একেকটা স্কুল বন্ধ করে দেওয়ায় ছাত্রদের ১০-১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে অন্য স্কুলে যেতে হবে
রাজ্যে ১৭০০ স্কুল বন্ধ হচ্ছে। সরকারের বক্তব্য হল এসব স্কুলে ছাত্র আসে না তাই বন্ধ করে দিতে হবে। বন্ধ করে দেওয়া মানে এই নয় শিক্ষকদের চাকরি গেল। শিক্ষকদের চাকরির ঠিকই থাকবে। তারা মোটা মাইনে ঠিকই পাবেন। কিন্তু মাঝখান দিয়ে সমস্যায় পড়ল এলাকার ছাত্ররা। যেহেতু ভবিষ্যতে এই স্কুল থাকবে না তাই এই পদগুলো আর কোনদিন পূরণ হবে না। অর্থাৎ আগামীতে সরকারের অনেক খরচ বাচল
আমাদের রাজ্যে ৪৫ হাজার বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে স্থাপনের ক্ষেত্রে কিছু নীতি নেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে প্রতি দুই কিলোমিটারের মধ্যে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকতে হবে। এর আগে একটি বিদ্যালয় থেকে আরেকটি বিদ্যালয়ের দূরত্ব ছিল প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার। সেটা ৭০/৮০ দশকের কথা। সে সময় আমরা গল্প শুনতাম এত কিলোমিটার পায়ে হেঁটে স্কুলে গিয়েছি। যে যত কিলোমিটার বেশি হেঁটে স্কুলে যেতে পেরেছেন তাকেই আমরা তত বেশি মহান ব্যাক্তি ভেবেছি। যাই হোক এখন আর সেই দিন নেই। স্কুলের ছড়াছড়ি। শিক্ষার হার বেড়েছে সমাজে। গ্রামেগঞ্জে এখন অনেক শিক্ষিত মানুষ দেখা যায়। যেটা আগে দেখা যেত না।
চা বাগান এলাকা বাদ দিলে সর্বত্র শিক্ষার একটা প্রসার ঘটেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক নৈরাজ্য হয়েছে। টেনেটুনে মেট্রিক পাশ করা অনেক গাধাকেও প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চাকরি দেওয়া হয়েছে। তাদের একটাই যোগ্যতা ছিল সেটা হল রাজনৈতিক নেতার প্রতিবন্ধ আনুগত্য।
এসব নানা অসুবিধার মধ্যেও সার্বিকভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে।যদিও যতটুকু হওয়া উচিত ছিল ততটুকু হয়নি। কিন্তু তারপরেও শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা এগিয়েছি। আর এটা সম্ভব হয়েছে এতগুলো স্কুল খোলার জন্য।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্কুল তো খোলা হলো, কিন্তু যদি স্কুলে ছাত্র না আসে তাহলে সরকার এত স্কুল চালিয়ে করবে কি । আর এই সমস্যার সমাধানের জন্য সরকার ঠিক করেছে, যে স্কুলে ছাত্র কম আসে সেই স্কুল কে তার নিকটবর্তী স্কুলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে।
সরকারি ভাষায় তাকে বলে এমালগামেশন বাংলায় স্কুল একত্রি কর না।এই করতে গিয়ে রাজ্যে প্রায় ১২ হাজার স্কুল বন্ধ হয় হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কথায় যুক্তি আছে সন্দেহ নেই। এত টাকা অকাতরে খরচ করতে কোন সরকার আর চাইবে?
কিন্তু এখানে কয়েকটি প্রশ্ন আমাদের ভেবে দেখতে হবে। যে এলাকায় স্কুলটা বাদ দেওয়া হয়েছে সেই এলাকার ছাত্ররা কেন স্কুলে আসেন না এটা বিবেচনা করার জরুরি। মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে দিতে হবে এটা কোন নিদান নয়। স্কুলে ছাত্র আসে না এর কারণ কয়েকটা থাকতে পারে। যেমন এই এলাকা বেশি দরিদ্র। বেশি দরিদ্র মানুষ ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর চাইতে চাইবেন রোজগার করুক। এতে সংসারে আয় বাড়ে।
তাই এইসব এলাকার ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনার জন্য কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটা দেখতে হবে। এবং এই কাজ শিক্ষকরা অবশ্যই করতে পারেন। যে এলাকায় স্কুল বন্ধ করা হচ্ছে সেই এলাকার ছাত্ররা তো আর এই স্কুল বাদ দিয়ে অন্য স্কুলে যাচ্ছে না। যদি যায় তাহলে বুঝতে হবে তাদের বাড়ির পাশের স্কুলের ঠিকমত ক্লাস হয় না।
এখনো বহু শিক্ষক প্রক্সি টিচার দিয়ে ক্লাস করা ন। অনেক সিঙ্গেল টিচার স্কুলে শিক্ষকদের দিয়ে এত সরকারি কাজ করানো হয় যে স্কুল বন্ধ থাকে। শহরের কোন স্কুলে দেখা যায় ১৩-১৪ জন শিক্ষক। আর গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলে দেখা যায় মাত্র একজন শিক্ষক।
এব্যবস্থা পাল্টানোর চেষ্টা চলছে সেই কংগ্রেস আমল থেকে। রেশনালাইজেশন নাম দিয়ে একটি প্রকল্প চালু হয়। কিন্তু এখানে ঘুষ দিয়ে কিছু শিক্ষক তাদের পছন্দমত স্কুলে থেকে যান।
