১৯৭১-এর সিমলা চুক্তি ভঙ্গ করে যুদ্ধ শুরু হয় ৩ মে ১৯৯৯
২৬ জুলাই ১৯৯৯।তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি ঘোষণা করলেন, ‘অপারেশন বিজয়’ জয়ের কথা। সরকারিভাবে জানানো হয়, ভারতীয় সেনারা প্রায় তিন মাস মরণপণ যুদ্ধ চালানোর পরপাকিস্তানের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করেছে কারগিলসহ অন্যান্য অধিকৃত এলাকা। তারপর থেকে প্রতি বছর এই দিনটিকে ‘কারগিল বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়েআসছে। এই বছর ‘বিজয় দিবস’ পালনের মূল ভাবনা, ‘রিমেমবার-রিজয়েস-রিনিউ’।
এবার একটু পিছনের দিকে তাকানো যাক।১৯৯৯ সালের মে মাসের শুরুতেই হঠাৎকরেই খবর আসে, পাকিস্তানি সেনারা কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীর ছদ্মবেশে লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) পার করে কাপুরুষের মতো গোপনে ভারতীয় জওয়ানদের ওপর হামলা চালিয়েছে। যার ফলে শহীদ হয়েছেন বেশ কয়েকজন ভারতীয় সেনা।পাকিস্তানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, কারগিলকে দখলে নিয়ে লাদাখ এবং কাশ্মীরের মধ্যে সংযোগ ছিন্ন করা। এবং এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ‘কাশ্মীর সমস্যা’ নিয়ে আসা, যাতে বিভিন্ন অজুহাতে তারা তাদের দখল সফল করতে অন্যান্য দেশের সাহায্য পায়। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। এমনকী, চিনও সাড়া দেয়নি প্রতিবেশী দেশটির এই মনোভাবে।
যোগ্য জবাব দেওয়ার পালা ভারতীয় সেনা জওয়ানদের।শ্রীনগর থেকে মাত্র ২০৫ কিলোমিটার দূরে কারগিলে তৈরি হয় যুদ্ধের পরিস্থিতি। ভারত সরকারের তরফ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর ১৯৭১-এর সিমলা চুক্তি ভঙ্গ করে যুদ্ধ শুরু হয় ৩ মে ১৯৯৯।
পার্বত্য এলাকায় প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যে বরফাবৃত এলাকায় যুদ্ধ হওয়ায় কিছুটা বেগ পেতে হয় ভারতীয সেনাকে। তবে অদম্য সাহস আর দেশের প্রতি ভালোবাসা যে কোনও ক্ষেত্রেই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দেশের জওয়নরা। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মনোভাব নিয়ে শত্রুপক্ষের মোকাবিলা করেন জওয়ানরা ।
জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য।শত্রুপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রথমে ঝাঁপিয়ে পরে ইন্ডিয়ান আর্মি। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় বায়ুসেনাও। যৌথ আক্রমণে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাক সেনা।একে একে পাকিস্তানি সেনার দখল করা সেক্টরগুলি ফের দখলে নিয়ে আসে ভারতীয় সেনা। সফল হয় অপারেশন বিজয়।২ মাস তিন সপ্তাহ ২ দিন লড়াই চলার পর অবশেষে যুদ্ধ সমাপ্ত হয় ২৬ জুলাই।অবশ্য ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি‘অপারেশন বিজয়’-এর সাফল্য ঘোষণা করেছিলেন।
যদিও ২৬ জুলাইপাকিস্তান এই যুদ্ধের দায় কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর চাপিয়ে দেয়। সে সময়‘কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই যুদ্ধ চালাচ্ছে’ বলে মুজাহিদিন-এর ওপর দায় চাপাতে চেয়েছিল পাক প্রশাসন। তবে, পরে যখন দু’জন সেনাকে এই যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘নিশান-এ-হায়দার’ প্রদান করা হয়, তখন পাকিস্তানের অংশগ্রহণ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। পাশাপাশি তৎকালীনপাকিস্তান সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ ও পাকিস্তান সেনার লেফটেন্যান্ট জেনেরাল আজিজখানের মধ্যে কথোপকথনের একটি রেকর্ড ভারত সরকার প্রকাশ্যে আনার পর পরিষ্কার হয়ে যায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার বিষয়টি।এদিকে, যুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের ‘অপারেশন তলোয়ার’-এর মাধ্যমে করাচি বন্দরের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে পাকিস্তানের অস্ত্রের ভাঁড়ারে টান পড়ে। পরে, তৎকালীন পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ স্বীকার করেছিলেন, তাঁদের কাছে আর ছ’দিনের মতো জ্বালানি তেল ছিল যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো।
যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন ৫০০-র বেশি ভারতীয় জওয়ান। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাইফেলম্যান সঞ্জয় কুমার, গ্রেনেডিয়ার যোগেন্দ্রসিং যাদব, ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা, ক্যাপ্টেন মনোজকুমার পান্ডে, ক্যাপ্টেন অনুজ নায়ার, ক্যাপ্টেন এন কেনগুরুসে, লেফটেন্যান্ট কেইশিং ক্লিফোর্ড ননগ্রাম, সেনাপ্রধান পদ্মপানি আচার্য, সেনাপ্রধান রাজেশ সিংঅধিকারী, কর্নেল সোনাম ওয়াংচুক, সেনাপ্রধান বিবেক গুপ্তাসহ আরও অনেকে। জখম হন ভারতীয সেনাবাহিনীর ১৩০০-রও বেশি জওয়ান। পাশাপাশি যুদ্ধে মোট ৪৫৩ জন পাকিস্তানি সেনার মৃত্যু হয়। যুদ্ধবন্দির সংখ্যা ৮ জন। এই যুদ্ধে পাকিস্তান প্রায় ৫ হাজার সেনা পাঠায়। যুদ্ধ চলাকালীন দু’টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে নামিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আরও একটি ভেঙে পড়েছিল মাটিতে।
১৯৯৯ সালের ‘কারগিল যুদ্ধ’ গোটা বিশ্বে ধিকৃত হয়েছে পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতার চরম নিদর্শন হিসাবে। কারণ, সংঘর্ষের মাত্র মাস দু’য়েক আগেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি লাহোর সফরে গিয়েছিলেন।পাশাপাশি শীতে কাশ্মীর সীমান্তের কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি নেমে যায়। ছাউনি ছেড়ে সেনারা সরে আসে। সেটা মাথায় রেখে প্রতিবেশী এই দু’দেশের মধ্যেই ছিল একটি অলিখিত চুক্তি,ওই অঞ্চলেশীতের সময়কোনওরকম সামরিক কার্যকলাপ চলবে না। অথচ শুকনো শীতের ওই নিষ্ক্রিয় সময়েই শুরু হয়েছিল পাকিস্তানি অনুপ্রবেশ। পরে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেছিলেন, তিনি নাকি কিছুই জানতেন না, এবং সব পরিকল্পনার রচয়িতা ছিলেন সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ! এই দোষারোপে অবশ্য মুশারফ মোটেও গুরুত্ব দেননি। উলটে শরিফের দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, পাক প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছিল এই পরিকল্পনার কথা।
কারগিল যুদ্ধের সময় ভারত-পাক দু’টি দেশই সমৃদ্ধ ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের দিক থেকে। ১৯৭১-এর ‘মুক্তিযুদ্ধ’-র পর থেকে দীর্ঘকালীন শান্তি বজায় থাকলেও ১৯৯৮-এর মে মাসে ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশেরই পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পটভূমিকা রচিত হতে থাকে। যদিও, ১৯৭৪ সালের ১৮ মেসকাল আটটা পাঁচ মিনিটে পোখরানে ভারত প্রথম পারমাণবিক বোমা (স্মাইলিং বুদ্ধ)পরীক্ষা করে।
ভারতের ইতিহাসে কারগিল একমাত্র যুদ্ধ যা ভারতীয় বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে ‘লাইভ’ দেখানো হয়েছিল। ‘কারগিল ওয়ার’ নামে পরিচিত হলেও, আসলে ‘কারগিল কনফ্লিক্ট’ নামেই এর সূত্রপাত ঘটে।
বলিদান ও অপার সাহসী সম্মানিত ভারতের বীর জওয়ানরা:
জীবিতকালীন সম্মান: গ্রেনেডিয়ার যোগেন্দ্র সিং যাদব (পরমবীর চক্র), রাইফেলম্যান সঞ্জয় কুমার (পরমবীর চক্র), কর্নেল ম্যাগড বাসাপ্পা রবীন্দ্রনাথ (বীর চক্র), নায়েক দীগেন্দ্র কুমার (মহাবীর চক্র)।
মরণোত্তর সম্মান: লেফটেন্যান্ট মনোজ কুমার পাণ্ডে, ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা, ক্যাপ্টেন অনুজ নায়ার(মহাবীর চক্র), মেজর রাজেশ সিং অধিকারী, মেজর মরিয়াপ্পন সারাভনন (বীর চক্র), স্কোয়াড্রন লিডার অজয় আহুজা (বীর চক্র), হাবিলদার চুনিলাল (বীর চক্র ও অশোক চক্র)।