এলাহাবাদের নাম পরিবর্তন করে প্রয়াগরাজ রাখার সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তবে সে বিষয় স্বাভাবিক ভাবেই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছে নানা মতামত
এলাহাবাদের নাম পরিবর্তন করে প্রয়াগরাজ রাখার সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ| কেন প্রয়াগরাজ তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন যোগী। তাঁর মতে, দু’টি নদীর সঙ্গমস্থলকে প্রয়াগ বলে। সে ক্ষেত্রে ইলাহাবাদে তিনটি নদীর সঙ্গম হয়েছে— গঙ্গা, যমুনা এবং অন্তঃসলিলা সরস্বতী। কাজেই ইলাহাবাদকে প্রয়াগরাজ বলাই যায় রাজ্যপাল এলাহাবাদের নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সম্মতিও জানিয়েছেন| কিন্তু, এই নাম পরিবর্তন নিয়ে উত্তর প্রদেশ সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হন এক আবেদনকারী| এলাহাবাদের নাম প্রয়াগরাজ করার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে করা আর্জি খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট| সমস্ত সরকারি দফতরের সাইনবোর্ডে শহরের নাম পরিবর্তনের কাজ প্রায় শেষ| কুম্ভমেলার আগেই এলাহাবাদের নাম পরিবর্তন করে পুরোপুরি রাখা হবে প্রয়াগরাজ| এর পাশাপাশি, ফৈজাবাদের নাম অযোধ্যা এবং আমদাবাদের নাম অমরাবতী রাখতে চায় দুই রাজ্যের সরকার। এই নামবদলের সিদ্ধান্ত নিয়েই এই বিতর্ক| (সঙ্গে সাজেস্টেড: এলাহাবাদের ছবি) এই অংশটা স্ক্রিন করে দিলে ভাল হয়|
——— ‘ইতিহাসে তো প্রয়াগই এর নাম ছিল’
জয়ন্ত রায়
জাতীয় অধ্যাপক, অবৈতনিক সম্পাদক- সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ইন্ডো-বাংলাদেশ রিসার্চ
ব্রিটিশরা অনেক সময় ভাষাগত জটিলতা এড়াতে এদেশের অনেক জায়গার নাম নিজেদের ইচ্ছেমত দিয়েছিল। সেগুলির পরিবর্তন হয়েছে একে একে। কালীক্ষেত্র, সুতানুটি, গোবিন্দপুর কেন এক হয়ে ক্যালকাটা হবে? কালীক্ষেত্র হলে খুব একটা বলার কিছু থাকত না। তুলনীয়ভাবে ইলাহাবাদের নামকরণের উৎস নিয়েও আপত্তির কারণ রয়েছে। অনেকে জানেন, ইতিহাসে তো প্রয়াগই এর নাম ছিল।
আমদাবাদের নাম বদল করার পক্ষেও যুক্তি আছে।
চালুক্য বংশের রাজা কর্ণদেও ভিল রাজাকে হারিয়ে সাবরমতী নদীর তীরে কর্ণাবতী শহর তৈরি করেছিলেন। তার অনেক পরে কর্ণাবতীর পাশে সুলতান আহমেদ শাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমদাবাদ। আর, অযোধ্যা আমাদের গর্ব। অতীতকে জুড়তে ফৈজাবাদের বদলে এর নাম অযোধ্যা হওয়া উচিত।
কেবল এ দেশে নয়, প্রয়োজনে বিদেশেও স্থাননামের বদল হয়েজে। পেট্রোগ্রাড থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ। এই শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পিটার দি গ্রেটের নাম। ওঁরা বলেন ‘পেট্রা ওয়ান’। আবশ্যিক না হলেও ওঁর সম্পর্কে দু-চার কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। অসাধারণ দূরদর্শী এবং যুদ্ধবিদ্যা থেকে নৌকোনির্মাণ— বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ছিলেন। তিনি ফরমান জারি করেন, কোনও বাড়ির উচ্চতা সংলগ্ন রাস্তার প্রস্থের চেয়ে উঁচু হবে না। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
যাই হোক, ছোট্ট করে বলতে পারি ইলাহাবাদ হোক বা মোঘলসরাই, ফৈজাবাদ, আমদাবাদ— প্রতিটি নামবদলেই আমার সায় আছে। আমি যুক্তিসঙ্গত মনে করি।
———
‘রাজা পাল্টে গেলে জায়গার নামও পাল্টে যাবে?
