খুদে পড়ুয়ার বোঝা কমাতে জারি হল ফরমান, প্রশ্ন কাজ হবে কতটা?

6 - মিনিট |

“স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী, আমরা কি আর বইতে পারি/ এও কি একটা শাস্তি নয়, কষ্ট হয়, কষ্ট হয়/
আমার কষ্ট বুঝতে চাও, দোহাই পড়ার চাপ কমাও/ কষ্ট হয়, কষ্ট হয়। ”

সম্রাট গুপ্ত

কবীর সুমনের গানে ফুটে ওঠা স্কুলগামী শিশুদের এই আর্তি নিছক কবির কল্পনা নয়। এ এক নিরেট বাস্তবতা। শিশু হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, পিঠে ব্যথা, সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারার কষ্ট নিয়ে শিশুরা তাঁদের কাছে আসছে। এদের প্রায় সবাই বলছে, স্কুলব্যাগের ওজন বেশি। বয়ে নিতে কষ্ট হয়। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল—সব প্রতিষ্ঠানের শিশুদের কাছ থেকেই তাঁরা এমন অভিযোগ পেয়েছেন।

অবশেষে টনক নড়ল কেন্দ্রীয় সরকারের। দেশের বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে বাচ্চাদের স্কুলব্যাগের ওজন হাল্কা রাখতে। কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ মন্ত্রকের ওই নির্দেশিকার (রেফারেন্স ডি ও নম্বর ১-৪/২০১৮-১৫-৩) ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজ্য অভ্যন্তরীন সার্কুলারও জারি করেছে। এতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, শিশুদের কোনও হোমওয়ার্ক দেওয়া চলবে না। প্রথম ও দ্ফিতীয় শ্রেণিতে অঙ্ক ও ভাষা ছাড়া অন্য বিষয় পড়ানোর প্রয়োজন নেই। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড টেকনলজির সুপারিশ মেনে পরিবেশ বিজ্ঞান (ইভিএস) অন্তর্ভূক্ত করার কথা বলা হয়েছে নির্দেশিকায়।

নির্দেশিকায় বাড়তি বই স্কুলে না আনার পাশাপাশি কোন ক্লাশে ব্যাগের বোঝা কত হতে পারে, তার উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য দেড় কিলো, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির জন্য ২ দশমিক ৩ কিলো, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য ৪ কিলো, অষ্টম ও নবম শ্রেণির জন্য সাড়ে চার কিলো ও দশম শ্রেণির জন্য ৫ কিলো।

স্কুলব্যাগের অতিরিক্ত ওজন নিয়ে বিতর্কের মধ্যে আইসিএসই স্কুল সংগঠনের তরফে সম্প্রতি জানানো হয়েছে, অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে লকার সিস্টেম যাতে চালু করা যায়, সেই চেষ্টা করছে বিভিন্ন স্কুল। অর্থাৎ ওই শ্রেণি পর্যন্ত অতিরিক্ত খাতা ও বই স্কুলেই রাখতে পারবে পড়ুয়ারা। ক্যালকাটা গার্লস স্কুলে পড়ুয়াদের ব্যাগে ওজন যাচাই করা হয়।ক্যালকাটা গার্লস স্কুলে এ দিন পড়ুয়াদের ব্যাগ ওজন করা হয়। স্কুল সূত্রের খবর, ব্যাগের ওজন বেশি হলে অভিভাবকদের সেটা জানানো হবে। এই পদক্ষেপে খুশি অভিভাবকেরা। বাগুইআটি এলাকার এক অভিভাবক জানান, এ ভাবে স্কুল সক্রিয় হলে শিশুরা সুরক্ষিত থাকবে।

কলকাতার অন্যতম ভাল প্রতিষ্ঠান পঞ্চসায়র হাই স্কুলের অভিজ্ঞ শিক্ষিকা সুপর্ণা চক্রবর্তী জানান, “কেবল পড়ুয়াদরদী ভাল কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। বাস্তব জিনিসটাও মাথায় রাখা দরকার। বিদ্যালয়ে রুটিন ধরে বিভিন্ন বিষয়ের ক্লাস হয়। বই ছাড়া  সেগুলি অনুধাবন  করে মনে রাখা  ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে  সম্ভব নয়। তেমনই প্রয়োজন বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তার চর্চা। বিশেষ করে অঙ্ক , ব্যাকরণ বা বিজ্ঞানের মতো বিষয় গুলি। ফলে বিষয় প্রতি বইখাতা ছাড়া পাঠ দান ও গ্রহণ দুইই অসম্পূর্ণ থাকে। ব্যাগের বোঝা হাল্কা করার জন্য আগে বিদ্যালয়ের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ঠিক করা দরকার।অর্থাৎ প্রতিটি ছাত্র বা ছাত্রীর জন্য নিজস্ব ড্রয়ার, যেখানে সে তার বইপত্র রাখতে পারবে এবং প্রয়োজন মত ব্যবহার করতে পারবে ।”

রাজ্যের স্কুলশিক্ষা দফতর জানাচ্ছে, ২০০৬ সালের কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের দেহের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ পিঠে নেওয়া উচিত নয়। চতুর্থ শ্রেণির ক্ষেত্রে তিন কিলোগ্রামের কম, ষষ্ঠ শ্রেণির ক্ষেত্রে চার কেজির কম এবং অষ্টম শ্রেণির ক্ষেত্রে সাড়ে চার কেজি পর্যন্ত ওজনের ব্যাগ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে সেই ওজন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। অধিকাংশ স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, অপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসে পড়ুয়ারা। একই ভাবে বাড়তি খাতা, পেনসিল বাক্স, এমনকি স্কুল থেকে সরাসরি প্রাইভেট টিউশনে যাওয়ার জন্য বাড়তি পোশাকও থাকে ব্যাগে। সেই জন্য ব্যাগের ওজন অনেকটাই বেড়ে যায়। এই অবস্থায় স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লকারের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।

পড়ুয়ারা সেখানে বাড়তি বই বা খাতা রাখতে পারে। সেগুলিকে রোজ রোজ ব্যাগে নিয়ে বইতে হয় না। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাক্‌-প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সেটা রাখা থাকে। এ বার পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যাতে লকার চালু করা যায়, সেই চেষ্টা চলছে।’’

এক চিকিৎসক শোনালেন তাঁর এক শিশু রোগীর গল্প। তাতে শিশুটির শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি ফুটে উঠেছে অভিভাবকের অসহায়ত্ব। ঘটনাটি এমন— শিশুটি মাঝে মাঝেই পিঠের ব্যথায় কাতরায়। কোনও কোনও দিন ব্যথা ঘাড় বা পায়েও ছড়িয়ে পড়ে। শিশু অস্থিবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসক দেখেশুনে বললেন, শিশুটি তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ওজনের বোঝা বয়ে বেড়ায় প্রতিদিন। এই বোঝা স্কুলব্যাগের বোঝা। এই বোঝাটা কমাতে হবে। মা-বাবা সাহস নিয়ে বলেন, পরামর্শপত্রে যদি বিষয়টি লিখে দেন চিকিৎসক, তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে বোঝানো সহজ হবে। চিকিৎসক সারওয়ার তা-ই করলেন।

দিল্লির এক স্কুলের ছাত্র বরুণ জৈনের করুণ কাহিনিটি এখানে উদাহরণ হিসেবে চলে আসে। দিনটা ছিল ২০১২ সালের ২৫ জানুয়ারি। কিছুতেই সেদিন আর ব্যাগের ভার বইতে পারছিল না সে। হঠাৎ স্কুলের সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল। সবাইকে কাঁদিয়ে ছেলেটি মারাও গেল।

জীবনই যদি না বাঁচল, তবে তা আবার কেমন ধারার পড়ালেখা? দিল্লিতে শুরু হলো স্বাক্ষর সংগ্রহ। তার পরিপ্রেক্ষিতে কোন ক্লাসের শিশুরা সর্বোচ্চ কত ওজনের ব্যাগ বইতে পারবে, সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় নীতিমালায় নির্দেশনাও দেওয়া হয়। দিল্লি হাইকোর্ট প্রাক্-স্কুলপর্যায়ে ব্যাগের ওজন শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের কম করার নির্দেশ জারি করে।

সম্প্রতি ইন্ডিয়ান জার্নাল অব পেডিয়াট্রিকস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩০ শতাংশ শিশু বেশি ওজনের ব্যাগ বহনের কারণে পিঠে ব্যথায় ভুগছে। আর এক প্রতিবেদনে ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, বেশি ওজনের ব্যাগ বহনের কারণে শিশুদের স্থায়ী শারীরিক ক্ষতি হয়ে থাকে। বয়ঃসন্ধিকালে হাড়ের কাঠামো ঠিক হয়, এ সময় বেশি ওজন বহন করা একেবারে অনুচিত।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিশুদের অবস্থাটা আসলে কী, তা একনজরে বোঝার জন্য সার্বিক কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া গেল না। ‘প্রথম আলো’-র একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের স্কুলপড়ুয়া শিশুরা  বেশি বোঝা বয়ে বয়ে অসুখ বাঁধিয়ে ফেলছে। ঠিক কত, তার কোনও পরিসংখ্যান নেই বলে জানিয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলেছেন, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দেখেশুনে নির্দ্বিধায় বলা যায়, সবার অসচেতনতায় প্রতিদিন বাংলাদেশের শিশুরা একটু একটু করে গুরুতর শারীরিক ক্ষতির দিকে এগোচ্ছে।

কৌতূহল থেকে ’প্রথম আলো’-র প্রতিবেদক ১৫ দিন সময় নিয়ে কয়েকটি স্কুলের নার্সারি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) শিক্ষার্থীদের ব্যাগ মেপে দেখেন। চিত্রটা এমন—ওয়ারীর কিন্ডারগার্টেন স্কুলের এক ছাত্রের ব্যাগের ওজন ছিল সাড়ে চার কেজি। ইস্কাটনের একটি স্কুলের প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রের ব্যাগের ওজন পাওয়া যায় তিন কেজি। ধানমন্ডির সাত মসজিদ সড়কে অবস্থিত একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া এক ছাত্রের ব্যাগের ওজন সাড়ে ছয় কেজি। নিউমার্কেট-সংলগ্ন একটি বিখ্যাত সরকারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রের ব্যাগের ওজন ছিল সাত কেজি। শের এ বাংলা নগরের একটি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীর ব্যাগের ওজন পাওয়া যায় সাড়ে সাত কেজি। ধানমন্ডির একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রের ব্যাগে আটটি বই, আটটি খাতা, পেনসিল বক্স, জলের ফ্লাস্ক ও টিফিন বক্স দেখা গেছে। ওই শিশুটির অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, বইয়ের চেয়ে খাতার ওজই বেশি। স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী স্কুল থেকে খাতা কিনতে হয়। দেখা যায়, একই বিষয়ে দু-তিনটি খাতাও নিতে হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রের ব্যাগে পাওয়া গিয়েছে সাতটি বই, সাতটি খাতা, ডায়েরি, পেনসিল বক্স, জ্যামিতি বক্স, টিফিন বক্স, জলের ফ্লাস্ক ও স্কেল। ওই ছাত্র জানায়, প্রতিদিন তাদের সাতটি বিষয়ের ক্লাস হয়।

দিল্লিতে যে শিশুটি মারা গিয়েছিল, সেই বরুণ জৈন তার শরীরের ওজনের ৪০ শতাংশ বোঝা বইছিল। কিন্তু বাংলাদেশের শিশুদের কী পরিমাণ ওজন বহন করা যুক্তিযুক্ত?

শিশুবিশেষজ্ঞ ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের শিক্ষক আবদুল্লাহ শাহরিয়ার বললেন, একজন শিশুকে কখনো তার নিজের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি বোঝা বইতে দেওয়া যাবে না। সেদিক থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রদের ব্যাগের ওজন হবে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই কেজি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির তিন কেজি। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির শিশুদের চার কেজি। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন হতে পারে সর্বোচ্চ ছয় কেজি।

রাজশাহীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের সহকারী শিক্ষক আজমিরা খাতুন বলেন, পাঠ্যক্রম অনুযায়ী বই আনলে ওজন বেশি হওয়ার কথা নয়। শিশুরা অনেক সময় কোচিংয়ের জন্য বই-খাতা বহন করে অথবা নোট বই, গাইড বই নিয়ে আসে। এতে ওজন বাড়ে। তবে তিনি বলেন, সপ্তাহে দুটোর বেশি বাড়ির কাজ না দেওয়ার কথা বলা হলেও কোনো কোনো শিক্ষক এ নির্দেশনা মানেন না। ফলে শিশুদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শহরের স্কুলে ব্যাগের ওজন বেশি। তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন ও নামকরা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেক সময় প্রকাশনা সংস্থাগুলোর যোগসাজশ থাকে। দুই পক্ষ মিলে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বাড়তি বই জুড়ে দেয়। তিনি বলেন, উন্নত দেশে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক বই পড়ানো হয়। তবে সেগুলো শিশুদের প্রতিদিন স্কুলে বয়ে আনতে হয় না। শিশুরা গ্রন্থাগার থেকে বই নেয়, মনের আনন্দে পড়ে। শিক্ষক মাঝে মাঝে গল্পচ্ছলে দু-একটা প্রশ্ন করে বুঝে নেন, শিশুরা বই পড়ছে কি না।

