ফ্লপ মাস্টার জেনারেল থেকে মহানায়ক
বাংলা সিনেমার মহানায়ক উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন ১৯৮০ সালে। কিন্তু মৃত্যুর পর ৩৯ বছর কেটে গেলেও বাঙালি এখনও উত্তমময়। গত দুই প্রজন্মের মহিলাদের মনে আদর্শ পুরুষ হিসাবে উত্তমকুমারের অবস্থান সর্বাগ্রে। এমনকি বর্তমান প্রজন্মের মহিলাদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রসেনজিৎ, জিৎ বা দেবদের মতো বর্তমান বাংলা সিনেমার নায়কদেরকেও ঈর্ষাণ্বীত করে তুলতে পারে। তাঁর জীবিত কালে তো বটেই, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও বাংলার যুবকরা চুলের স্টাইল, হাটাচলা, এমনকি কথা বলা ও হাসির ক্ষেত্রেও উত্তমকে অনুসরণ করেই মেয়েদের নজর কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেন।
বাংলার এই মহানায়কের উঠে আসার পথটি অবশ্য লাল কার্পেট বিছানো ছিল না। তাঁর আসল নাম ছিল অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। ভবানীপুরে পৈতৃক বাড়ি হলেও জন্ম হয়েছিল উত্তর কলকাতার আহিরিটোলার মামাবাড়িতে। সাউথ সুবার্বান স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্সে ভর্তি হন উচ্চশিক্ষার জন্য। তবে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে কেরানির চাকরি পেয়ে যাওয়ায় শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়াতে পারেননি। তবে বাড়ির আর্থিক পরিস্থিতির জন্য চাকরি করতে বাধ্য হলেও অরুণকুমারের মন পড়ে থাকত অভিনয় জগতে। ১৯৪৭ সালে মায়াডোর সিনেমার হাত ধরে তিনি চলচিত্র জগতে পা রাখলেও ছবিটি মুক্তি পায়নি। সেই অর্থে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি ১৯৪৮ সালে নীতিন বসুর পরিচালনায় দৃষ্টিদান। এরপর আরও চার-পাঁচটি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। তখন অবশ্য তিনি অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় নামেই অভিনয় করতেন। কিন্তু সেই সময় তাঁর অভিনীত কোনও ছবিই সাফল্যের মুখ দেখেনি। সেই সময় টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় তাঁর নাম দাঁড়ায় ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’। স্টুডিওতে প্রবেশ করলেই তাঁর উদ্দেশে ‘ওই যে নতুন দূর্গাদাস এলেন’ বা ‘নতুন ছবি বিশ্বাস’ জাতীয় বক্রোক্তি ভেসে আসত। নাম পরিবর্তন করে অরুণকুমার হলেন উত্তমকুমার। এরপর কিছুটা হলেও পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেলেন এমপি স্টুডিওর পরিচালনায় ‘বসু পরিবার’ ছবিতে অভিনয় করে। ১৯৫৪ সালে ‘অগ্নি পরীক্ষা’ ছবিতে অসামান্য অভিনয় করে দর্শকদের মন কেড়ে নিলেন, যা থেকে গেল তাঁর মৃত্যুর পরও। এর মধ্যে ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেল উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত প্রথম ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের সঙ্গে এই ছবিতে নবাগত উত্তম অসাধারণ অভিনয় করে বাংলা সিনেমার ম্যাটিনি আইডল হয়ে তো উঠলেনই, সেই সঙ্গে বাংলা সিনেমা পেল সর্বকালের সেরা জুটি। এরপর এই জুটিতে তৈরি হল, হারানো সুর, সপ্তপদী, শাপমোচন, সাগরিকা, শিল্পীর মতো একের পর এক যুগান্তকারী ছবি। টলি পাড়ায় একমাত্র সুচিত্রা সেনকে তাঁর ডাকনাম ‘রমা’ বলে সম্বেোধন করার অধিকার ছিল উত্তমকুমারেরই।
অবশ্য শুধু সুচিত্রা সেনই নন, সুপিয়াদেবি, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায় ছাড়াও তৎকালীন যুগের প্রায় সমস্ত নায়িকার সঙ্গেই অভিনয় করেছিলেন। উত্তম-সুচিত্রার মতো অতটা না হলেও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল উত্তম-সুপ্রিয়া ও উত্তম-সাবিত্রী জুটি।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্ট গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সির চরিত্রে ‘চিড়িয়াখানা’-য় অভিনয় করে পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে অ্যান্টনি কবিয়ালের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্যও তিনি ভূষিত হয়েছেন জাতীয় পুরস্কারে। ১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত নায়ক সিনেমায় অভিনেতা অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রে তাঁর অভিনয় বাঙালা সিনেমায় শুধু নয়, গোটা বিশ্বেই অভিনয়ের একটা নতুন মাইলস্টোন তৈরি করে দিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ২৫ নভেম্বর শক্তি সামন্ত পরিচালিত ‘অমানুষ’ ছবিতে (হিন্দি ও বাংলায় প্রকাশিত) মধুর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার। ভারত সরকার ২০১৫ সালের ১৯ জুন থেকে বছরের সেরা অভিনেতার হাতে ‘উত্তম পুরস্কার’ ও পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দিচ্ছে।
