হিংসার প্রতিষেধক হিসেবে আরও একটি সুপরিকল্পিত হত্যার আয়োজন করে কি অপরাধবৃত্তিকে সত্যিই নিবৃত্ত করা সম্ভব?
শিল্পের খাতিরেই শিল্পের সৃজন ঘটে, মানুষের অন্তরে আনন্দের উজ্জ্বলতা ফুটিয়ে তোলা ছাড়া শিল্পসৃষ্টির অন্যবিধ উদ্দেশ্য নেই, থাকতে পারে না, একটা সময় সময় পর্যন্ত এমন ধারণা সাড়ম্বরে পোষণ করা হত। যদিও তারপর স্থান-কাল-পাত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই গতানুগতিক বয়ানে রূপান্তর আসে। শিল্পের জন্মরহস্য একটি নির্দিষ্ট নন্দনতত্ত্বের বিমূর্তবাদী ঘেরাটোপ অতিক্রম করে বিভিন্ন সমাজ-রাজনৈতিক অভিঘাতের স্পর্শ পায়। অপশ্য এর ফলে, মা্নুষের মনে আনন্দ সঞ্চারিত করার মৌল শর্তটি যে উপেক্ষিত হল তা নয়, বরং বলা চলে আনন্দ দান করার লক্ষ্যটি অবিকৃতই থাকল, কিন্তু ছবি এঁকে, মূর্তি গড়ে বা কবিতা লিখে মানবসভ্যতার পক্ষে হিতদায়ক কোনও বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করার দায় কার্যত তার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়াল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, প্রকরণপদ্ধতির নিজস্ব কিছু দাবি মেটানোর পরেও এই অভিমত বারবারই সত্য সাব্যস্ত হয়েছে। তবে আজকের মতো নিরাস্থাশাসিত, খণ্ডিত দিনগুলোতেও সেই অনাবিল দায়বদ্ধতার কোনোরকম প্রাসঙ্গিকতা রয়ে গেছে কি না জানতে বেশ কৌতূহল হয়।
খ্রিস্তভ কিয়েসলোভস্কি ও খ্রিস্তভ পিয়েসেভিচ, দুই পোলিশ বন্ধু, ১৯৮৮-৮৯ সালে, টেলিভশনে প্রদর্শনের কথা মনে রেখে, এক ঘণ্টার জন্য দশটি সিনেমা নির্মাণ করার প্রকল্প গ্রহণ করেন যার নাম রাখা হয় ‘ডেকালগ’। এবং পরবর্তীকালে, পরিকল্পনামাফিকই, ডেকালগ সিরিজের পাঁচ নম্বর সিনেমাটিকে ‘আ শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট কিলিং’ নাম দিয়ে ফিচারে পর্যবসিত করা হয়। স্বভাবতই জানতে আগ্রহ জাগে যে বইটির বিষয়বস্তু ঠিক কী। দুর্যোগলাচ্ছিত পরিবেশে, নেহাতই মামুলি কারণের বশবর্তী হয়ে এক যুবক একজন ট্যাক্সিঅলাকে খুন করে বসে। কিন্তু রাষ্ট্রের নজরদারি থেকে শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারে না, ধরা পড়ে যায়। বিচারে তার প্রাণদণ্ডের সাজা ঘোষিত হয়, আইনি পরিভাষায় যাকে বলা চলে ‘ডিটারেন্ট সেন্টেন্সিং’। অর্থাৎ অপরাধীকে এমন কঠোর দণ্ড দেওয়া যাতে তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে আর সবাই সেই বিশেষ অপরাধের পুনরাবৃত্তি করতে ভয় পাবে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, হিংসার প্রতিষেধক হিসেবে আরও একটি সুপরিকল্পিত হত্যার আয়োজন করে কি অপরাধবৃত্তিকে সত্যিই নিবৃত্ত করা সম্ভব? দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে যেহেতু ফাঁসির আদেশ সম্পন্ন হচ্ছে এবং ব্যাপকার্থে প্রতিটি মানুষই যেহেতু রাষ্ট্রের আওতায় পড়ে, তাই সকলেরই কি সেই ফাঁসির জন্য কিছু-না-কিছু দায়ভার থেকে যায় না? খ্রিস্তভ কিয়েসলোভস্কি এবং খ্রিস্তভ পিয়েসেভিচ দুজনেই এই দুটি জিজ্ঞাসায় পীড়িত হয়েছিলেন। এবং প্রগাঢ় আত্ম-উদ্বেলতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তাঁরা পোল্যান্ডের নিষ্প্রাণ, প্রতারণা-পরিপূর্ণ ও ঘৃণামুখরিত প্রেক্ষাপটে একটি সিনেমার মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে মানুষের যে-কোনও হিংসাত্মক প্রবণতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ‘ছবির বিষয়: হত্যা’ নামক আলোচ্য বইটি ক্ষীণকায় হলেও তার ভিতরে এই সব প্রশ্ন আর প্রয়াসের পুরো আলেখ্যটাই ধরা পড়েছে।
কিন্তু তাদের যৌথ উদ্যোগ কি সফল হয়েছিল? এর জবাবে বলা চলে যে আর যাই হোক না কেন, খ্রিস্তভ কিয়েসলোভস্কি ও খ্রিস্তভ পিয়েসেভিচ অন্তত উলুবনে মুক্তা ছড়াননি। কারণ, ১৯৮৯ সালে পোল্যান্ডের নতুন সরকার পাঁচ-পাঁচটি বছরের জন্য মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। নৈতিক জয়ের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?
সম্প্রতি নির্ভয়ার চার ধর্ষক ও খুনে দোষী প্রমাণিত মুকেশ সিং, পবন গুপ্তা, বিনয় শর্মা ও অক্ষয়কুমার সিংকে একসঙ্গে ফাঁসি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। দিল্লি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করে মুকেশ সিং। অবশেষে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সেই আবেদন খারিজ করে দেন। এরপরেই ফাঁসির নতুন দিন ঘোষণা করেন দিল্লির পাতিয়ালা হাউস কোর্টের অ্যাডিশনাল সেশন বিচারপতি সতীশকুমার অরোরা। তবে এই ফাঁসি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে চাপানউতোর। জনমানসে উঠছে নানা প্রশ্ন। প্রশ্ন উঠছে, এই মৃত্যুদণ্ড কি সত্যিই ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মতো ঘটনাকে প্রশমিত করবে? তবে, সমাজের চিন্তক ও বিশিষ্টরা মৃত্যুদণ্ড-ধারণায় সহমত পোষণ করেছেন! তাঁদের ধারণা, মৃত্যদণ্ড অপরাধ কমায়। তাঁদের এই চিন্তা কমিশনের কাছে গ্রহণযোগ্যও বলে মনে হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রতিরোধী-তত্ত্বকেও সমর্থন করেছে। প্রশ্ন হল, হিংসার প্রতিষেধক হিসেবে আরও একটি সুপরিকল্পিত হত্যার আয়োজন কতটা গ্রহণযোগ্য!