ব্রতীন, শ্রেয়সী, সুপর্ণা— এঁরা সকলেই এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্থানাধিকারী। সকলেই বিজ্ঞান পড়তে চায়। তাহলে কি কলা শাখা ব্রাত্য? কেন প্রকৃত ভাল ছেলেমেয়েদের কলা শাখায় আসার প্রবণতা কম? প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে
৬৮৯ নম্বর পাওয়া ব্রতীন মন্ডল বিজ্ঞান পড়তে চায় ফিজিক্স পড়ার জন্য। বাবা ওই বিষয়ের শিক্ষক। সুতারাং জিনগত একটা আগ্রহ আছে ধরে নেওয়া যেতে পারে। ৬৯১ পাওয়া ফালাকাটার শ্রেয়সী পাল বিজ্ঞান পড়তে চায় চিকিৎসক হওয়ার জন্য। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঋষি রাজনারায়ণ হাই স্কুলের ৬৮৫ পাওয়া সুপর্ণা সাহু সবাইকে অবাক করে দিয়েছে ইতিহাসে ১০০-তে ১০০ পেয়ে। সে কলা শাখায় না গিয়ে বিজ্ঞান পড়তে চায়। মাল মহকুমার ওদলাবাড়ির সুনীল চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের ৬৩৪ পাওয়া সুকন্যা সাহা বাংলা ও ইংরেজিতে পেয়েছে ৯০ করে, ভুগোলে ৯৩। সেও বিজ্ঞান পড়বে।
কলা শাখার অজস্র প্রাক্তনী পরবর্তীকালে নামী অধ্যাপক বা প্রশাসক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। চটজলদি নাম করা যায় রামকৃষ্ণ মিশন ও প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর পুত্র বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মিলিন্দ, যোধপুর আইআইটি-র শিক্ষিকা সাউথ পয়েন্টের প্রাক্তনী ময়ুরাক্ষী চৌধুরী, প্রাক্তন সম্পাদক সুমন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের। তালিকা দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে। অনেকের মতে, বিজ্ঞান পড়লে কাজের সুযোগ বেশি ঠিকই, কিন্তু তুলনায় প্রতিযোগিতার মাত্রা তো আরও বেশি।
তাহলে বিজ্ঞান পড়ার এত বেশি প্রবণতার কারণ কী? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশিষ্ট শিক্ষক অনিন্দ্যজ্যোতি মজূমদার ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে বলেন, “লেখাপড়ায় ভালো ছেলে মেয়েরা বিজ্ঞান পড়বে এটা একটা প্রতিষ্ঠিত প্রবণতা। কলা বিষয়ে কারও বিশেষ আগ্রহ না থাকলে এর ব্যতিক্রম হয় না। এটা একটা সামাজিক বাস্তব। তাই বলে ভালো ছেলেমেয়ে কলা বিভাগে আসে না, তাও নয়। বর্তমান দুনিয়া বড় বেশী প্রযুক্তি নির্ভর। সেটা এর একটা কারণ।“ অনিন্দ্যবাবুর মতে, “কলা বা বিজ্ঞান-বহির্ভূত নানা শাখায় পড়ুয়াদের অনাগ্রহের আর একটা কারণ, অবিভাবকদের নির্দেশ। অনেকের ধারণা থাকে, বিজ্ঞান না পড়লে কাজ পাওয়া যাবে না। তাই বড়রা ছেলেমেয়েদের বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞান না পড়লে জীবন বৃথা গোছের ছবি তৈরি করেন।
সাউথ পয়েন্টের কৃতী প্রাক্তনী, প্রায় দেড় দশক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নামী হাসপাতালে কাটিয়ে ফিরে আসা চিকিৎসক নির্মাল্য রায়চৌধুরীর মতে, “মেধাবীদের এই প্রবল বিজ্ঞানমুখী হওয়াটা আদতে রাষ্ট্রের ক্ষতি। কারণ, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের নামী ইঞ্জিনিয়ার-প্রযুক্তিবিদদের একটা খুব বড় অংশ নানা সময় বিদেশে চলে গিয়েছেন। দেশ তাঁদের সুফল পায়নি। রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি হয়েছে এতে। সেই ট্রাডিশন এখনও অব্যাহত।“
তাহলে প্রতিকারের উপায় কী? জবাবে ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে তিনি বললেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেনেটর থেকে প্রেসিডেন্ট— সফল রাজনীতিকদের একটা বড় অংশ আইনজ্ঞ। ফলে, সার্বিকভাবে আইনের সুশাসন সেখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাকে ভেদ করে দুর্নীতি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এর ঠিক উল্টো ছবি ভারতে। প্রাক-স্বাধীনতা পর্বেও নামী ভারতীয়দের অধিকাংশই ছিলেন আইনজ্ঞ। মেধাবীরা আইনে যত বেশি আসবেন, তত উন্নত হবে সামাজিক এবং জাতীয় পরিকাঠামো। এর পূর্ণ সুফল পাবে দেশ। কারণ মগজ চালান বা ব্রেন ড্রেন হবে না। ক্যারিয়ার-পরিকঢ়্পনার সময় এই বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিতে হবে।” ০অনেকের বক্তব্য, প্রথম প্রজন্মের আইনজীবীকে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য প্রচুর ঝুঁকি নিতে হয়। সেই ঝুঁকি না নিয়ে প্রযুক্তির বৃহত্তর বাজারের হাতছানিতে আকৃষ্ট হন মেধাবী পড়ুয়ারা। এ ব্যাপারে নির্মাল্যবাবুর বক্তব্য, “মহাত্মা গান্ধী থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শরৎ চন্দ্র বসু থেকে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল— এঁরা তো প্রত্যেকেই প্রথম প্রজন্মের আইনজীবী হিসাবে দেশজোড়া প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। শিক্ষা-প্রশাসক এবং পরিকল্পনাবিদদের তাই বোঝাতে হবে, ভাল আইনজ্ঞের প্রকৃত মূল্যায়ণ করা। কেবল বিজ্ঞানমুখী মেধাবীদের আইনে আকৃষ্ট করা দরকার।“