রিজার্ভ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্টে প্রকাশ, গত অর্থবর্ষে বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতারণা-জালিয়াতির ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে
সাম্প্রতিক কালে ব্যাংক প্রতারণা কাণ্ড যেমন সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে তেমনি দেশের সাধারণ মানুষ রয়েছে সংশয়ে। উঠছে নানা প্রশ্ন। প্রতুত্তর।
পিএনবি-কাণ্ডে নীরব মোদি এখনও বর্তমান। নীরবের জালিয়াতির অঙ্ক ছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। ভুয়ো লেটার অব আন্ডারটেকিং ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ওই হিরে ব্যবসায়ী সংস্থা।এমন কাণ্ডে নীরবের সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁরই মামা মেহুল চোকসিও। নীরব এখন লন্ডনের জেলে বন্দি। আর মেহুল নাগরিকত্ব নিয়েছেন অ্যান্টিগায়। এখনও উদ্ধার হয়নি সেই বিপুল অঙ্কের টাকা। তার ঠিক দেড় বছরের মাথায় জানা গেল আরও এক ঋণ জালিয়াতির শিকার পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি স্টক এক্সচেঞ্জকে জানায়, ৩,৮০০ কোটিরও বেশি জালিয়াতি হয়েছে। ভূষণ পাওয়ার অ্যান্ড স্টিল অর্থাৎ বিপিএসএল-কে যা দেওয়া হয়েছিল। ব্যাংকের অভিযোগ, সংস্থাটি সেই তহবিলই নয়ছয় করেছে। গোটা বিষয়টি রিজার্ভ ব্যাংককে জানিয়েছিল পিএনবি।
এবার, পিএনবি-র পর জালিয়াতির শিকার পিএমসি! টানা ছ’-সাত বছর রিজার্ভ ব্যাংককে বেকুব বানিয়ে হিসেবে গরমিল দেখিয়ে গিয়েছে পাঞ্জাব-মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাংক। আরবিআই-এর পাশাপাশি ব্যাংকের পরিচালন বোর্ডকে কিছু না জানিয়েই হাউজিং ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড অর্থাৎ এইচডিআইএলের কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণকে নন প্রফিটেবল অ্যাসেট (এনপিএ) হিসেবে দেখাননি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জয় টমাস। আর্থিক সংকটে ভুগছে রিয়েল এস্টেট সংস্থা এইচডিআইএল। পিএমসি-র কাছ থেকে এই সংস্থার দেনা ৪,৩৫৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যোগসাজশে ৪৪টি ঋণ অ্যাকাউন্টকে ২১,০০০টি ভুয়ো অ্যাকাউন্টে বদলানো হয়। চাপা দেওয়া হয় ঋণ খেলাপের ঘটনাও। কিন্তু আগে থেকে তার বিন্দুবিসর্গও আঁচ করতে পারেনি আরবিআই। কারণ, বছরের পর বছর ধরে ব্যাংকের এমডি আরবিআই-কে ভালো অ্যাকাউন্ট হিসেবেই দেখিয়ে এসেছে। ফলে এইডিআইএল চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। ওই ঋণও ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কার্যত শেষ। ফলে সংকট জোরালো হয় পিএমসি ব্যাংকেও।
এদিকে পিএমসি-কাণ্ডে গ্রাহকদের দুর্দশা ক্রমশ বাড়ছে। গ্রাহকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে একধরনের আতঙ্ক। কেউ জমা টাকা তুলতে না পেরে হচ্ছেন আত্মঘাতী, কেউবা অস্ত্রোপচারের টাকা ব্যাংক থেকে তুলতে না পেরে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। সেই মৃত্যুমিছিল অব্যাহত।এমন কাণ্ডে দেশের মানুষের ব্যাংকের প্রতি ভরসা কমছে। বাড়ছে অবিশ্বাসের আবহও।
বিভিন্ন ব্যাংকে একের পর এক প্রতারণার অভিযোগ সামনে আসায় দেশের বর্তমান সরকারে বাড়ছে অস্বস্তি। সেই অস্বস্তি আরও কয়েক দফা বাড়িয়ে রিজার্ভ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্টে প্রকাশ, গত অর্থবর্ষে বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতারণা-জালিয়াতির ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতারণা সবচেয়ে বেশি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলিতেই। চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলিতে ৯৫,৭০০ কোটি টাকার বেশি প্রতারণা হয়েছে। এপ্রিল-সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে ৫,৭৪৩টি। সম্প্রতি এমন তথ্য তুলে ধরেছেন খোদ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। যেখানে তার আগের বছর ২,৮৮৫টি ঘটনায় নয়ছয়ের অঙ্ক ছিল ৩৮,২৬০ কোটি। প্রশ্ন উঠছে, কেন্দ্র বারবার নজরদারিতে জোর দেওয়ার কথা বললেও, প্রতারণা এতখানি বাড়ছে কী করে? কে বা কারা করছে এই প্রতারণা? শীর্ষ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত অর্থবর্ষে যে সব প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, তার সিংহভাগ জুড়েই আছে ঋণ!
এদিকে আবার বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতারণা-জালিয়াতির ঘটনার দায় এসে পড়ছে গ্রাহকদের উপর। ব্যাংকে জমা টাকার উপর কম পরিমাণ বিমা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।প্রশ্ন উঠেছে, আরবিআই কেন ইনস্যুরেন্স মানির উর্ধ্বসীমা বাড়াচ্ছে না?
১৯৬৮ সাল থেকে প্রথম এই ইনস্যুরেন্স চালু হয়। তখন ঊর্ধ্বসীমা ছিল পাঁচ হাজার টাকা। ১৯৭০ সালে আইনের সংস্কার হয়। ঊর্ধ্বসীমা পাঁচ হাজার থেকে বেড়ে হয় ১০ হাজার টাকা। এর ছ’বছর পর ১৯৭৬ সালে ফের আইনের সংস্কার হয়। ১০ হাজার টাকা থেকে ইনস্যুরেন্সের ঊর্ধ্বসীমা বেড়ে হয় ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ব্যাংক দেউলিয়া হলে গ্রাহক সর্বাধিক ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত টাকা ফেরত পেতেন। তারপর ১৯৮০ সালে ঊর্ধ্বসীমা ৩০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। শেষবার আইন সংস্কার হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। যখন এই ঊর্ধ্বসীমা ৩০ হাজার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করে আরবিআই। তারপর ২৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও নতুন করে আর এই ঊর্ধ্বসীমার সংস্কার করা হয়নি। ফলে গ্রাহকদের ইনস্যুরেন্সের ঊর্ধ্বসীমা একই রয়ে গিয়েছে। আইনে অবশ্য এই ঊর্ধ্বসীমা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। সর্বাধিক পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত করা যেতেই পারে এই ঊর্ধ্বসীমা। যদিও আরবিআই সেই প্রস্তাব মেনে নেয়নি এখনও! অন্যদিকে, প্রবীণদের মূল আয় হল ব্যাংক বা পোস্ট অফিসের সুদ। দুর্ভাগ্যের, সুদের হার ক্রমশ কমছে। বাড়ছে খরচখরচা। বিপাকে পড়েছেন সুদ-নির্ভর মানুষরা। প্রশ্ন, অনাদায়ী এই বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকা আদায়ের দায়িত্ব কার? এর দায় সাধারণ মানুষ নেবে কেন?
এদিকে এফআরডিআই বিলে প্রস্তাব করা হয়েছিল, আর্থিক সংকটে ব্যাংক দেউলিয়ার মুখে থাকলে, আমানতের টাকা গ্রাহকের অনুমতি না নিয়েই বাড়তি সময় আটকে রাখতে পারবে ব্যাংক। গ্রাহকের সঙ্গে সবরকম চুক্তি অস্বীকার করে জমা টাকার উপর সুদের হার কমাতেও পারবে। প্রয়োজনে বদলে দিতে পারবে শেয়ার, ডিবেঞ্চার বা বন্ডে। তবে কি এফআরডি্আই বিল মানে ঋণ নেবেন ধনকুবেররা আর শোধ করবেন জনগণ? ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের ভরসা ক্রমশ তলানিতে।উঠছে সরকারের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন।