জল-সন্ত্রাস!

3 - মিনিট |

শুধু আর্সেনিক নয়, জলের সমস্যা ব্যাপক ও বহুরকম। কোথাও প্রকট আর্সেনিক, কোথাও রোগজীবাণু, কোথাও ফ্লোরাইড, কোথাও পেস্টিসাইড

শ্রীজীব

জলসিক্ত-বাংলা জলেরই কারণে আজ গভীর সংকটে। সমাজ সংস্কৃতি জীবন বিপন্ন। মাটির নীচ থেকে আহৃত পানীয় জলে মিশে থাকছে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক বিষ। আপামর শিশু কিশোর যুবা প্রবীণ বৃদ্ধ সকলে বাধ্য হচ্ছে সেই জলগরল পানে। নেমে আসছে প্রতিকারহীন রুগ্ণতা অশক্ততা বিপন্নতা। জনজীবন ধেয়ে চলেছে এক অমোঘ অন্ধকার    ভবিতব্যের দিকে।গ্রস্ত হচ্ছে হতাশা আর বিষাদে।কান্নায় ভেঙে পড়ছে, কাতর আবেদন জানাচ্ছে—একটু বিষমুক্ত পানীয় জল দেবে গো!

শুধু আর্সেনিক নয়, জলের সমস্যা ব্যাপক ও বহুরকম। কোথাও প্রকট আর্সেনিক, কোথাও রোগজীবাণু, কোথাও ফ্লোরাইড, কোথাও পেস্টিসাইড। স্থানান্তরে তো সমস্যার রূপ পালটাই, কালান্তরেও একই জায়গায় ভিন্ন রূপে দেখা দেয়। কোথাও জল থেকেও নেই, কোথাও না থেকেও প্রবলভাবেই আছে। কখনও খরসান খরা কখনও দুর্বার বন্যা-ভাঙন-ঘরবাড়ি সবকিছুর। আসলে সমস্যাটা সামগ্রিক জল ব্যবস্থাপনার। আহরণ শোধন বণ্টন ব্যবহার প্রত্যেক ক্ষেত্রে এবং সব মিলেয়ে।

উদার আয়োজনে প্রকৃতি আমাদের চারদিক থেকে জল দিয়ে ঘিরে রেখেছে। মাটির তলায় পুকুরে দিঘিতে সরোবরে নদীতে সমুদ্রে মেঘে বৃষ্টিতে। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের আছে এক সূক্ষ্ণ সুঠাম ছন্দ, স্থিতিতে ও গতিতে ভারসাম্য। সেসবের তোয়াক্কা না করে ক্রমাগত আমরা যদি সেই ছন্দ আর ভারসাম্য বিঘ্নিত করে চলি, বিপদ তো ঘনাবেই।

পানীয় জলের আর্সেনিকে যে বিপদসংকেত তা, তাই, একক বা বিচ্ছিন্ন নয়। এমনকী শুধু জলেও সীমিত নয়। মাটি বাতাস ফল-মূল সবজি-শস্য, দুধ পানীয় মাছ মাংস ডিম সবকিছুতেই আর্সেনিকের অনুপ্রবেশ ঘটছে। অপুষ্ট শরীরে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার যে পক্ষপাতিত্ব, তা অচিরেই ঘুচে যাবে। কেউই রেহাই পাব না, চোখ বুজে উদাসীন থাকার বিলাসিতার অবকাশ নেই। আমাদের স্বাস্থ্য পুষ্টি প্রগতি উন্নয়ন, পরিবেশের সুরক্ষা সংরক্ষণ সদ্ব্যহার—সবকিছুই আর্সেনিকের সমস্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠীতে আর্সেনিকদৃষ্ট পানীয় জলের প্রাদুর্ভাব ধরা পড়লে তার আশু প্রতিকারের চেষ্টা নিশ্চয়ই করতে হবে। কিন্তু সামগ্রিক দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ মোকাবিলার প্রতি দৃকপাত না করে সেরকম প্রচেষ্টায় আখেরে কোনও লাভই হয় না।

অথচ এমনটাই বার বার ঘটে চলেছে। পানীয় জলের এহেন মহাসংকটে জনসাধারণ স্বভাবতই সরকারেরর মুক্ষাপেক্ষী। কিন্তু সরকারি নিয়ম-নীতি পদ্ধতির আছে নিজস্ব গতিপ্রকৃতি। পানীয় জলে আর্সেনিকের ব্যাপারে তা যেন এক দুষ্টচক্রে আবর্তিত। প্রথম প্রথম সমস্যাটির অস্তিত্বটিই অস্বীকৃত হয়। যাঁরা তোলেন, আতঙ্ক ছড়ানোর অভিযোগে তাঁরা অভিযুক্তই হয়ে পড়তে পারেন। নানা টালবাহানা চাপানউতোরের পথ বেয়ে একসময় স্বীকৃত হয় সমস্যা। সরকারি বিবিধ দফতর আধিকারিক, বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞ কমিটি ইত্যাদির দায়দায়িত্বের পরিধি নির্দিষ্ট হতে হতে, সমীক্ষা আলোচনার কতটা কী করণীয় বা প্রয়োজন, টাকাপয়সা কোথা থেকে আসবে সেবসব বিবেচনা করতে করতে দীর্ঘ সময় গড়িয়ে যায়। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক নানা বাধ্যবাধকতা হিসেবনিকেশ।

অবশেষে গৃহীত হয় আর্সিনিক দূরীকরণ প্রকল্প। কখনও আসে বিদেশি প্রযুক্তি। অনুদান। ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকল্প উদ্বোধন হয়। বাইরের মানুষজনের আনাগোনা, যন্ত্রপাতি বসানো, স্থানীয় কিছু মানুষের সক্রিয়তা চোখে পড়ে। যাঁদের জন্য এত আয়োজন, তাঁরা থাকেন অপাক্তেয়। কেননা তাঁদের না আছে সচেতনতা, না আছে জ্ঞান, না আছে দক্ষতা, অর্থক্ষমতা। জ্ঞান দক্ষতা অর্থ না-ই থাকুক যে এতসব দাক্ষিণ্যের সমাবেশ এও যেন তাঁরা বুঝতে চান না। মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্প। নির্বাচন এগিয়ে এলে উৎসাহ আবার জিইয়ে ওঠে, তৎপরতা বাড়ে। স্তোকবাক্য আশ্বাসে প্রতিশ্রুতিতে প্রগলভ হয়ে ওঠে প্রশাসন। আর্সেনিক এভাবেই এক বৃহৎ খেলার উপকরণ—টাকার খেলা, রাজনীতির খেলা। মানুষের দুর্দশা হতাশা রোগ যন্ত্রণা যত তীব্র হয়, তত জোরদার জমে খেলা। সবার পক্ষে এত সব বুঝে ওঠাও সম্ভব হয় না। মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদে সরল মনেও অনেকে এ খেলায় শামিল হয়ে পড়েন।

আজ উন্নয়নের নামে ভূগর্ভ থেকে জলশোষণ চলছেই। ভূগর্ভের জলে আর্সেনিক দূষণ ব্যাপক। জলের মাধ্যমে সেই দূষণ মানুষের খাদ্যে ঢুকছে।ধুলো এবং ফ্লাই অ্যাশের মাধ্যমে শহরের মানুষের ফুসফুসও বিপন্ন। এর ফলে বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা, আগামী প্রজন্মের শিশুরা কতটা বিপন্ন তা বলে বোঝানো যাবে না। মানুষকেই সেটা বুঝতে হবে।

আসলে আর্সেনিক সমস্যা মোকাবিলায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যেরকম আবশ্যক, তেমনি রাজনীতি অর্থননীতি ও সমাজনীতিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই সমস্যাটি সব দিক দিয়ে বিবেচনা করা দরকার, বিশেষ করে মানুষের কল্যাণার্থে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related news