বর্হিরবঙ্গ বাঁচলে, বাংলা ভাষা বাঁচবে

7 - মিনিট |

“যতদূর বাংলা ভাষা, তত দূর বাংলাদেশ।“— মহম্মদ নূরুল হুদা
যুগে যুগে বহির্বঙ্গের বাঙালিরা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। পুষ্ট করেছে বাংলার ইতিহাস। প্রচুর বাংলা বই প্রকাশ করেছেন প্রবাসের এই বাঙালিরা। আজ প্রায় সবটাই ইতিহাসের গর্ভে।

সম্রাট গুপ্ত

ইলাহাবাদ থেকে এক সময় বার হত প্রবাসী। বারানসী থেকে বার হত সুরেশ চক্রবর্তীর উত্তরা।কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে কানপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। এর প্রথম অধিবেশন হয়েছিল ১৯২৩ সালের ৩-৪ মার্চ বারাণসীতে। উদ্যোক্তা ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন, সুরেন্দ্রনাথ সেন, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। দ্বিতীয় অধিবেশন হয় ইলাহাবাদে ওই বছরের শেষে, ২৬-২৭ ডিসেম্বর। তার সভাপতি ছিলেন প্রমথনাথ তর্কভূষণ। প্রথম দুটি অধিবেশনের সময় সংস্থার নাম ছিল ‘উত্তর ভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন’। এর পর তৃতীয় থেকে অষ্টবিংশতি অধিবেশন (১৯২৫’৫২) পর্যন্ত সংস্থার নাম ছিল ‘প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন’। ‘প্রবাসী’ শব্দে অনেকের আপত্তি থাকায় জয়পুরে অনুষ্ঠিত ঊনত্রিংশ অধিবেশনে এর নতুন নাম হয় ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’। এই নামেই সংস্থাটি ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে শাখা স্থাপন ও বার্ষিক অধিবেশন করে আসছে। মূল উদ্দেশ্য বহির্বঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রসারে সহায়তা।

বিলেত থেকে ব্যারিষ্টারি পাশ করে অতুল প্রসাদ সেন প্রথমে কলকাতা ও রংপুরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এর পর তিনি লখনউতে চলে যান। সেখানে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং আউধ বার এ্যাসোসিয়েশন ও আউধ বার কাউন্সিলরের সভাপতি হন। লখনউয়ের সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯০২ থেকে আমৃত্যু অতুল প্রসাদ আইন ব্যবসা উপলক্ষে সেখানে কাটান। চুটিয়ে চলে তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চা। সে সময় তাঁর বাংলোতে প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই গানের আসর বসতো। ১৯৩৪ সালের ২৬ আগষ্ট লক্ষ্ণৌয়ে এই মহান ব্যক্তির মৃত্যু হয়।

প্রবাসী বাঙালিদের অনেকে মনে করেন, বাংলা সাহিত্যের সমসাময়িকতা বা কন্টেম্পোরানিইটি কলকাতা বা ঢাকা তো নয়ই এমনকি পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশেও নয়, সারা পৃথিবীতে পরিভাষিত হচ্ছে। ঠিক যেমন ইংরেজি সাহিত্যের। সাহিত্যকর্মকে কখনোই হেয় করা উচিৎ নয়। ‘যা হোক, কষ্ট করে বাংলায় লিখছে তো’ কথাটা শুধুমাত্র বালখিল্যদের জন্য প্রয়োগ করা উচিৎ। মনে রাখা উচিৎ যে ‘বাঙালির মন ও মননের সমসাময়িকতা, তার বীক্ষার সমসাময়িকতা বিশ্বব্যাপী ও মেরুবহুল, এই ধারণাটাকে অনুশীলিত সত্যে ও তথ্যে পরিণত করার চ্যালেঞ্জটা আমাদের।

