ভবিষ্যতে গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও এল নিনোর হাত থেকে বাঁচতে অথবা হলিডে ডেস্টিনেশন হিসাবে বেড়ে উঠবে চাঁদের গুরুত্ব
‘চাঁদে আবাসন ও হোটেল নির্মাণের জন্য গ্লোবাল টেন্ডারের আহ্বান’, ‘আমরাই সব থেকে কম খরচায় চন্দ্রভ্রমণ করিয়ে থাকি’ বা ‘চাঁদে জমি-বাড়ি কেনার জন্য যোগাযোগ করুন এই নম্বরে’, ‘চন্দ্রের দক্ষিণ মেরুতে রহস্য মৃত্যু দুই ভারতীয় সহ পাঁচ পর্যটকের’! না, জুলে ভার্ন, আর্থার সি ক্লার্ক অথবা অদ্রীশ বর্ধনের কোনও কল্প বিজ্ঞানের কাহিনী থেকে ওপরের লাইনগুলো ধার করা হয়নি। আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই ধরণের বিজ্ঞাপন বা নোটিশের দেখা পাওয়াটা এখন আর কোনও কষ্ট কল্পনা নয়। বাহুবলী চাঁদের দক্ষিণ মেরুর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করার পর এ ধরণের চিন্তাভাবনা গোটা বিশ্ব জুড়েই শুরু হয়ে গিয়েছে।
এমন দিন আসন্ন, যেদিন আপনারই পরবর্তী বা তারও পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো কসবায় বাসর রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য পাড়ি দেবেন চাঁদমামার বাড়ি। আর তাঁরা চাঁদে গিয়ে চন্দ্র জোছনায় গা ভিজিয়ে ছবি তুলে এনে দেখাবে আপনাকে। আর আপনিও হাতে চায়ের কাপ নিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবেন উত্তরসূরিদের চন্দ্রভ্রমণের দৃশ্যগুলি। এতটা পড়ার পর বাস্তব জগতে বিচরণ করছেন কিনা সেটা বোঝার জন্য নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখার প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞান যেভাবে এগোচ্ছে, আগামী ৪০-৫০ বছরের মধ্যেই হয়তো চাঁদও আমাদের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নেবে।
দুর্মূল্যের বাজারে চন্দ্র অভিযানের খরচ এক ধাক্কায় অনেকটাই কমিয়ে সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে ইসরো। বাজারে সব জিনিসের দাম বাড়লেও মহাকাশ অভিযানের খরচ কিন্তু ক্রমশ কমছে। ফলে উইকএন্ডে চাঁদের মাটিতে সাততারা বিলাসবহুল হোটেলে ডিনার সম্পন্ন করে সপ্তাহের প্রথম দিন সকালেই যথারীতি কাজে যোগ দিতে পারবেন বা প্রিয় জনের জন্মদিনের বার্থডে কেকটা চাঁদে গিয়েই পরিবার সহ কাটতে পারবেন।
আমেরিকা, রাশিয়া, চিন ও ভারত ইতিমধ্যেই চন্দ্র অভিযানে সাফল্য লাভ করেছে। চাঁদের মাটিতে মানুষের পদার্পণের পর কেটে গিয়েছে ৫০ বছর। নীল আমস্ট্রং প্রথম মানুষ হিসাবে চাঁদে পা রাখার পর গত ৫০ বছরে মাত্র ৫৭১ জন নভোশ্চর তকমা পেলেও মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ধারণা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পাবে। বহুদিন পর্যন্ত মহাকাশ অভিযান হয়েছে নাস, পেন্টাগন বা ইসরোর মতো সরকারিসংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায়। তবে এখন বেশ কিছু বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থাও এগিয়ে এসেছে মহাকাশ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে। অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস, এলন মাস্কের স্পেস-এক্স বা রিচার্ড ব্রানসনের ভার্জিন গ্যালাকটিক-এর মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি মহাকাশ গবেষণায় লগ্লি করার পাশপাশি নিজেরাও উদ্যোগী হয়ে উঠেছে মহাকাশ অভিযান সফল করার জন্য। স্পেস-এক্স যে দামে (১০০ কোটি ডলার) ফ্যালকন রকেট তৈরি করেছে, নাসার পরিকাঠামোয় সেই রকেট তৈরি করতে লাগত চার গুণ অর্থ।
ভার্জিন গ্যালেকটিক ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে ২০২২ সালের মধ্যে ১,০০০ মানুষকে মহাকাশে ঘোরাতে নিয়ে যাবে তারা। স্টারশিপ জানিয়েছে, তাদের মহাকাশযান ফ্যালকনকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য স্টারশিপ বানিয়ে একাধিকবার মহাকাশ অভিযানের পরিকল্পনা নিয়েছে তারা।
এদিকে, ইসরোর পাঠানো চন্দ্রযান চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দিকে যাত্রা শুরু করার পর এ বার সেই দক্ষিণ মেরুতেই মহিলা নভশ্চর পাঠানোর কথা ঘোষণা করল নাসা। সব ঠিক থাকলে, ২০২৪ সালেই অভিযাত্রীদের নিয়ে চাঁদে পৌঁছবে আর্তেমিস। ১৯৬৯ সালের এই জুলাই মাসেই প্রথম অভিযাত্রী চন্দ্রপৃষ্ঠে নেমেছিল নাসার অ্যাপোলো ১১ যানে চেপে। তার পরে ৫০ বছর পেরিয়েছে। সূর্যের দেবতা অ্যাপোলোর পরে এ বার চাঁদের দেবী আর্তেমিস পাড়ি দেবেন চাঁদে। নাসার পাঠানো অ্যাপোলো থেকে নেমে সেই বার চাঁদের মাটিতে হেঁটেছিলেন দুই মহাকাশচারী, নীল আর্মস্ট্রং আর এডউইন অলড্রিন। অ্যাপোলোতে ছিলেন আরও এক অভিযাত্রী, মাইকেল কলিন্স। অর্থাৎ তিন জনেই পুরুষ। কিন্তু নাসার আগামী অভিযানে চন্দ্রপৃষ্ঠে হাঁটবেন এক মহিলা মহাকাশচারী। আর চাঁদে প্রথম মহিলা অভিযাত্রী নিয়ে অবতরণ করতে চলা এই চন্দ্রযানের নামকরণ করা হয়েছে চাঁদের দেবী আর্তেমিসের নামে। উল্লেখ্য, গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, অ্যাপোলো আর আর্তেমিস দুই যমজ ভাইবোন। দু’জনেই গ্রিক দেবতা জিউসের সন্তান। অ্যাপোলো হলেন সূর্য, আলো ও জ্ঞানের দেবতা। আর আর্তেমিস চাঁদ ও বন্যপ্রাণীর দেবী। চাঁদে প্রথম মহিলা অভিযাত্রীকে নিয়ে যাওয়ার এই অভিযানের নাম তাই দেওয়া হয়েছে সেই দেবী আর্তেমিসেরই নামে।
বিজ্ঞান যে ভাবে এগিয়ে চলেছে এবং বিজ্ঞানের যে ভাবে বিশ্বায়ন হচ্ছে, তাতে গোটা বিশ্ব একযোগে কাজ করে এল নিনো ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ক্ষতিকারক প্রভাব এড়িয়ে মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবীর বাইরে বসতি গড়ে তোলার চিন্তা শুরু করে দিয়েছে। অন্যান্য গ্রহ থেকে চাঁদে যাওয়া অনেক সহজ হওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে মানুষের ঠিকানা হিসাবে চাঁদের অন্তর্ভুক্তি হওয়া এখন আর মোটেও অবাস্তব কল্পনা নয়।