সাইনবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে বাইট দিলেন সাংসদ ও বিধায়ক
বরাকে বারবার ভাষা আইন পদদলিত হচ্ছে। অথচ ১৯৬১ সালে শিলচর রেল স্টেশনে ১১ জন শহীদের রক্তের বিনিময়ে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এটা দুঃখজনক ঘটনা যে, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা জানেন না যে আসামের এই বাঙালি অধ্যুসিত বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার জন্য ১১ জন প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু সেই সময় কলকাতার দৈনিক গুলিতে ফলাও করে ভাষা আন্দোলনের খবর ছেপেছিল। এবং এরপর থেকে বরাকে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষা সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের দপ্তরে কাজ হয় বাংলা ভাষায় ।
কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের সাইনবোর্ড গুলি বাংলায় থাকবে। কেন্দ্র সরকারের ক্ষেত্রে হিন্দি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা থাকবে।। রাজ্য সরকারের সাইনবোর্ড গুলিতে ইংরেজি সঙ্গে বাংলা থাকবে। বরাক উপত্যকার তিন জেলায় সরকারি স্কুল গুলি বাংলা মাধ্যম। এসব অধিকার বাঙালি অর্জন করেছিল রক্তের বিনিময়ে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে গত চার পাঁচ বছর থেকে বাংলা ভাষাকে বারবার অপমানিত করা হচ্ছে। গত বছর শিলচর রেল স্টেশনে জলজীবন মিশনের একটি সাইনবোর্ডে বাংলা সরিয়ে অসমীয়া লেখা হয়। এতে কিছু লোক ক্ষুব্ধ হয়ে অসমীয়া ভাষায় কালি লেপন করে। এর কিছুদিন পর মেহেরপুরে একটি পেট্রোল পাম্পেও অসমীয়া হোডিং লাগানো হয়। প্রতিবাদ করেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব প্রদীপ দত্তরায়। তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে তেমন কোন আওয়াজ উঠল না উপত্যকা জুড়ে। বাংলা ভাষার এই ঘোর বিপর্যয়ের দিনেও তার পাশে দাঁড়ালেন না কোন বুদ্ধিজীবী।
নিরদশ্রী চৌধুরী বলেছিলেন বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি। বরাক তথা আসামের বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রে এই কথা সাংঘাতিকভাবে খাটে। বাংলার চূড়ান্ত অপমান মানুষ মুখ বুঝে সহ্য করল। এমনকি সাংসদ রাজদীপ রায় বললেন বরাকে বাংলা নাকি সহযোগী ভাষা। এটা যদি কোন অসমীয়া সাংসদ বলতেন তাহলে বলার কিছু ছিল না। একজন বাঙালি সাংসদ কিভাবে এই কথা বলতে পারেন।
গত সাত তারিখ কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের একটি অফিসের সূচনা হয় শিলচরে। সেখানে অফিসের সাইন বোর্ডে ইংরেজি হিন্দি অসমীয়া রয়েছে। বাংলা ভাষা স্থান নেই। এটা সরাসরি ভাষা আইন লঙ্ঘন। সরকার এক্ষেত্রে বেআইনি কাজ করছে। এই সাইনবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে বাইট দিলেন সাংসদ ও বিধায়ক।
তাদের চোখের সামনে এভাবে বাংলাকে পদদলিত করা হলো। তারা চুপচাপ থাকলে ন। একটা প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে অসমে কি বাংলা ভাষার কোন মর্যাদা নেই। কার ভুলে এখানে সাইনবোর্ডে বাংলার থাকল না। এ প্রশ্নটা করা উচিত ছিল সাংসদ বিধায়কদের। কিন্তু তারা চুপ থাকলেন।
দিশপুরের কর্তাদের বিরাগ ভাজন হতে তারা চাইলেন না। দিসপুরের অসমীয়া নেতৃত্বকে চটাতে চান না বরাকের বাঙ্গালী নেতারা। তাই নিজের মায়ের ভাষার অপমান দেখেও তারা চুপ থাকেন। কারণ তারা জানেন যে বাংলা ভাষাকে প্রাপ্য মর্যাদা না দিলেও তারা ভোটে জিততে পারবেন। প্রবল হিন্দুত্বের হাওয়ায় তারা ভোটে জিতবে ন। তাই অযথা বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলে দলের অসমীয়া নেতৃত্বের কাছে বিরাগভাজন হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
এখানে দুটো প্রশ্ন আছে। ধরুন কেউ বিজেপি করছেন তিনি বাঙালি। তো বিজেপি করার জন্য তিনি কি বাংলা ভাষা ছেড়ে দেবেন। বা একজন অসমীয়া বিজেপি করছেন। তিনি কি বিজেপি করার জন্য অসমীয়া ছেড়ে দিচ্ছেন। রাজ্য মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরা এত বারবার বলছেন অসমিয়া খিলঞ্জিয়া এসব শব্দ। তারা যখন তাদের জাতির স্বার্থে কথা বলেন তখন সেটা দোষের হয় না। শুধু দোষ যদি বাঙালি তার জাতির স্বার্থে কথা বলে।
এভাবে বরাক উপত্যকাতে বাঙালি নেতৃত্বকে নির্বিষ করে দেওয়া হচ্ছে। চাটুকার সংসদ বিধায়কদের বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। এরা নিজের এলাকার অধিকারের জন্য কোন কথা বলবে না। তাদের নখদন্তহীন করে রাখা হয়েছে। একটা থানার ইনচার্জ এখন বিধায়কদের পাত্তা দেয় না। এতটাই অত পতন ঘটেছে নেতৃত্বের।
কোন বিষয়ই তারা কথা বলতে চান না। বরাক উপত্যকায় গত কয়েক বছরে বাইরে থেকে প্রচুর নিযুক্তি হয়েছে। কিন্তু এর কোন প্রতিবাদ শাসকদলের সাংসদ বিধায়করা করেননি। তারা ব্যস্ত থেকেছেন কিভাবে পরের বার টিকেট পাওয়া যায়। দিশপুরের নেতাদের খুশি করতেই তারা ব্যস্ত।
তাই বরাকে আগামীতে বাংলা ভাষা কি আদৌ থাকবে এই প্রশ্নটা কিন্তু এখন অনেক বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের নেতৃত্বে যে দৈন্যতা দেখা যাচ্ছে তাতে কিন্তু মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে এখানে বাংলাকে টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। অদূর ভবিষ্যতে আমরা গোয়ালপাড়া হতে পারি। কিছু কিছু ভক্তকুল আছেন যারা জাতিসত্তা বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।
যার জন্য এরা সাহস পায় কেন্দ্রীয় সরকারের সাইনবোর্ডে বাংলাকে বাদ দিতে। ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করা হয়েছে। অত্যন্ত সুকৌশলে একটির পর একটি সাইনবোর্ডে বাংলা সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষাকে শেষ করে দেওয়া এই চক্রান্তের শামিল হয়েছেন বাঙালি সাংসদ বিধায়করা।
Advertisements