১৯৭২ থেকে পঞ্চাশ বছরের লক্ষ্যপূরণে অজুহাত, গড়িমসি আর সহ্য করা হবে না , স্পষ্ট বার্তা সরকারকে
শিলচর : ঢের হয়েছে ,আর নয় , বরাক উপত্যকাকে নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলা চলবে না । আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগেই বরাক উপত্যকাকে নতুন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করতে হবে, গুরুত্বপূর্ণ দাবি ইউনিয়ন টেরিটরি ডিমান্ড কমিট-র। ইউটিডিসি-র পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আগামী নভেম্বরের মধ্যে কেন্দ্র সরকারকে বরাক উপত্যকায় ” পর্যবেক্ষণ দল” পাঠিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। দীর্ঘদিনের গণদাবি পূরণে কেন্দ্র সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ডিসেম্বর থেকে পথে নামবে ইউটিডিসি ।
কারণ , ১৯৭২ সাল থেকে বরাক উপত্যকাকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার জন্য লাগাতার যে দাবি উত্থাপিত হচ্ছে, তাতে এমনকী বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্র সরকারও সহমত পোষণ করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা প্রতিকূলতা তৈরি হওয়ায় আজ অবধি এই লক্ষ্য পূরণ হয়নি।স্বাধীনতার পর থেকেই চরম বঞ্চনা, বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন তৎকালীন কাছাড় জেলাবাসী। ১৯৪৮ সালেই অসম থেকে সরে আসতে চেয়েছিলেন এই অঞ্চলের ভুক্তভোগী মানুষ । এর পর বহু রক্তের বিনিময়ে বরাকে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
কিন্তু “আসাম চুক্তি” হয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ।এই সময়ে বরাকের জনগণকে যে ভাবে যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে কাটাতে হচ্ছে , সেটা নজিরবিহীন । কার্যত, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো এখানকার লোকদের জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে । তাই বরাকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনে কোনও অজুহাত দিয়ে কেন্দ্র সরকারের আর টালবাহানা করা উচিত নয় , স্পষ্টতই জানিয়ে দিলেন ইউটিডিসি কর্মকর্তা তথা সংগঠকরা।
ইউটিডিসি কেন্দ্রীয় সভাপতি সঞ্জিত দেবনাথ বলেন , শিক্ষা – স্বাস্থ্য – কৃষি -শিল্প কারখানা -কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনের বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত বরাকবাসী। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চরম বৈষম্য । তা সত্ত্বেও বরাকের জনগণ বার বার ধৈর্যশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে , এই অঞ্চলকে সব দিক থেকে কোণঠাসা করা হচ্ছে । প্রয়োগ করা হচ্ছে নানা রকম কূট-কৌশল ।
কেন্দ্র পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ায় এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট । ইউটিডিসি-র প্রাণপুরুষ পরিতোষ পালচৌধুরী কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দাবিকে রূপায়ণ করতে গিয়ে আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন ।আরও অনেক বিশিষ্টজন এবং সংগঠক বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন । সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব পালচৌধুরী বলেন , বরাকের মানুষ শুধু মুখে আর সামাজিক গণমাধ্যমে শোষণ- লাঞ্ছনার কথা বললে চলবে না ,একেবারে ময়দানে নেমে দাবি আদায় করে তবেই থামতে হবে ।
নতুবা চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে , আক্ষেপের সুরে এটাও বলেন তিনি । অন্যতম সহ-সভাপতি মায়াজুল আলি বড়ভূঁইয়া বলেন , বরাক উপত্যকাকে বাঁচাতে ধর্মের প্রাচীর ভেঙে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে । বরাককে নিঃস্ব করে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে । বরাকে যে সম্পদ রয়েছে , কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হলে অনেক ভালোভাবেই চলবে এই উপত্যকা । সাধারণ সম্পাদক মৃন্ময়কুমার নাথ বলেন, সিন্ডিকেট করে বরাকের অর্থনীতিতে লুণ্ঠন চালানো হচ্ছে । ঠিকাদারি থেকে শুরু করে সকল কাজকর্মের ক্ষেত্রেই মূল দায়িত্বে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার লোকেরা । অত্যন্ত নগ্নভাবে এ সব করানো হচ্ছে । এখানকার শাসক নেতারা কিন্তু নির্বিকার ।
সম্পাদক সৌমিত্র নাথ বলেন , বরাকের মানুষকে আর চেতনাহীন হয়ে থাকলে চলবে না । গত কয়েক দশকে যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে এই অঞ্চলে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয় । তাই শেষ রক্ষা করতে হলে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে । অনুপকুমার নাথ বলেন ,অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ছাড়া বরাকের মানুষের কাছে বিকল্প কিছু নেই । সুবর্ণখণ্ড রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম লস্কর বলেন , জীবন – মরণের সীমানায় দাঁড়িয়ে বরাকের জনগণের ভাগ্যলিপি নিজেদেরই নির্ধারণ করতে হবে । রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উৎস সন্ধানে অবশ্যই যত্নশীল হতে হবে ভুক্তভোগী বরাকবাসীকে ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালেই বরাক উপত্যকাকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দিতে অত্যন্ত তৎপর হয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী । কিন্তু নানা কারণে তা কার্যকর হয়নি , এ কথা উল্লেখ করে ইউটিডিসি মুখ্য সংযোজক শংকর দে জানান , সেই সময় থেকে শুরু করে মোরারজি দেশাই , চৌধুরী ঢরণ সিং, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, চন্দ্রশেখর , পিভি নরসিংহ রাও , এইচডি দেবেগৌড়া , ইন্দ্রকুমার গুজরাল , অটলবিহারি বাজপেয়ী , মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্র মোদি ,এক কথায় সকল প্রধানমন্ত্রীর কার্যকালে স্মারকপত্র পাঠিয়েছে ইউটিডিসি । বহু বার দিল্লিতে আন্দোলন , দাবিপত্র পেশ করা হয়েছিল।
এর ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারের আমলে কেন্দ্র বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় , কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এখনও হয়ে ওঠেনি। পূর্বাপর নানা ইতিহাস , ঘটনাপ্রবাহ তোলে ধরে শংকর দে বলেন, ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছে -অনিচ্ছে, দয়া -দাক্ষিণ্যের ওপর বরাকের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে না। অন্য কোনও অঞ্চলের সঙ্গে এখানকার এই গণদাবিকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।
১৯৪৮ সাল থেকেই এর সূচনা হয়েছিল। দল -মত -নির্বিশেষে অনেক বিধায়ক- সাংসদ তথা ক্ষমতাবান নেতারা বিশেষত ষাটের দশকে দিল্লি-দরবারে এ নিয়ে জোরালো ভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন। পরে ইন্দিরা গান্ধী বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন । শংকর দে আরও জানান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার মূলত বরাক উপত্যকা। ট্রান্স -এশিয়া রেল-রোড যোগাযোগ চালু হলে এ অঞ্চলে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
বেশি দিন বরাককে অবদমিত করে রাখা যাবে না, সরকারকে এই সত্যটুকু অবিলম্বে উপলব্ধি করা উচিত। ইউনিয়ন টেরিটরি দাবি আদায়ে গণস্বাক্ষর অভিযান থেকে শুরু করে চরমপত্র পেশ , বিভিন্ন কর্মসূচির কথাও জানান তিনি। বলেন , ভালোয় -ভালোয় তা হয়ে গেলে সকল পক্ষের কাছেই এটা মঙ্গলজনক।