প্রবাসী বাঙালিদের এই হৃৎপিন্ডগুলির স্পন্দন আজ যেন থেমে গিয়েছে। সমস্যার মাত্রাটা ঠিক কিরকম? এর ওপর ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় ‘যতদূর বাংলা ভাষা’ শীর্ষক এক আলোচনার আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন ছত্তিশগড়ের সমরেন্দ্র বিশ্বাস, ঝাড়খন্ডের দুটি পৃথক শহরের দোলা বাজপেয়ী এবং চন্দ সরকার, ওডিষার দীপক হালদার, মধ্যপ্রদেশের বিশ্বজিৎ বাগচি, উত্তরপ্রদেশের বাপি চক্রবর্তী, দিল্লির দিলীপ ফৌজদার এবং মঞ্জু সরকার, মেঘালয়ের বিশ্বজিৎ নন্দী, ত্রিপুরার শ্যামল ভট্টাচার্য প্রমুখ। জোড়াসাঁকোয় দ্বারকানাথ ঠাকুর মঞ্চে ‘সাগ্নিক’ আয়োজিত আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে হয় এই আলোচনা।

“বহির্বঙ্গ বাঁচলে, বাংলা ভাষা বাঁচবে“— সমাবেশে এই আবেদন জানান ভিন রাজ্যের বাঙালার কিছু সাহিত্যসেবক। এই সঙ্গে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, বহির্বঙ্গের বই ও পত্রিকাকেও বাংলা অকাদেমী পুরষ্কৃত করুক। কারণ, বহির্বঙ্গে বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা আগের চেয়ে কমে গেলেও এখনও হচ্ছে। অনুপ্রেরণা বা স্বীকৃতি বহির্বঙ্গের বাংলা চর্চাকে উজ্জীবিত করবে।

কী বলছেন প্রবাসী বাঙালি সাহিত্যসেবীরা? সভায় অংশগ্রহণকারীদের অনেকে স্থানীয় পত্রিার সম্পাদক। ‘সহস্র বাধা উপেক্ষা করে‘ পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন। যাঁরা তা করছেন না, নিয়মিত সাহিত্যসভা বা চর্চা করেন। ‘ডায়াস্পোরা’-র কথা উল্লেখ করে তাঁরা ওই দিন অনুযোগ করেন, বাংলা সাহিত্যচর্চা ক্রমেই কলকাতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।

‘যতদূর বাংলা ভাষা’ শীর্ষক আলোচনায় ছত্তিশগড়ের ভিলাইয়ের বাসিন্দা সমরেন্দ্র বিশ্বাসের

কথায়, ২০ বছর আগে পান্ডুলিপি নিয়ে কলকাতায় আসতাম। তখন বয়স ছিল কম। পাঠক ছিল বেশি। এখন ইন্টারনেটের দৌলতে বিশ্ব এসে গিয়েছে হাতের মুঠোয়। কিন্তু আমার সেই পাঠককূল আর নেই। বাঙালি যাঁরা আছেন, পুরুষানুক্রমে চর্চার অভাবে পড়তে-লিখতে পারেননা। পাঠক আর পৃষ্ঠপোষক ছাড়া বাংলা চর্চা হবে কী করে?

‘প্রবাসী বাঙালির বাংলা’-তে (ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৭)

আইভি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “বাংলা ও বাঙালির জাত্যাভিমান প্রসঙ্গে প্রথমে একটু ব্যক্তিগত কথা। সম্প্রতি ঝাড়খণ্ড রাজ্য সরকার বাংলাকে দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিক ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। ২০০০ সালের ১৫ই নভেম্বর বিহার থেকে আলাদা করে ঝাড়খণ্ড নতুন রাজ্য ঘোষণার পর থেকেই বাংলাকে দ্বিতীয় রাজভাষা করার দাবি ওঠে। মাতৃভাষা প্রসারের উদ্যোগে যখন বাংলা আরো এগারোটি ভাষার সঙ্গে দ্বিতীয় রাজভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল, সে যে কী আনন্দের ক্ষণ! আমরা ঝাড়খণ্ডবাসী বাঙালিমাত্রেই সে আনন্দ অনুভব করেছি । কারণ আমরা জানি, ভাষা তথা মাতৃভাষা ভাব-বিনিময়, ভাবনা বিনিময়ের সহজতম উপায়। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী হয়তো বলবেন উৎপাদন সম্পর্কের কথা, আমি এর সঙ্গে যোগ করতে চাই শিক্ষাসহ জীবন ও জীবিকার সঙ্গে, কাজের সঙ্গে ভাষার সম্পর্কের কথা। একটি জাতির গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলেই একটি জাতির মাতৃভাষা জাতীয়ভাষা (রাজভাষা) হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত।