২০১৬ সালের বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকে ভেবেছিলেন এই পদ্ধতির বোধয় পরিবর্তন ঘটবে। কোথায় ঘটলো, পরিস্থিতি যে রকম ছিল সেই রকম রয়েছে। তাই কেন ছাত্র আসছে না সে বিষয়ে কোন পর্যালোচনা না করে স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার ফরমান জারি হল।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে ছে, একেকটা স্কুল বন্ধ করে দেওয়ায় ছাত্রদের ১০-১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে অন্য স্কুলে যেতে হবে। নরসিংপুর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে ভাকরাপার গ্রামে একটি হাই স্কুল বন্ধ করে দেওয়া সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এভাবে যে স্কুলগুলো বন্ধ হচ্ছে এতে এই এলাকার গরিব ছাত্রছাত্রীরা দূরে গিয়ে পড়াশোনা করবে না।
এমনিতেই গ্রামাঞ্চলে পড়াশোনা প্রবণতা কম। তার উপর যদি স্কুল দূরে হয় তাহলে তো আর পড়াশোনা করবে না। এতে কি হবে ,আগামী দশ বছর পর দেখা যাবে নিরক্ষরের সংখ্যা বেড়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি না পিছিয়ে যাচ্ছি। সরকার কি শিক্ষাটাকে শুধু শহুরে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে! শহরে তো প্রাইভেট স্কুল খোলা হবে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে কোন মূর্খ প্রাইভেট স্কুল খুলতে যাবে না।
কারণ এসব গরিব এলাকার অভিভাবকদের প্রতি মাসে ৫০০ টাকাও স্কুল ফ্রিজ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ফ্রি স্কুলেই এই বাচ্চাদের দিতে চাইছেন না তারা আবার প্রাইভেট স্কুলে দেবেন? তাহলে কি গ্রামের মানুষ মূর্খ থাকবে এটাই আমরা চাইছি।
সরকার কত প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা কোন উদ্দেশ্য ছাড়া ব্যয় করছে। বিভিন্ন প্রকল্পে মানুষকে টাকা দেওয়া হচ্ছে। এতে অনেকে সাময়িক লাভবান হচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু এতে একটা পরনির্ভরশীল সমাজ তৈরি হচ্ছে। যারা নিজেরা কোন কাজ না করে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকবে।
অথচ স্কুলে বিনিয়োগ করলে ভবিষ্যতের নাগরিক তৈরি হবে। এর অর্থ এটা নয় যে স্কুলে ছাত্র নেই আর শিক্ষকদের বসিয়ে মোটা মোটা মাইনে দেওয়া হবে। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীরা কেন আসে না সেটা পর্যবেক্ষণ করে তাদের আনার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু এসব না করে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের মত পড়ুয়াদের ৫/৭ কিলোমিটার হাঁটতে বাধ্য করা মানেই হচ্ছে সভ্যতার চাকা কে উল্টোদিকে ঘুরানো।
আবার এমন স্কুল আছে যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা এগিয়ে থাকা অঞ্চলে স্কুলগুলোর অবস্থা ততটা খারাপ নয়। কিন্তু এর অর্থ কি এটাই যে পিছিয়ে পড়া এলাকায় স্কুলতৈরি হবে না। একটা সময় যখন গভীর জঙ্গলে স্কুল তৈরি করা হয়েছিল তখন বাঘ ভাল্লুকের ভয়ে ছাত্র আসতো না। সে সময়কার সরকার তো মনে করতে পারত এখানে ছাত্র আসে না স্কুল তৈরি করে কি লাভ।
কিন্তু সে স্কুল গুলোই আজ অনেক বড় স্কুল হয়েছে। সেই স্কুলগুলি পরবর্তীতে হাই স্কুল হয়েছে। এটাই সরকারের দায়িত্ব। শিক্ষার ক্ষেত্রে সব সময় রিটার্ন টা দেখলে চলে না। পশ্চিমী দেশগুলি প্রতিটা ক্ষেত্রে একটা ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে থাকে। কি দিলাম বিনিময় কি পেলাম এই চিন্তা সেখানকার সরকারের থাকে। কিন্তু আশ্চর্য শিক্ষার ক্ষেত্রে তারা দুহাতে টাকা খরচ করে। একজন প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন সেখানে প্রায় আমাদের টাকায় ৩ লাখ টাকার মত।
কারণ শিক্ষা হলো একটি জাতির মেরুদন্ড। ক্লাসে ছাত্র আসে না এর অনেক সমাধান রয়েছে। যদি ছাত্র কম থাকে তাহলে সেখানকার শিক্ষকদের অভিভাবকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র আনার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি কম ছাত্র থাকে তাহলে একজন শিক্ষক রেখেও পড়াতে হবে। একটি ছাত্রও আসে না, কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ৩০ জন ছাত্র না হলে বিদ্যালয়ে বন্ধ করে দেব। কেন ৩০ জনের কম হলে বাকিদের কি পড়ার অধিকার নেই। ঠিক আছে দরকার পড়লে একজন শিক্ষক রেখে ওদের পড়ানো উচিত।
কিন্তু এভাবে স্কুল বন্ধ করলে একটা গোটা এলাকা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়বে। কারণ গ্রামাঞ্চলে একটা স্কুলকে কেন্দ্র করে সেই এলাকার শৈক্ষিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। তাই আমরা আশা করব সরকার এই সিদ্ধান্ত পুনঃববেচনা করবে। কারণ সভ্যতার চাকা সচল রাখাটাইতো একটা সরকারের কাজ।
Advertisements | 5E For Success