সনাতন পাঠক
সমাজকর্মী
উত্তরপ্রদেশ সরকার এ বার ইলাহাবাদ শহরের নাম বদলে প্রয়াগরাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে কিছু দিন আগে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে মুঘলসরাই স্টেশনের নাম পরিবর্তিত হয়েছে।
দীনদয়াল উপাধ্যায় নিঃসন্দেহে এক জন যুগপুরুষ। তবে তাঁকে সম্মানিত করতে, স্মরণীয় করে রাখতে নতুন কিছু মহৎ নির্মাণ তাঁর নামে অঙ্কিত হতে পারত। মুঘলসরাই স্বাভাবিক ভাবে, কালের প্রবাহে সৃষ্ট একটি নাম। কোনও ব্যক্তি তাঁর কীর্তি, নাম বা অন্য কিছু অক্ষয় করে রাখতে এই স্থানের এই নামকরণ করেননি। ইতিহাস তাকে এই নাম দিয়েছে।
একই ভাবে প্রয়াগও একটি কালজয়ী নাম। ভারতীয় সভ্যতার সমবয়স্ক প্রয়াগ হর্ষবর্ধনের সময় ছিল একটি আলোকোজ্জ্বল নগরী। প্রয়াগের মেলা ছিল তাঁর বাৎসরিক দানক্ষেত্র। এখনও ভারতের বহু মানুষ ব্যাপক ভাবে একে তার পুরনো নামেই চেনেন।
আরোপিত ইলাহাবাদ নাম একে মুছে দিতে পারেনি।
তিন হাজার বছর বয়সি ‘কাশী’কে (বারাণসী) যেমন মুছে দিতে পারেনি তার আকবরাবাদ নাম। ঐতিহ্য ও সময়ের কাছে হার মেনেছে ব্যক্তি। সময়ের গতি কলকাতাকে কলকাতা নাম দিয়েছে, দিল্লিকে দিল্লি। চেষ্টা করেও কলকাতাকে আলিনগর করা যায়নি। দিল্লিকে করা যায়নি শাহজাহানাবাদ। এলাহাবাদ নামটি আল্লাহবাদ (Allahabad) কথাটি থেকে এসেছে। ভারতের মুসলমান যুগে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু এ নাম উচ্চারণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। দু’প্রান্ত বজায় রাখতে একে ডাকতেন ইলাহাবাদ বলে। রাজা পাল্টে গেলে বা সরকার পাল্টে গেলে জায়গার নামও পাল্টে যাবে, এ কোনও কাজের কথা নয়। প্রয়াগের ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টি আলাদা।
ঠিক এভাবেই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে আমদাবাদ ও ফৈজাবাদের নাম।
(ঋণ— আনন্দবাজার পত্রিকা)
‘একেবারে মেনে নিতে পারছি না’
পবিত্র সরকার
শিক্ষাবিদ, প্রাক্তন উপাচার্য
ইলাহাবাদের নাম বদল একেবারে মেনে নিতে পারছি না। মুঘল সম্রাট আকবর নাম রেখেছিলেন ‘ইলাহাবাদ’। যতদূর ইতিহাস জানি, আকবর নিজে মুসলিম হয়েও হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেননা। সব জাতি ধর্মের মানুষই তাঁর কাছে সমান গুরুত্ব পেত। হিন্দুদের জন্য কর প্রথাও তিনি শিথিল করেছিলেন। ‘ জিজিয়া’ করের কথা আমরা যারা অল্প বিস্তর ইতিহাস পড়েছি জানি। আকবর যে সর্ব ধর্মের সমন্বয়ে ‘দীন -ই – ইলাহি’ নামে একটি ধর্মমত প্রচলন করেছিলেন, তাও ভারতবাসীর কাছে অজানা নয়। আর এই ‘দীন ই ইলাহি’ থেকেই ইলাহাবাদ নামকরণ হয়।। এর মধ্যে খারাপ কি ছিল?