যে কোনো ভাষা আন্দোলন জাত্যাভিমান ও স্বাতন্ত্র্যবোধকে নাড়া দেয়। স্বাধিকার অর্জনের স্পৃহাও জেগে ওঠে। খুব সামান্য দাবি নিয়ে, ঝাড়খণ্ডে বাংলা ভাষায় পর্যাপ্ত বই সরবরাহ এবং শিক্ষক নিয়োগের জন্য আন্দোলন শুরু। বাংলা নিয়ে টানাপোড়েনে ঝাড়খণ্ডবাসী হিসেবে বাঙালি ও ভিনজাতিদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কতখানি তীব্র হয়েছিল, সে অভিজ্ঞতা হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, ভাষার জন্যে আবেগে সামান্য হলেও বিদ্বেষের বীজ বপন হয়েছে। অবশ্য বিদ্বেষের বীজ অঙ্কুরিত না হলে হয়ত বাঙালির এথনিক আইডেন্টিটি এমন প্রবল হয়েও উঠত না” (‘বিহার হেরাল্ড‘)।

সেই জামশেদপুরের আর এক বাংলাপ্রেমী দোলা বাজপেয়ী জোড়াসাঁকোয় বলেন, সঞ্চিত অর্থে সুর ও সাহিত্যাঙ্গন নামে একটি প্রতিষ্ঠান চলাই। প্রতি মাসে একটা করে সাহিত্যসভা করি। প্রতিটায় একটা করে থিম। কিন্তু সমস্যা হল, নবীন প্রজন্ম আর বাংলা শিখছে না। আমার ছেলে এখানকার একটা নামী স্কুলের টপার। ওকে ইংরেজির জোয়ারে ভেসে যেতে দিইনি। ছেলেবেলা থেকে ওকে বোঝানো এবং অনুভব করানোর চেষ্টা করেছি বাংলা আমার প্রাণের ভাষা। এ ব্যপারে অবশ্য আমার স্বামী সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের অবদান অনেকটা। ঘরের অন্দর থেকে যদি নবীন প্রজন্মকে বাংলা শেখানোয় আগ্রহী না করানো হয়, এই ভাষা বাঁচবে না। বহির্বঙ্গের সবাইকে এই সরল সত্যটা অন্তরে লালন করতে হবে। সবাই যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।

ঝাড়খন্ডের একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক চন্দন সরকার বলেন, এক সময় মানভূম জেলায় সিংহভাগ ছিলেন বাঙালি। ১৯৫৬ সালে এই জেলা দু‘টুকড়ো হয়ে যায়। এক ভাগ থাকে পশ্চিমবঙ্গে, মানে পুরুলিয়ায়। অপর ভাগ বিহারের ধানবাদ। এখন আর আগের মত বাঙালি নেই। এখানকার কোনও স্কুলে কোনও বাঙলা পড়ানো হয় না। বেশ ক’বছর ধরে বাংলা বই নেই। কয়েকজন মিলে এখানকার উপযোগী বাংলা পাঠ্যপুস্তক লিখেছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। আর ১০ বছর পরে এখানকার বাংলা-চর্চার কী হাল হবে, ভেবে আমি রীতিমত শঙ্কিত।

স্বদেশ বা স্বভূমি ছেড়ে বাইরে গিয়ে বিদেশে বিভূঁয়ে থাকার, থেকে যাওয়ার সামাজিক প্রবণতা স্বেচ্ছায় নয়, প্রধানতঃ রুজি- রোজগারের বাধ্যতায় দেড়শো বছরেরও আগে থেকে শুরু হয়েছিল। অবিভক্ত ভারতে শুরু হয়েছিল এই অভিনিষ্ক্রমণ। এই মন্তব্য করে বিদ্যুৎ পাল তাঁর ‘বহির্বঙ্গে বাঙালি এবং তার সাহিত্য – বিহার প্রসঙ্গ’-তে লিখেছেন, দেশভাগের পর বাঙালি দুটো দেশের নাগরিক হয়ে যেতে শুরু করল। যেহেতু এ সম্পর্কিত সার্ভেগুলো বেশির ভাগ দেশের নাগরিক হিসেবে; বাঙালি বা বাংলাভাষী হিসেবে নয় তাই সঠিক সংখ্যাগুলো পাওয়া মুশকিল। তবু কিছু হিসেব দিলে বুঝতে পারা যাবে এর প্রকৃতি।

একই সত্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী বা আমাদের এই বিহারবাসী বাঙালিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এবং জীবন- যাপনের বিস্তৃতি থেকে যদি দৃষ্টির ক্ষেত্রটা সীমিত করি মন ও মননে বা আরো ছোটো ক্ষেত্রে, সাহিত্যে বীক্ষা ও সত্ত্বার অভিব্যক্তিতে তখনও আমাদের একশ্রেণীর পণ্ডিত ও তাদের স্পন্সর্ড দৃষ্টিভঙ্গীর বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিতে হয়। তাঁরা প্রকাশ্যে বলেন, সাহিত্য একটাই। বাংলা সাহিত্য। তার আবার ‘ভিতর-বাহির’ ভাগ হতে পারে না। ন্যায্য বলেন! কিন্তু সেই এক ও অখন্ড সাহিত্যের মনোভূমিটা যে বিবিধ! বহুবিধ! প্লুরাল! এমনকি মাল্টিপোলার – মেরুবহুল! এটাও মানুন তাহলে! মানবেন?

আমরা যারা বিহারে বা সাধারণভাবে ভারতের বহির্বঙ্গে বাস করি, ভাষার অধিকারাদি নিয়ে আন্দোলন করি, মাঝে মধ্যেই একটা বক্তব্যের সম্মুখীন হই, “আগে ভাষা বাঁচলে তবে তো সাহিত্য!” বিহারে তো, আমরা যারা বাঙালি সমিতি ইত্যাদিতে রয়েছি, আমাদের সভায়, আলোচনায় আরো তীব্র ভাবে এই কথাটা উঠে আসে। তার কিছু বিশেষ কারণও আছে। বিহারের বাঙালিরা সরকারি মহলে হোক আর বুদ্ধিজীবী মহলে, হুঁকো পান আজও সেই দ্বারভাঙ্গা কে বিভূতিবাবু, ভাগলপুর কে বনফুল আর পুর্ণিয়া কে সতীনাথ ভাদুড়ীর নামে!“

প্রতিবেশী আর এক রাজ্য ওড়িশা থেকে জোড়াসাঁকোর সভায় এসেছিলেন দীপক হালদার। তিনি বলেন, আমি ২০ বছর দিল্লিতে ছিলাম, ১৬ বছর ভুবনেশ্বরে। বহির্বঙ্গে প্রায় সর্বত্র বাংলা ভাষা আকর্ষণ হারাচ্ছে। এ রাজ্যের এক প্রান্ত বালেশ্বর ও অপর প্রান্তের মেদিনীপুরের দুই বাসিন্দা এখনও হয়ত বাংলায় কথা বলেন। কিন্তু বাংলায় চর্চা এবং প্রয়োগ দ্রুত কমে যাচ্ছে। কেন বাংলা সিরিয়ালে হিন্দি গানের প্রভাব থাকবে? নবীব প্রজন্মকে বাংলা ভাষার ব্যাপারে শুরু থেকেই উৎসাহ দিতে হবে। না হলে এই ভাষার বিকাশ করা যাবে না।

মধ্যপ্রদেশের ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বজিৎ বাগচি অনেক দিন ধরে ‘দুর্বাসা’-র সম্পাদনা করছেন। তিনি বলেন, এই এলাকার বারীন ঘোষাল অসাধারণ বাংলা কবিতা লিখতেন। মারা গিয়েছেন। সুবল দত্ত অসাধারণ লেখেন। আগে বিহারে ভূমিকম্প হলে সেই খবর কলকাতার নানা পত্রপত্রিকায় যথেষ্ঠ মাত্রা বা গুরুত্ব পেত। এখন তা হয় না। প্রাণের সেই টান নষ্ট হয়ে গেছে। বাংলা ভাষা এখন এখানে অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে।

তা হলে বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর পথ কি কিছুই নেই? ওড়িশার দীপক হালদার এবং জামশেদপুরের দোলা বাজপেয়ীর মত বিশ্বজিৎবাবুও বলেন, নবীন প্রজন্মকে না টানলে এই ভাষাকে বাঁচানো যাবে না। অভিভাবকদের উদ্যোগী হতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলাভাষায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। আর আমাদের কাঁধে হাত দিয়ে কলকাতার দাদাদের বলতে হবে, আমরা আছি। চল এগোই।

বিশ্বজিৎবাবুর মতই ভিন রাজ্যে বসে বছরের পর বছর বাংলাচর্চা করে যাচ্ছেন উত্তরপ্রদেশের কানপুরের বাপী চক্রবর্তী। প্রবাসী, উত্তরা, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন প্রভৃতি এবং অতুলপ্রসাদ সেন, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়— এঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন বাপীবাবু। বলেন, আগে ২৩-২৪টি বাংলা পত্রিকা বার হত ওখান থেকে। এখনও ১৩ টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ছাপাখানা/বিন্যাস/পৃষ্ঠপোষক— এ সব চাপের কথা জানিয়ে বলেন, এর মধ্যেই আমাদের বাংলা-চর্চার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। অনুবাদের ওপর বাড়তি মনযোগ দেওয়ার আবেদন করেন তিনি।

ক্যান্সারের একটা সদ্য অস্ত্রোপচার সত্বেও বিষয়ের টানে আলোচনায় অংশ নিতে এসেছিলেন

তৈরি করেছেন ‘দিল্লির বাংলা সাহিত্য’ নামে একটি হোয়াটসআপ গ্রুপ। তিনি জানান, আগে আমরা একটা হাটে আড্ডা দিতাম। এ চারণে ‘দিল্লি হাটার্স’ নামে একটি পত্রিকা বার করতে শুরু করি। লেখায় স্থানিকতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা যদি না থাকে, সাম্প্রতিকতা আসবে না। আমি বর্তমান পরিস্থিতি বা পরিবেশে আজকের কথা কীভাবে বলতে বা লিখতে চাইছি, সেটাই মুখ্য। এটা থাকলে বুঝতে পারব আশপাশের মানুষজনের সঙ্গে আমরা কতটা সমমনস্ক, বা পার্থক্য কতটা। কাজের পরিসরটা অনুভব করতে পারব।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল করছেন মঞ্জু সরকার। তাঁর কথায়, আমি মিরান্ডা হাউসে পড়াতাম। দেখেছি পাস বিষয়ের গুরুত্ব কমিয়ে অনার্সের ওপর ক্রমে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। ফলে, পড়াশোনায় কমেছে বাংলার গুরুত্ব। প্রশাসনেও বাংলা কৌলিন্য হারিয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালিরা পারস্পরিক আবেদন করে এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন।

মেঘালয়ের তুরা থেকে বাংলা পত্রিকা ‘মিলন‘ প্রকাশ করেম বিশ্বজিৎ নন্দী। আলোচনাসভায় বলেন, নাট্যসমিতি নামে একটা ক্লাবে নামহীন, হাতে লেখা একটি পত্রিকার হদিশ পেয়েছিলাম। ১৯৫৯ সালে কমল সাহা এখান থেকে প্রকাশ করেন ‘যুগদর্পন‘। এর পর আপনাদের অনেকের মতই পড়ার পয়সা জমিয়ে পত্রিকা প্রকাশ শুরু করি। সমস্যার কথা বলে শেষ করা যাবে না। লেখা পাওয়ার হাজার সমস্যা। চাইতে চাইতে সেটা যদি বা পাওয়া গেল, বানান নিয়ে সমস্যা। তার পর প্রুফ রিডার, ভাল মানের কাগজের সমস্যা, ছাপাখানার সমস্যা। ছেপে বার হল, পড়বেন কে? মানে, পাঠকের সমস্যা। আমার ওখানে ১৫ হাজার বাঙালির বাস। এর মধ্যে চল্লিশোর্ধ হাজার পাঁচেক বাংলা লিখতে-পড়তে পারেন। ৩০০-৩৫০ সংখ্যা ছাপাই। এর মধ্যে সৌজন্যসংখ্যা হয়ত গেল শ দেড়েক। অনেক কষ্টে আরও ১০০ জনকে হয়ত দিতে পারলাম পত্রিকা।

ত্রিপুরার শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, আমি ত্রিপুরা আর অসমকে বাংলার বাইরে বলে মনে করি না। ঐতিহাসিকভাবে এটা বাংলার বাইরে পড়ে গিয়েছে। এই অঞ্চলে অন্তত ১০-১২ জন অবাঙ্গালিকে জানি যাঁরা বাঙলায় লেখেন। তাঁদের সন্তানরাও অনেকে বাংলায় লিখছে। স্থানীয় পরিবেশ থেকে তাঁরা উপাদান সংগ্রহ করে তাঁরা নিজেদের মত করে লিখছেন। বাংলা ভাষা আরও বিকশিত হচ্ছে এভাবে। বাংলা আরও ধনী হয়ে উঠছে ভিন রাজ্যে।

সভার অন্যতম উদ্যোক্তা চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য মঞ্চে বলেন, কে বলতে পারেন বহির্বঙ্গের এই সাহিত্যসেবকদের মধ্যে থেকে আবার আমরা কোনও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা সতীনাথ ভাদুড়িকে পাব কি না। ভিন রাজ্যে অন্তরালে থাকা সাহিত্যিক বা সাহিত্যসেবক খুঁজে বার করতে উদ্যোগী হোক বাংলা অকাদেমী।

আলোচনার সংযোজক তন্ময় বীর বলেন, কাটিহারে মাত্র তিনটি কলেজে বাংলা পড়ানো হত। আগামী বছর থেকে ওখানে আর বাংলা পড়ানো হবে না। কারণ, এবার ওই রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের পর্ষদের শেষ পরীক্ষা। সারা ভারতে যাঁরা বাংলাচর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের দেখুন। কারণ, এঁরা বিস্তৃত বঙ্গের প্রতিনিধি। যদি এই বহির্বঙ্গ স্পন্দিতহয়ে উঠতে পারে, তবেই বেঁচে থাকবে বাংলা ভাষা।

নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশনে

প্রতি বছর নানা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১৪-তে ইলাহাবাদে অনুষ্ঠিত ৮৬ তম অধিবেশনেও দু’টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এক, বহির্বঙ্গের যে রাজ্যে ১০ শতাংশ বাঙালি বসবাস করেন সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে বাংলা বিষয় পঠনপাঠন ও শিক্ষক নিয়োগ করা। দুই, ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে গবেষণা ও পঠনপাঠনের প্রচলন করা। ২০১৪-র অধিবেশন সূচনা করেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। আশা ছিল প্রস্তাবগুলি বাস্তব রূপ পাবে। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related news