বরং হুহু করে আরও জল ঢুকতে থাকে সুড়ঙ্গে । তার জেরেই এই বিপত্তি’। রবিবার রাতেও জলস্রোত ঠেকানো যায়নি । মেট্রো কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, জল রুখতে না পারলে আরও বহু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে । তাই এখন তাঁদের মূল লক্ষ্য, জল বন্ধ করা ।
জানা গেছে, দিল্লি থেকে ডাকা হয়েছে জিওফিজিওলজিস্টদের । তাঁরা এসে পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেবেন । ইতিমধ্যেই তাঁরা টানেল বন্ধ করার কাজ শুরু করেছেন । টানেলের দুই প্রান্ত সিল করে দেওয়া হচ্ছে। যদিও এক ইঞ্জিনিয়রের ব্যাখ্যা, ‘ঘটনার দায় একা কারও ওপর চাপানো যাবে না । কলকাতা শহরের মাটির চরিত্র এমনই, যেখানে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময়েই সতর্ক না হলে এধরনের বিপদ ঘটতেই পারে । তবে ফাটল দেখে মনে হচ্ছে, এটা স্থায়ী । আর বাড়বে না । বৃষ্টি না হলে বড় বিপদের আশঙ্কা নেই’। তবে এই সমস্যার চটজলদি কোনও সমাধান আছে বলেও মনে করছেন না বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়াররা । ফলে এই মুহূর্তে বউবাজারের ঘটনা কলকাতা পুরসভার মূল মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
স্থানীয়রা জানান, শনিবার সন্ধ্যায় প্রথমে ভূমিকম্পের মতো এলাকার বেশ কয়েকটি বাড়ি কাঁপতে শুরু করে । বাড়ির গায়ে ও মেঝেতে ফাটল ধরে যায় ৷ আতঙ্কে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন বাড়িগুলোর বাসিন্দারা ৷ তাঁরা দেখেন, রাস্তাতেও ফাটল ধরেছে ৷ এরই মধ্যে এলাকার একটি তিনতলা বাড়ির দেওয়াল দেওয়াল থেকে একটি বড় চাঙর খসে পড়ে ৷ রবিবার বেলার দিকে দুর্গা প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের ২টি বাড়ি ভেঙে পড়ে । সন্ধের পর আরও দুটি বাড়ি ভাঙার খবর মেলে । ঘটনার পরই তৎপর হয়ে ওঠেন কলকাতা পুরসভার মেয়র । খবর পেয়ে তিনি মেট্রো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন । পরিস্থিতি দেখে মেট্রো কর্তারা মেনে নেন যে টানেল বোরিংয়ের কাজের জন্যেই বাড়ি ভেঙে পড়েছে ।