শামিম আহমেদ লিখেছেন, ইলাহাবাদ শহরের পত্তন করেছিলেন মহামতি আকবর। কেল্লা বানান সেখানে, সেই সৌধ এখন সামরিক বিভাগের অধীনে। গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমের তীরে অক্ষয়বটের পাশে এই কেল্লা। শোনা যায়, মুমুক্ষু মানুষরা এখানে আত্মহত্যা করতেন। আকবর সেই স্ববধ রোধে এই কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন। স্থানীয় লোকজন কিসসা বলে থাকেন, সম্রাট আকবর তাঁর পূর্বজন্মে ধার্মিক হিন্দু ছিলেন, তখন তাঁর নাম ছিল মুকুন্দ ব্রহ্মচারী। একদা ভ্রান্তিবশত গোদুগ্ধ পানকালে একটি গোকেশ তাঁর উদরে চলে গেলে তিনি পাপভয়ে আত্মহত্যা করেন। পরজন্মে মুকুন্দ আকবর হয়ে জন্মান ও সঙ্গমস্থলে আত্মহত্যা নিবারণে সচেষ্ট হন। সেই সময় কেল্লা নির্মাণেও বার বার ব্যর্থ হচ্ছিলেন সম্রাট আকবর। স্থানীয় এক ব্রাহ্মণ তাঁকে কেল্লা নির্মাণে সাহায্য করলে ওই ব্রাহ্মণদের উত্তরপুরুষদের তিনি ‘প্রয়াগবাল’ ব্রাহ্মণ উপাধি দিয়ে সঙ্গমে পূজা-আর্চার নিরঙ্কুশ অধিকার প্রদান করেন।
আল্লার নামের সঙ্গে এই জায়গার নাম যুক্ত। এ কারণেই কি একশ্রেণির লোকের কাছে স্থাননাম বদলের প্রয়োজন মনে হল? আমি নিজে নাস্তিক। কিন্তু অজস্র মানুষের ধর্মে মতি আছে। তা সে যে ধর্মই হোক। তাঁদের আবেগে আঘাত যাতে না আসে, সেটা শাসকদের ভাবা উচিত।
এ কারণেই তাজমহলের নামবদলের যে ভাবনা, তারও বিরোধিতা করব আমি। ইতিহাস জোর করে বদলানোর এই চেষ্টাকে ধিক্কার দেব। নতুন কিছু বা কোনও প্রকল্পের নাম সরকার পছন্দের কারও নামে চিহ্ণিত করতেই পারেন। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা।
পৃথিবীর নানা দেশেই জায়গার নাম বদলিয়েছে। এখানেও ক্যালকাটা হয়েছে কলকাতা। এ সবের সঙ্গে ধর্মের যোগ নেই। আর, ধর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে বলেই ইলাহাবাদের নাম বদলে আমার আপত্তি।
এ ভাবেই, অনেকে অভিযোগ করছেন যোগী সরকার রাম-রাজনীতিকে উস্কে দিতে ফৈজাবাদের নাম বদলে দিচ্ছেন। জোর করে গুজরাত সরকার আমদাবাদের নাম বদলে দিচ্ছেন। আমি নিজেও এই সব অভিযোগ সঠিক বলে মনে করছি। এতে বিজেপি-র মুসলিম বিরোধী মনোভাব ফুটে উঠছে।
‘হিন্দু ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে চেঁচামেচি?‘
অচিন্ত্য বিশ্বাস
শিক্ষাবিদ, প্রাক্তন উপাচার্য
ইলাহাবাদের নামবদলের প্রতিবাদে যাঁরা সরব হয়েছেন, আমি তাঁদের দলে নই। কখনও কখনও কিছু স্থাননাম ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন হয়ে ওঠে। রুশ বিপ্লবের পরে সেন্ট পিটার্সবার্গের নাম লেনিনগ্রাড হয়। এই ঘটনা তো সামাজিক বিষয়ের সঙ্গে সংপৃক্ত নয়! দীর্ঘদিন পড়ে থাকার পর সেখানকার মূল গির্জা প্রদর্শশালায় পরিণত হল। এর পর স্বস্থানে ফিরিয়ে আনা হল এর পুরণো ঐতিহ্যকে।
আসুন দেখা যাক মোঘলসরাইয়ের নামবদলে। মোঘলরা যেখানে সরাই করত, সেখানকার আগের নাম কী ছিল? এই প্রশ্নটা কেন মনে জাগবে না? ওই অঞ্চলে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল দীনদয়াল উপাধ্যায়কে। কোনও তদন্ত হল না সেই ঘটনার। যদি পরবর্তীকালে ওই স্থানের নামকরণ তাঁর স্মরণে হয়, সেটা তো অবশ্যই একটা ঐতিহ্যের ইঙ্গিতবহ!
আর, প্রয়াগরাজ নামটা আমরা হর্ষবর্ধনের আমলেও পেয়েছি। মহাভারতে ‘তীর্থদর্শণ’ পর্বাধ্যায়ে এই নাম আছে। পরে, আকবর বাদশার ইচ্ছেয় নাম বদল হল। অনেকটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বলুন তো, কেন নালন্দার সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশনের নাম বক্তিয়ারপুর হবে? বক্তিয়ার খিলজী তো প্রায় তিন মাস ধরে নালন্দা ধ্বংশ করেছিলেন। ওই স্টেশনের নাম রাহুল সাংকৃত্যায়ন অথবা অতীশ দীপঙ্করের নামে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়? কেন ফৈজাবাদের নাম অযোধ্যা বা আমদাবাদের নাম কর্ণাবতী হবে না? ধারাবাহিকতা বলে একটা সত্য রয়েছে তো!
ম্যাড্রাস থেকে চেন্নাই, ক্যালকাটা থেকে কলকাতা, বোম্বে থেকে মুম্বাই— এ রকম নামবদলের অনেক উদাহরণ আছে এ দেশে। কোথায়, তখন তো চেঁচামেচি হয়নি! আর এখন হচ্ছে হিন্দু ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে? এখনকার যে বুদ্ধিজীবী মহল সরব হয়েছে ইলাহাবাদ, ফৈজাবাদ, আমদাবাদের নাম বদল নিয়ে, তাদের আসল স্বরূপ প্রকাশ পাচ্ছে। ওঁদের অবস্থা একচক্ষু হরিণের মত।
———
‘৭০ বছর আগেই এই সব পরিবর্তন দরকার ছিল’
‘সস্তা জনপ্রিয় হিন্দু জাতিয়তাবাদের খাস্তা রাজনীতি’
নামকরণ বা নামবদল বিতর্কে সরগরম হয়ে উঠছে দেশের বাজার। দেশের শাসকের কণ্ঠে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র বেসুরো কোরাসে ঝালাপালা হওয়া কানে ঢুকছে এখন সস্তা জনপ্রিয় হিন্দু জাতিয়তাবাদের খাস্তা রাজনীতির স্তোকবাক্য। প্রতিষ্ঠানের নাম, প্রকল্পের নাম, পরিষেবার নাম , স্টেশনের নাম সবেতেই নামবদলের সরকারি হিড়িক শাসক দলের উদ্যোগে। আর এ সবই শুরু হয়েছে ওই সস্তা জনপ্রিয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রচার পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই।
আজ থেকে তিনশো কুড়ি বছর আগে শেক্সপিয়র লিখেছিলেন ‘ হোয়াট’স ইন এ নেম ?’ নামে কি আসে যায়? ‘ গোলাপকে যে নামেই ডাকো তার গন্ধ একই রকম থাকে।’ এই সংলাপ ছিল প্রেমের সম্পর্ক ব্যাখ্যার জন্য। কিন্তু আজকের ভারতে ঘৃণার সম্পর্ক ব্যাখ্যার জন্য নামেই যে অনেক কিছু যায় আসে তা প্রতি দিন টের পাচ্ছে দেশের মানুষ । ধর্মের বিভাজন , জাতের বিভাজন, লিঙ্গের বিভাজনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর অস্ত্র হয়ে দাড়িয়েছে নামের শ্রেণিবিন্যাস আর পদবির উপাখ্যান। এ সব চালু সামাজিক উপদ্রবের সঙ্গে এখন নতুন করে যোগ হচ্ছে রাজনৈতিক বিভাজনের নতুন অধ্যায়।
রাজনৈতিক কারণে রাস্তার নাম, প্রদেশ বা জেলার নাম, প্রকল্পের নাম এ দেশে পরিবর্তিত হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই বার বার। কিন্তু হাল আমলের নামকরণ আর নামবদলের আড়ালে বিভাজনের রাজনীতির প্রয়োগে যে ভাবে জাতীয়তাবাদের ধারণাকে বিকৃত করা হচ্ছে , সেই ধারণার পুননির্মাণের চেষ্টা হচ্ছে তা এক কথায় নজিরবিহীন।
এ দেশে উত্তরপ্রদেশকে ভারতীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়। সেই উত্তরপ্রদেশ আজও কেন্দ্রের সরকারের শক্তিশেল। সে রাজ্যের সরকার বিপুল সংখাধিক্যে চালানোর দায়িত্ব পেয়েছেনন ‘গেরুয়া সন্ন্যাসী’ যোগী আদিত্যানাথের নেতৃত্বের পদ্মশিবির। ফলে সেই রাজ্যের শাসকের রণনীতি বা রণকৌশল স্বাভাবিক কারনেই দেশের মানুষের চোখের বিশেষ কৌতূহলের বিষয়বস্তু । সম্প্রতি সেই রাজ্য সরকার সে রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন শহর এলাহাবাদের নাম পরিবর্তন করে ‘প্রয়াগ রাজ’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তি হিসেবে হাজির করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তি হিসেবে হাজির করা হচ্ছে পাঁচশো বছর আগে সম্রাট আকবর ক্ষমতার জোরে প্রয়াগরাজ নাম পাল্টিয়ে রাখে ইলাহাবাদ। ফলে এখন বদলার পালা নামবদলের মধ্যে দিয়ে।
এর পক্ষে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ গেরুয়া পন্ডিতরা পেশ করতে পারেননি। ইতিহাস বলে সম্রাট আকবরের দীন ইলাহি ধর্মভাবনা দানা বাঁধার সময় ইলাহাবাদ শহরের নামকরণ হয়। ইলাহাবাদ শব্দের পোশাকি অর্থ হল ‘ ঈশ্বরের আবাস’। তর্কের খাতিরে যদি ধরাও যায় যে ক্ষমতার জোরে সম্রাট আকবর ওই নাম পরিবর্তন করেছিলেন তবে আজও কি যোগী আদিত্যনাথরা জনমত যাচাই না করেই ক্ষমতার জোরে সেই ‘ঐতিহাসিক ত্রুটি সংশোধন’- এর পথে হাঁটছেন না ? একই কথা প্রযোজ্য ফৈজাবাদ ও আহমেদাবাদের নাম বদলের প্রক্রিয়া নিয়ে। এই বদলে পক্ষে জনমত হিসেবে তাঁরা তুলে ধরছেন তাঁদের নির্বাচনী সাফল্যকে। ভুলে যাচ্ছেন , যে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই রাজ্যে কৃষি-শিল্প-কর্মসংস্থান, শিশুমৃত্যু থেকে আইন শৃঙ্খলা- সবই বিপর্যয়ের ইঙ্গিত বহন করছে|
(ঋণ— এই সময়)
———
মোহিত রায়
অধ্যাপক
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যখন ভারতবর্ষ হিন্দু মুসলমান দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হলো তার পরদিন থেকেই ইসলামী শাসনের সব আগ্রাসনের প্রতীকগুলিকে অপসারণের কাজ শুরু করা উচিত ছিল। সেটা শুরুও হয়েছিল। জওহরলাল নেহেরুর আপত্তি সত্ত্বেও মসজিদের ভগ্নাবশেষ সরিয়ে সোমনাথ মন্দির গড়ে তুলেছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেহত্যাগ করেন বল্লভভাই প্যাটেল।
এর পরে শুরু হয়ে গেল ধর্মনিরপেক্ষ নেহেরু রাজ। বামপন্থী ঐতিহাসিকদের বিকৃত ইতিহাস দখল করল ভারতীয় অধ্যয়ন জগৎ। সমস্ত ইসলামী আগ্রাসনের তথ্যকে মুছে দিয়ে ভারত ভাবনাটাই হয়ে উঠল ব্যাঙ্গের বিষয়, অ্যাকাডেমিক জগতে ভারতবর্ষর নাম পরিবর্তন করে তাঁরা করে দিলেন সাউথ এশিয়া। আমরা কলকাতায় ব্রিটিশ গভর্নরদের স্মরণে চিহ্ণিত রাস্তার নামগুলি পাল্টিয়ে দিলাম। সরিয়ে দেওয়া হল ব্রিটিশ শাসকদের মূর্তিগুলি। এ ভারতের সব শহরেই হল।
কলকাতায় নাথ সম্প্রদায়ের পূজ্য গুরু চৌরঙ্গিনাথের নামের রাস্তা পাল্টে হল জওহরলাল নেহেরু রোড, ঐতিহ্যবাহী ধর্মতলা হয়ে গেল লেনিন সরনী। কেউ তখন বলে নি ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে। আর আমরা ৯০ লক্ষ বই পুড়িয়ে নালন্দার বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসকারী বখতিয়ার খিলজির নামে স্থান আজও রক্ষা করে চলেছি। কেন্দ্রে বা রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে— এমন
কোনও রাজনৈতিক দল এই পরিবর্তনের কাজ করার সাহস দেখায় নি।
নতুন তৈরী শহরের নাম যা কিছু হতে পারে। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় স্থাননাম বিদেশী আগ্রাসী শক্তি পাল্টিয়ে দেবে তা সহনশীলতা, ধর্মনিরপেক্ষতা , উদারতা এসব বলে মেনে নেওয়া যায় না। এ জিনিস আত্মসম্মানহীনতা, কাপুরুষতা ছাড়া আর কিছু নয়। গঙ্গা যমুনা সরস্বতীর মিলনস্থল প্রয়াগকে ইলাহাবাদ নামকরণ করা একটি সংস্কৃতি হত্যার সমান। হিন্দুর পুণ্য স্থানকে আল্লার নামে নামকরণ একটি জঘন্য অপরাধ।
যা ভারতের সব বিখ্যাত নেতারা পারেন নি, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সেই পুণ্য নাম প্রয়াগরাজ ফিরিয়ে এনে ভারতীয় সংস্কৃতির পুনঃস্থাপনের পথে একটি মহান পদক্ষেপ নিলেন। আমরা মাদ্রাজকে চেন্নাই করেছি, ত্রিবান্দ্রম কে তিরুপুরন্তপুরম করেছি – কেউ কিছু বলে নি। আজ ইলাহাবাদের নাম পরিবর্তনে এত প্রতিবাদ হবার কারণ ইসলামী মৌলবাদী সমর্থক সেকুলার-বাম -কংগ্রেসি সাংস্কৃতিক পরিবেশকে বদলে দেবার কাজ শুরু হয়েছে। এটা সভ্যতার সংঘাত, যা সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়েছে। প্রয়াগরাজ নামের সঙ্গে যুক্ত পশ্চিমবঙ্গের ত্রিবেণী। এখান থেকে আবার বইছে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী। খুব ভাল লাগছে ইতিহাসের তাগিদে ফৈজাবাদ আর আমদাবাদকে যথাক্রমে অযোধ্যা আর কর্ণাবতী করার প্রক্রিয়ায়। আরও আগে এগুলি হওয়া দরকার ছিল
খ্যাতনামা লেখক গোলাম মুর্তাজা তাঁর “হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি” বইয়ে লিখছেন – ১২৯৮ সালে ত্রিবেনীতে হিন্দু মন্দির ভেঙে তৈরী হয় বিরাট মসজিদ। তার গায়ে গর্ব করে লেখা আছে কিভাবে কাফেরদের বিনাশ করা হয়েছে। শুধু স্থান নাম নয় এই ধরণের মসজিদেরও পরিবর্তন চাই। আসুন এক মুক্ত আত্মসম্মানের সমাজ গড়তে এই পরিবর্তনে যোগ দিই।