এবার উত্তমকুমারের ৪০তম মৃত্যুদিবস। তাঁর মৃত্যুদিন ২৪ জুলাইকে আজও আপামর বাঙালি চলচ্চিত্রপ্রেমী চোখের জলে স্মরণ করেন। ১৯৮০ সালের এই দিনটিতেই ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবির শুটিং-এর সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৪ বছরেই প্রয়াণ ঘটে এই মহানায়কের।
অভিনয়ের সূক্ষ্ণ দিকগুলি ওস্তাদের মতো ফুটিয়ে তুলতে পারতেন উত্তমকুমার। আজকের ইন্টারনেট-স্যাটেলাইটের রমরমার সময়েও উত্তমকুমারের সমকক্ষ অভিনেতা কাউকে খুঁজে পায়নি বাঙালি। যো কোনও ভূমিকায় তাঁর অভিনয় শৈলীর কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। উত্তমের মতো ক্যামেরার ব্যাবহার সাবলীল ভাবে করতে পারার মতো অভিনেতা খুব কমই দেখা গিয়েছে। সুচিত্রা সেন বা ছবি বিশ্বাসের মতো পর্দা-কাঁপানো তারকাদের সঙ্গে তিনি সমানে সমানে টক্কর দিয়ে অভিনয় করতেন। পাশপাশি গান ছিল তাঁর প্যাশন। নিজে তো সুগায়ক ছিলেনই, পাশপাশি ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলেন। নিজে ভালো গান গাইেতন বলেই হয়তো অসাধারণ দিতে পারেতন। তাঁর লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান আজও মানুষকে স্মৃতিমেদুর করে তোলে। পরিচালক ও প্রযোজক হিসাবেও কাজ করেছেন উত্তমকুমার। তৎকালীন বিশেষজ্ঞদের মতে, হিন্দি সিনেমাতেও মহানায়ক হয়ে ওঠার ক্ষমতা ছিল এই বাঙালি অিভনেতার। কিন্তু তখনকার মুম্বইয়ের কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের রাজনীতির শিকার হওয়ায় সেটা হয়ে ওঠেনি। জীবনে শেষ দিকে হিন্দি সিনেমা ‘ছোটি সি মুলাকাত’-এর প্রযোজনা করতে গিয়ে প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল উত্তমকুমারকে। এর পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পেয়েছে রূপেও দেখা গিয়েছে উত্তমকুমারকে।
অভিনয় ছাড়াও আরও যেই গুণটি উত্তমকুমারকে অমরত্ব দিয়েছিল তা হল তাঁর সাংস্কৃতিক আইকনের পরিচয়। এই একটি ব্যাপারে উত্তমকুমার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বা সমসাময়িকদের অনেকটাই পিছনে ফেলে দেন। অভিনেতাদের জন্য তো বটেই সামান্য টেকনিশিয়ানরাও যে কতবার উপকৃত হয়েছিলেন তাঁর কাছ থেকে তা হিসাব করে বলা যাবে না।
আসেল উত্তমকুমার ছিলেন বাঙালি সত্তার এক সম্পূর্ণ ‘প্যাকেজ’। ছবিতে যে কোনও চরিত্র অভিনয় করার সময় তিনি নিজেকে দারুণভাবে মিশিয়ে ফেলতে পারতেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, হাসি, উচ্চারণ- তাঁর সম্পূর্ণ ভাবমূর্তিই মিলে যেত চরিত্রের সঙ্গে। তখনকার বাঙালি দর্শকের কাছে বেশি আবেদন রাখত সহজ জীবন দর্শন এবং যাপন, সরল রোম্যান্টিকতা, শ্রুতিমধুর গান এবং দৃষ্টিমধুর অভিব্যক্তি। এই সমস্ত উপাদান পর্দায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনবদ্য। বাজার-অর্থনীতির পূর্ববর্তী সময়ের শিল্পী হয়ে আজও অমর তিনি, আজকের বাজার-প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পীদের কাছে জনপ্রিয়তার দৌড়ে হার মানেননি উত্তমকুমার। আজকে চলচ্চিত্র শিল্প উত্তমকুমারের যুগ থেকে এগিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। আরও কয়েক দশক বেঁচে থাকলে উত্তমকুমারও হয়তো অমিতাভ বচ্চন বা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো নতুন যুগকে আলিঙ্গন করতে পারতেন। সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলে খুশিও হতেন। আরও নতুন স্তরে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারতেন। তবে সেই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েও তিনি হারিয়ে যাননি অতীতের ধূসর পাতায়। চব্বিশে জুলাই আজও ফিরে আসে তাঁর স্মৃতিকে জীবন্ত করতে।
মহানায়কের ৪০ তম মৃত্যুদিবসেও তাঁর ভক্তরা তাঁকে স্মরণ করছেন নিজের নিজের মতো করে। উত্তম মঞ্চে সেই স্মৃতিচারণার জন্য অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়, নিমাই ঘোষ, শ্রীকান্ত আচার্যর মতো ব্যক্তিত্বরা। পাশাপাশি এনটি ওয়ান স্টুডিয়োয় তাঁর ব্যবহৃত শেষ মেকআপ রুমকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। নজরুল মঞ্চে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে তাঁর নামাঙ্কিত টেলি সম্মান অ্যাওয়ার্ডের সূচনা হয়েছে।