ভারতের সর্ববৃহৎ প্রি স্কুল চেন ‘লিটল লরেট্স’-এর ৮৫টি শাখা রয়েছে দেশের নানা স্থানে। এর সিইও তথা ডিরেক্টর তমাল মুখোপাধ্যায় ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের শিক্ষা-শাখার প্রধান তথা স্কুল এডুকেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। ব্যাগের বোঝা প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে জানান, “আমাদের পাঠ্যসূচী বিজ্ঞানসম্মতবে ঠিক করা হয়। আলোচনা হয় এক দিনে একটা ওয়ার্কবুক নিয়ে। আমাদের শিক্ষিকারা লক্ষ্য রাখেন বই বা ব্যাগের বোঝা যেন একদম না থাকে। হাতেকলমে শেখানোর ব্যাপারটাই প্রাধান্য পায়। সংখ্যা আর ইংরেজি শব্দ পরিচয়ের ওপর গুরুত্ব দিই আমরা। প্লে গ্রুপ, নার্সারি, লোয়ার কেজি ও আপার কেজি— প্রতিটিতেই আমরা নজর রাখি যাতে বাচ্চারা মানসিক চাপের শিকার না হয়।“

ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের প্রধান ও বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সহিদুল্লা বলেন, পিঠে-ঘাড়ে ব্যথার কারণ যে ভারী ব্যাগ, অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। ফলে বাচ্চাকে অনেক দেরিতে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন। বেশি বোঝা বইলে কী ক্ষতি হতে পারে জানতে চাইলে শিশুবিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, দিনের পর দিন ভারী ব্যাগ বইলে শিরদাঁড়ার স্বাভাবিক অবস্থান নষ্ট হয়ে যায়। চাপ পড়তে পড়তে দুই হাড়ের মাঝখানে নরম পদার্থ শুকিয়ে যায়। এতে দীর্ঘস্থায়ী পিঠে ব্যথা, পিঠ বেঁকে যাওয়া, হাড়ে ফাটল ধরা ও শিশুর ঠিকমতো বেড়ে উঠতে না পারার মতো গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে।

করণীয় জানতে চাইলে চিকিৎসকেরা বলছেন, শিশুদের বাঁচাতে হলে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, বোঝা কমাতে হবে। সেটা কীভাবে হবে তা খুঁজে বের করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। স্কুল কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে হবে। অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া দরকার।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফাহিমা হোসেন বলেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইয়ের তালিকা অনুসরণ করলে এ সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে তিনি জানান, কোন ক্লাসের শিশুরা কত ওজনের ব্যাগ বইবে, সে ব্যাপারে তাঁদের কোনো নির্দেশনা নেই।

চিকিৎসকেরা তাৎক্ষণিক দুটি পরামর্শ দিয়েছেন। এক. সব স্কুলে যদি নিরাপদ জলের সরবরাহটুকু করা যায়, তাহলে শিশুদের অন্তত পানির ফ্লাস্কটি বয়ে নেওয়ার কষ্টটা থেকে মুক্তি দেওয়া যায়। দুই. ব্যাগের ওজন কমাতে কিছু বই স্কুলে রাখার ব্যবস্থা করা। আর শিক্ষাবিদেরা জোর দিলেন, পাঠ্যবইয়ের বাইরে সম্পূরক, নোট ও গাইড বইকে ব্যাগে ঢুকতে না দেওয়ার ওপর।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্রে জানা গিয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতেও শিশুরা এইভাবে ভুগছে। গত বছর দেশটির ফেডারেল ন্যাশনাল কাউন্সিল সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ভারী ব্যাগ বহনের কারণে শিশুদের মেরুদণ্ডের স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। স্পেনেও আছে একই সমস্যা। দেশটির ‘আর্কাইভস অব ডিজিজ ইন চাইল্ডহুড’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, স্কুলব্যাগের অতিরিক্ত ওজনে শিশুর পিঠে ব্যথা-সহ নানা শারীরিক সমস্যা হয়। একই অবস্থা পাকিস্তানের শিশুদেরও।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *