দেশের দরিদ্রতম অংশের শিশুরা যেন আটকে পড়েছে দারিদ্র্য ও অপুষ্টির ফাঁদে
শিশু-বৃদ্ধিতে
প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য আর দরিদ্র্যতা। পাঁচ বছরের নীচে দেশের প্রতি তিনজন শিশুর একজনের
শরীর-স্বাস্থ্যের হাল এমনই।বাড়ন্ত বয়সেই আটকে যাচ্ছে এদের বৃদ্ধি। এমন শিশুরা ভবিষ্যতে
কতটা এগোতে পারবে বা আদৌ পারবে কি না তা বলা কঠিন। কেন্দ্রীয় সরকার এবং ইউনাইটেড
নেশনসের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিওরিটি অ্যানালিসিস
ইন্ডিয়া, ২০১৯ শীর্ষক
এক রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয়েছে, দেশের দরিদ্রতম অংশের শিশুরা যেন আটকে পড়েছে
দারিদ্র্য ও অপুষ্টির ফাঁদে।অথচ, দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, রফতানি করার মতো অজস্র খাদ্য, সাফল্য কাহিনি ও সরকারের অজস্র যোজনার সাফল্য-গল্প
আমরা শুনি! সরকারি রিপোর্টে পরিষ্কার, এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে
বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া শিশুর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১.৪ শতাংশ।সঙ্গত কারণে শিশুদের শারীরিক
বৃদ্ধি ব্যাহত করবে মানসিক বৃদ্ধিকে।আর ব্যাহত হবে এদের বুদ্ধিবৃত্তি। এ-এক অদ্ভুত
চক্র! আজকের ক্ষুধার্ত, বৃদ্ধি-ব্যাহত-হওয়া শিশুটি উপযুক্ত সময় ও বয়সে শরীরে-মনে বাড়ার সুযোগ না পেলে
আগামী দিনে অনিবার্যভাবে ক্ষুধার্ত বেকার এবং অশিক্ষিত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ
হয়েই থাকবে!আর এটা খুবই স্বাভাবিক।
ভারত বিশ্বের সবচেয়ে অপুষ্টিতে-ভরা
দেশের অন্যতম।পরিসংখ্যানের জিগির তুলে কেউ হয়তো বলবেন, কেন ২০০৫-৬ এর তুলনায় ২০১৫-১৬ সালে তো দেশে
লাগাতার অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা কমেছে, কমেছে অ্যানিমিয়া, ওজন কম শিশুর সংখ্যাও এখন আগের তুলনায় কম। কিন্তু এই অগ্রগতি খুবই মন্থর!আর
সেটা বছরে মাত্র ১ শতাংশ হারে। বৃদ্ধির হার প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আর এই দেরি
হওয়াটাই দেশের বহু শিশুর পক্ষে অমঙ্গল।
সরকার এসব কথা ভাবছে না তা নয়। ন্যাশনাল নিউট্রিশন মিশন অর্ত্থাৎ পোষণ অভিযান, তাতে বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া শিশুদের সংখ্যা বছরে ২ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।বলা হচ্ছে, ২০২২-এর মধ্যে বৃদ্ধি-ব্যাহত-হওয়া শিশুর সংখ্যা ২৫ শতাংশে কমিয়ে ফেলা হবে। কিন্তু এই লক্ষ্যে পৌঁছতে অগ্রগতির হার তুলনামূলক দ্বিগুণ করতে হবে।
সমস্যার ব্যাপকতা নিশ্চয় আছে, রয়েছে পরিকাঠামো এবং মানুষের সচেতনতার সমস্যাও। কিন্তু দেশে খাদ্য নেই বলে যে গরিব শিশুদের পুষ্টির জন্য খাদ্য দেওয়া যাচ্ছে না তা নয়। এটাই সবচেয়ে দুঃখের, সবচেয়ে লজ্জার।গত দু’দশকে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে এখন আমরা স্বয়ম্ভর। কিন্তু সেই অনুপাতে চাল, গম এবং অন্যান্য জরুরি খাদ্যশস্য মানুষের পক্ষে ততটা সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি! যার পরিণতিতে এখনও দেশের দরিদ্রতম অংশের প্রায় ৩০ শতাংশেরও বেশি মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম খাদ্যশস্য পান। দরিদ্র শিশুদের মধ্যে এই অপ্রাপ্তির হার বেশি।
এটা যে শুধু আর্থিক কারণেই ঘটছে তা নয়। বহু জায়গায় আর্থসামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও একটা বড় সমস্যা।
আগামী পাঁচ বছরে দেশকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশে পরিণত করার কথা বলছে সরকার। খুবই ভালো কথা। কিন্তু বৃদ্ধি-ব্যাহত-হওয়া শিশুদের বিপুল বোঝা তো এ রাস্তায় দেশের এগনোর পথে বাধা সৃষ্টি করবে। আসলে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে সম্পদ নয়, সমাধানের রাস্তাটা তৈরি করতে না-পারার কারণে। পরিষেবা পাওয়ার সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক কাঠামোর অসুবিধা দূর করতে না পারলে অবস্থা বদলানো কঠিন।
বদলাতে হবে
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।
দেশ-সমাজ-সময়-সভ্যতা সবকিছু এগোয়
শিশুদেরকে ঘিরে। শিশুদের শারীরিক বিকাশ এখন উন্নয়নের একটা বড় সূচক। কিন্তু দেশের
দুই-পঞ্চমাংশ গরিব পরিবারের বৃদ্ধি-ব্যাহত-হওয়া শিশুদের নিয়ে উন্নয়নের রাস্তা খোঁজাটাই
কি সঠিক পথ! এ-অবস্থা বদল দরকার।