গণতন্ত্রের মূল কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে অবিলম্বে রোটি কাপড়া মকান, বিজলি পানি সড়কের সেই চিরাচরিত লক্ষ্যপূরণে ডুবতে বসা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে সামাজিক গণতন্ত্রেও সম্প্রসারিত করা
১৯৪৯, ২৫ নভেম্বর। তিন বছরের পরিশ্রমে শেষ হল ভারতীয় সংবিধানের কাজ। অবশেষে চূড়ান্ত খসড়া পেশ করলেন। সংবিধানসভায় সর্বশেষ বক্তৃতায় ড.ভীমরাও অম্বেদকর বললেন, সংবিধানের মূল সুর এবং গণতন্ত্র কি আদৌ শেষপর্যন্ত আগামিদিনে রক্ষা করা সম্ভব হবে? এই বহুকষ্টলব্ধ স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র ভুল পদক্ষেপে হারিয়ে ফেলবে না তো? বললেন, জাতপাতের বিভাজন-প্রবণতা বহু প্রাচীন এক শত্রু। এ-দেশে। চেনা শত্রুদের পাশাপাশি এসেছে নানাবিধ বৈচিত্র্যের রাজনৈতিক দল, যারা পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক নীতির অনুসারী। অম্বেদকর প্রশ্ন করেছিলেন, দেশবাসী কি সেই সব নীতির ঊর্ধ্বে রাখবে দেশকে? নাকি দেশের ঊর্ধ্বে রাখবে নিজেদের বিশ্বাস ও নীতিকে? যদি রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের দলীয় নীতি আদর্শকে দেশের স্বার্থেরও উপরে স্থান দেয়, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা দ্বিতীয়বারের জন্য আবার সংকটে পড়বে। আর তেমনটিই দেখা যাচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে।
আন্তর্জাতিকমহলে ভারত বিশ্বের কাছে বৃহৎ এক বহুত্ববাদী সংস্কৃতি হিসাবে পরিচিত।আর সেটাই ভারতের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। প্রশ্ন উঠছে, সেই ইমেজটি সরিয়ে ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় এবং শাসকগোষ্ঠী কি আদতে সাবেকি গণতন্ত্রের পথেই হাঁটতে আগ্রহী? নাকি ভারতের সংবিধান নির্দেশিত পথটিই অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে? একটি দেশের সংখ্যাগুরু শ্রেণি যদি সেই দেশের শাসককে বুঝিয়ে দেয়, তারা এটা দেখে মনে মনে আনন্দিত হয় যখন বিশেষ কোনও সংখ্যালঘু শ্রেণির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। কিংবা ওই শ্রেণিকে সামাজিকভাবে কোণঠাসা হতে দেখা যাচ্ছে। কিংবা সেই শ্রেণি যদি সরকার বা আইনের সহায়তা কম কম পাচ্ছে ইত্যাদি। এই মনোভাব যদি সরকার বা শাসক জেনে যায়, তাহলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা থেকে জনতার দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া সহজ হয়। যেমন, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তিকরণকে যদি নীতিগতভাবে ভারতের ঐক্যের জন্যই প্রয়োজন বলে মনে করা হয় অবশ্যই তা সমর্থনযোগ্য। তাহলে সেই একই কারণে নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশের বিশেষ বিশেষ অধিকার বা আইন নিয়েও আপত্তি থাকা উচিত ছিল সংখ্যাগুরুর। কিন্তু তা হচ্ছে কই!
ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় একটি দেশ যদি সার্বিকভাবে সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্রে পরিণত হয় তাহলে সেই দেশের জনতার একটা সময় পর কিন্তু ক্লান্ত লাগবে। কারণ আমাদের দেশের অভ্যাসই হল সর্বধর্মসমন্বয়, বছরভর নানাবিধ পরবে মেতে থাকা। সেই কারণেই আজমির শরিফকে পাশ কাটিয়ে কেউ নিছক পুষ্করে পুজো দিয়ে ফিরে আসে এমন নয়। আজমির শরিফেও একবার ঢুকে একটা চাদর চড়িয়ে আসেন হিন্দুরাও। প্রতি বৃহস্পতিবার দিল্লির নিজামউদ্দিন দরগার কাওয়ালি অনুষ্ঠানে নিয়ম করে সব সম্প্রদায়ের মানুষই সমবেত হয়ে ওই ধর্মসংগীত উপভোগ করেন। যদি দেখা যায় গোটা দেশে সংখ্যাগুরুদের দাপটই বেশি এবং অন্য ধর্মাবলম্বীরা নীরব জীবনযাপন করছেন, তাহলে আজ যারা সাবেকি গণতন্ত্রে নিজের শক্তি হিসাবে কল্পনা করছে তাদের ভুল ভাঙবে একসময়। কারণ যদি এটাই একটি দেশের প্রকৃত শক্তি বা উন্নয়নের রূপরেখা হত, তাহলে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ এতদিনে এগিয়ে যেত। এমনকী চিনকেও এভাবে নিজেদের গোপন করে রাখতে হত না। তাদের অভ্যন্তরে কী চলছে, কত মানুষ যে অপরিসীম দারিদ্র্যে বাস করছেন সেটা যাতে বহির্জগৎ জানতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে এত কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে চিনকে।
যে গ্রামজীবনের সঙ্গে সরকারের প্রত্যক্ষ রোটি কাপড়া মকানের সম্পর্ক, তারা ক্ষুব্ধ।কারণ তাঁরা ভালো নেই। ক্রমশ তাঁরা ভোট থেকে পিছপা হচ্ছেন। এই রাগকে কিন্তু সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্র কমাতে পারছে না।
গণতন্ত্রের মূল কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে অবিলম্বে রোটি কাপড়া মকান, বিজলি পানি সড়কের সেই চিরাচরিত লক্ষ্যপূরণে ডুবতে বসা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে সামাজিক গণতন্ত্রেও সম্প্রসারিত করা। কারণ, বিগত তিরিশ বছরে সব থেকে বেশি যে ইন্ডাস্ট্রি দ্রুত হারে বেড়েছে সেটি হল, বৈষম্য। সে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে হোক, কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে।
অতএব সংবিধান অনুসরণ করা শ্রেয়। কারণ, সেখানে বলা হয়েছে, জাস্টিস, লিবার্টি, ইকোয়ালিটি!