অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালির ওপর নাগরিকত্বের নামে নির্যাতন শুরু হয়েছে বলে সকলের অভিজ্ঞতা রয়েছে
ঐতিহাসিক “অসম চুক্তি”র ৩৭ বছর পার হয়েছে ইতিমধ্যে । প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের মধ্যে ১৯৭২ সালে এক আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলো। এই চুক্তি “ইন্দিরা-মুজিব” চুক্তি নামে খ্যাত। বাংলাদেশে মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এবং সে বছর ষোল ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসংখ্য হিন্দু বাঙালি স্বদেশ ফিরে গিয়েছিলেন। যদিও মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন প্রায় লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী এক কোটি হিন্দু বাঙালি আসা এই উদ্বাস্তুদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পুনর্বাসন দিয়েছিলেন। রাজ্য গুলি হচ্ছে ক্রমে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, ঝারখণ্ড, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ সহ অসমে নগণ্য সংখ্যক হিন্দু বাঙালিকে পুনর্বাসন দিয়েছিলেন।
ওদিকে, অসমে “বিদেশি খেদা” আন্দোলন শুরু হয় ১৯৭৯ সালের ৮ই জুন থেকে। সারা অসম ছাত্র সংস্থা (আসু) ও সারা অসম গণ সংগ্ৰাম পরিষদ যৌথ ভাবে আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের দাবি, ১৯৫১ সাল কে ভিত্তিবর্ষ ধরে অবৈধ ভাবে অসমে আসা ভাষিক সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালিদের অসম থেকে বিতাড়ন করতে হবে।
পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বের মানুষ এই অভূতপূৰ্ব গণ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার মহন্ত-র নেতৃত্বে চলা এই আন্দোলন কে প্রশমিত করতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী আসু ও গণ সংগ্ৰাম পরিষদের নেতৃত্ব কে কেন্দ্ৰীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে আহ্বান জানান। প্রফুল্ল কুমার ও ভৃগু কুমার ফুকনের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠনের নেতারা কয়েক বার আলোচনার টেবিলে বসা সত্ত্বেও কোনো ফলপ্রসু সমাধান বের হয় নি। কারণ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত গান্ধী ১৯৫১ সাল বা ১৯৬৬ সাল কে ভিত্তিবর্ষ করতে কিছুতেই রাজী হন নি। তিনি এক প্রকার গোঁ ধরে বসে ছিলেন। “ইন্দিরা-মুজিব” চুক্তির কথা মাথায় রেখেছি তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখ টিকেই বিদেশি তাড়ানোর ভিত্তিবর্ষ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রফুল্ল ও ভৃগু তা মানতে নারাজ। ফলে অসমে আন্দোলনের পারদ আরও বেশি চড়তে শুরু হয়।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত হিতেশ্বর শইকীয়া ১৯৮৩ সালে মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন। সে বছর ১৮ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নগাঁও জেলার নেলী তে বেসরকারি মতে প্রায় পাঁচ হাজার মুসলমান মানুষ কে হত্যা করা হয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত গান্ধী এই অমানবীয় ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা দেখে আন্দোলন কারীদের ওপর কঠোর হন। ফলে মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শইকীয়া ছাত্র নেতাদের ওপর দমন নীতি চালাতে শুরু করেন। তখন এমন একটি সময় আসে যে ছাত্র আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর প্রয়াত রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন, তখন অসমের ছাত্র আন্দোলন আবার নতুন উদ্যম শুরু হয়।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী দেশে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের স্বার্থে পাঞ্জাব “লাঙ্গোয়াল” চুক্তি, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে “মিজো চুক্তি” ও অসম আন্দোলন কারীদের সঙ্গে “অসম চুক্তি” সম্পাদন করেন। “অসম চুক্তি”র ক্ষেত্রে ত্রিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কখনও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয় নি। অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালির ওপর নাগরিকত্বের নামে নির্যাতন শুরু হয়েছে বলে সকলের অভিজ্ঞতা রয়েছে। নানা ভাবে, নানা নামে এই জনগোষ্ঠীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। আজও তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। তাঁদের একমাত্র অপরাধ হচ্ছে তাঁরা অসমে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
গত ২০১১ সালের লোকগনণায় ভূমিপুত্র অসমিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ মাত্র পঁচিশ শতাংশ। ১৯৮৫ সালে প্রয়াত কালীপদ সেন ও ব্যারিষ্টার গোলাম ওসমানি অসম চুক্তির বিরোধিতা করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে “সংযুক্ত সংখ্যালঘূ মোর্চা” (ইউএমএফ) রাজনৈতিক দল গঠন করে সংখ্যালঘু রাজনীতির এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। যার দরুন হিন্দু ও মুসলিম বাঙালি মিলে সতেরো জন বিধায়ক ও একজন সাংসদ নির্বাচিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। ব্যারিষ্টার গোলাম ওসমানি ১৯৮৫ সালের ৯ই ডিসেম্বর হোজাই শহরে অনুষ্ঠিত এক সভায় বলেছেন, “আসাম ইজ এ ল্যাণ্ড অফ মাইনোরিটিস”। অর্থাৎ এখানে কোনও জনগোষ্ঠীই সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। প্রয়াত কালীপদ সেন ও গোলাম ওসমানি যে রাজনৈতিক তত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তা কয়েকজন ক্ষমতালোভী নেতার বিশ্বাস ঘাতকতার দরুণই ভেস্তে গেছে। আজ বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানেরা নাগরিকত্বের অধিকার হারাতে চলেছে।
অসমের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মা ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সম্ভবতঃ ৬ই এপ্রিল যোরহাট শহরে “নিউজ লাইভ” এর প্রেক্ষাপট অনুষ্ঠানে প্রশ্ন ত্তোরে বলেছিলেন যে যদি বিজেপি দল আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে, তাহলে আমরা “অসম চুক্তি”র বিরোধিতা করবো। কারণ প্রধানমন্ত্রী কিংবা সারা অসম ছাত্র সংস্থাকে কে অধিকার দিয়েছে এমন চুক্তি করতে? সর্ব ভারতীয় পর্যায়ে এন আর সি-র ভিত্তিবর্ষ ১৯৫১ সাল হয়েছে।
শুধু অসমেই কেনো ১৯৭১ সাল হবে? কেন অসম রাজ্য কুড়ি বছরের অতিরিক্ত বোঝা বহন করবে? সুপ্রীম কোর্টের সাংবিধানিক বিচারপীঠে এ সংক্রান্তীয় একটি মামলা রয়েছে, বিজেপি সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসলে আমরা সুপ্রীম কোর্টে অ্যাফিডেভিট দাখিল করে ১৯৭১ সালের পরিবর্তে ১৯৫১ সাল কে ভিত্তিবর্ষ করতে বলবো। ডঃ শর্মা এটাও বলেছেন যে মানবীয়তার খাতিরে এই কুড়ি বছরে যে অবৈধ বিদেশি এসেছেন, তাদের আমরা অসম থেকে তাড়িয়ে দেবো না। তারা থাকবে খাবে, যদিও তারা নাগরিকত্ব পাবে না।
বলাবাহুল্য, ভূমিপুত্র অসমিয়া জনগোষ্ঠীর প্রতি এমন স্পষ্ট এবং সোজা সাপটা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও হিন্দু বাঙালিরা কোনো গুরুত্ব দেন নি। সিঁদূরে মেঘ দেখেও আৎকে ওঠেন নি। শুধু তাই নয়। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত অটল বিহারী বাজপেয়ীর আমলে ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন হয়েছে। সুচী অনুসারে সে বছর নাগরিকত্ব আইনের রুলস প্রস্তুত করা হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে অসমে এন আর সি করা অনিবাৰ্য হয়ে পড়ছিলো বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের অসমে দুমুখো নীতির জন্যই ২০১৬ সালের নির্বাচনে এমন দুর্দশার সন্মুখীন হতে বাধ্য হয়েছে। অসম চুক্তি সম্পর্কীয় যে কোন আলোচনা ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। কখনও কোন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় নি। কিন্তু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত তরুণ গগৈ ২০০৫ সালের ৩রা মে গুয়াহাটির কয়নাধরা স্থিত মুখ্যমন্ত্রীর বাস ভবনে আসু-র তিনজন নেতা ক্রমে উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল কুমার ভট্টাচাৰ্য, সভাপতি তপন কুমার গগৈ ও সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর প্রসাদ রায় মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত গগৈর সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
এই বৈঠকের সমস্ত ব্যবস্থাপনা তদানীন্তন রাজ্যের প্রতি মন্ত্রী ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মা করেছিলেন বলে গুঞ্জন শোনা গেছে। বিষয় টি সেখানেই শেষ হয় নি। পরদিন অর্থাৎ ৪ঠা মে প্রাইভেট ফ্লাইটে উড়িয়ে তাদের নয়াদিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিঙ অসম থেকে রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। সে সুবাদতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিলো। তাই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত গগৈ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত করতে খুব একটা অসুবিধার সন্মুখীন হন নি। ওই দিনের অর্থাৎ ২০০৫ সালের ৫ই মে তারিখে অনুষ্ঠিত ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় অসমে এন আর সি প্রস্তুত করার শেষ পেরেক মারা হয়েছিলো।
অথচ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিঙ ২০০৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর রাজ্যসভায় উপ প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী কে অনুরোধ জানিয়ে ১৯৭১ সালের পর ভারতে আসা হিন্দু বাঙালিদের রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ম অনুসারে খাদ্য স্বাস্থ্য শিক্ষা পুনর্বাসন ইত্যাদি দিতে অনুরোধ করেছিলেন। একই কথা তিনি ২০০৫ সালের ১০ই মার্চ লোকসভায় বলেছিলেন।তিনি অবশ্য পরে ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান কেন্দ্ৰীয় মন্ত্ৰী সর্বানন্দ সোনোয়ালের আমলে ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মা রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সহ একাধিক দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি কথায় কথায় একদিন স্যাটেলাইট চ্যানেলে বলেছিলেন, “আমিই তো ওই ত্রিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত করার মুখ্য কারিগর ছিলাম”। অবশ্য ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তরুণ গগৈ ভোটের আশায় হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সহানুভূতি আদায় করতে সে বছর ১৬ জুলাই তারিখে এক ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকা অনুসারে যেহেতু পরবর্তী ভোটার তালিকা প্রস্তুত হয়েছে, সে জন্য ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা মতে বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সকল কে নাগরিকত্ব দেওয়া হোক।
এই সিদ্ধান্ত তদানীন্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিঙের কাছে পাঠানো হয়েছিলো বলে জানা গেছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত গগৈকে টিভি চ্যানেলে এটাও বলতে শোনা গেছে যে তিনিই নাকি রাজীব গান্ধীকে অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত করতে রাজী করিয়ে ছিলেন। কারণ তখন তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের সাধারণ সম্পাদক থাকার পাশাপাশি গুজরাটের তত্ববধায়ক ছিলেন। রাজ্য রাজনীতি তে ক্ষমতায় থাকা প্রয়াত হিতেশ্বর শইকীয়ার সঙ্গে অহি-নকুল সম্পর্ক ছিলো বলে স্বজন বিদিত। অসমের ভাষিক সংখ্যালঘু বাঙালি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রায় দু কোটি মানুষের নাগরিকত্ব এখন সুপ্রীম কোর্টের সাংবিধানিক বিচারপীঠে ঝুলছে।
Advertisement
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী এক কোটি হিন্দু বাঙালি আসা এই উদ্বাস্তুদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পুনর্বাসন দিয়েছিলেন। রাজ্য গুলি হচ্ছে ক্রমে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, ঝারখণ্ড, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ সহ অসমে নগণ্য সংখ্যক হিন্দু বাঙালিকে পুনর্বাসন দিয়েছিলেন।
ওদিকে, অসমে “বিদেশি খেদা” আন্দোলন শুরু হয় ১৯৭৯ সালের ৮ই জুন থেকে। সারা অসম ছাত্র সংস্থা (আসু) ও সারা অসম গণ সংগ্ৰাম পরিষদ যৌথ ভাবে আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের দাবি, ১৯৫১ সাল কে ভিত্তিবর্ষ ধরে অবৈধ ভাবে অসমে আসা ভাষিক সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালিদের অসম থেকে বিতাড়ন করতে হবে। পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বের মানুষ এই অভূতপূৰ্ব গণ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেছেন।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার মহন্ত-র নেতৃত্বে চলা এই আন্দোলন কে প্রশমিত করতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী আসু ও গণ সংগ্ৰাম পরিষদের নেতৃত্ব কে কেন্দ্ৰীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে আহ্বান জানান। প্রফুল্ল কুমার ও ভৃগু কুমার ফুকনের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠনের নেতারা কয়েক বার আলোচনার টেবিলে বসা সত্ত্বেও কোনো ফলপ্রসু সমাধান বের হয় নি। কারণ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত গান্ধী ১৯৫১ সাল বা ১৯৬৬ সাল কে ভিত্তিবর্ষ করতে কিছুতেই রাজী হন নি। তিনি এক প্রকার গোঁ ধরে বসে ছিলেন। “ইন্দিরা-মুজিব” চুক্তির কথা মাথায় রেখেছি তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখ টিকেই বিদেশি তাড়ানোর ভিত্তিবর্ষ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রফুল্ল ও ভৃগু তা মানতে নারাজ। ফলে অসমে আন্দোলনের পারদ আরও বেশি চড়তে শুরু হয়।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত হিতেশ্বর শইকীয়া ১৯৮৩ সালে মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন। সে বছর ১৮ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নগাঁও জেলার নেলী তে বেসরকারি মতে প্রায় পাঁচ হাজার মুসলমান মানুষ কে হত্যা করা হয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত গান্ধী এই অমানবীয় ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা দেখে আন্দোলন কারীদের ওপর কঠোর হন। ফলে মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শইকীয়া ছাত্র নেতাদের ওপর দমন নীতি চালাতে শুরু করেন। তখন এমন একটি সময় আসে যে ছাত্র আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর প্রয়াত রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন, তখন অসমের ছাত্র আন্দোলন আবার নতুন উদ্যম শুরু হয়।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী দেশে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের স্বার্থে পাঞ্জাব “লাঙ্গোয়াল” চুক্তি, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে “মিজো চুক্তি” ও অসম আন্দোলন কারীদের সঙ্গে “অসম চুক্তি” সম্পাদন করেন। “অসম চুক্তি”র ক্ষেত্রে ত্রিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কখনও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয় নি। অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালির ওপর নাগরিকত্বের নামে নির্যাতন শুরু হয়েছে বলে সকলের অভিজ্ঞতা রয়েছে। নানা ভাবে, নানা নামে এই জনগোষ্ঠীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। আজও তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা।
তাঁদের অসমে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সংখ্যার হিসেবে সকলেই সংখ্যালঘু। বহু ভাষাভাষী, নানা জনগোষ্ঠী, নানা বৈচিত্রের মাঝে যেন ছোট্ট এক ভারত। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী ১৯৮৫ সালের ১৪ই আগষ্ট মধ্য রাতে ছাত্র নেতা প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ও ভৃগু কুমার ফুকন সহ আন্দোলনকারী দের সাথে “অসম চুক্তি” স্বাক্ষর করেছেন, তখন প্রয়াত গান্ধী এটা মাথায় রেখেছিলেন যে অসমে ভাষিক সংখ্যালঘু বাঙালি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায় সহ অন্যান্য ক্ষুদ্ৰ ক্ষুদ্ৰ নৃগোষ্ঠীয় মানুষের রাজনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আই এম ডি টি (১৯৮৩) আইন টি চুক্তির আওতায় রাখতে হবে। তাই আইএমডিটি আইন বাহাল রেখেই তিনি অসম চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরাও সম্পূর্ণ নিরাপদে এবং স্বস্তিত ছিলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন তদানীন্তন অগপ দলের সাংসদ সর্বানন্দ সোনোয়াল। তিনি ২০০২ সালে আইএমডিটি আইনটি বাতিলের জন্য সুপ্রীম কোর্টে মামলা করেন।
তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্ৰী প্রয়াত তরুণ গগৈ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রীম কোর্টে যে অ্যাফিডেভিট দাখিল করেছিলেন, সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্ৰদায়ের স্বার্থ রক্ষার বিষয় টি গূরুত্ব দিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তী সময়ে রাজ্য সরকার সে বিষয় গুলি মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দেওয়ার দরুণই ২০০৫ সালের জুলাই মাসে আইএমডিটি আইনটি সুপ্রীম কোর্টের এক রায়ে বাতিল হয়ে যায়। অথচ ক্রনোলোজি দেখে বোঝা যায় যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গুলির বিরুদ্ধে কতো বড় ষড়যন্ত্র হয়েছে। “অসম সন্মিলিত মহাসভা” নামের এক সংগঠন অসম চুক্তির ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ সালের পরিবর্তে ১৯৫১ সাল করার দাবি জানিয়ে সুপ্রীম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলো। মুখ্য বিচার পতি বিষয় টি সাংবিধানিক বিচারপীঠে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। গত ২৯ শে আগষ্ট এই মামলা টি সাংবিধানিক বিচারপীঠে সম্ভবত উঠেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ সালের পরিবর্তে ১৯৫১ সাল করা হয়, তাহলে হিন্দু মুসলিম মিলিয়ে অসমে প্রায় দেড় কোটি মানুষ নাগরিকত্ব হারাবেন। প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে ভারতে আসা হিন্দু বাঙালি প্রায় ১১৯২৮ টি পরিবার প্রায় ৯০০০০ মানুষকে পুনর্বাসন দিয়েছিলেন, তাদের কী হবে? পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ সমর গুহ লোকসভায় ১৯৭৫ সালের ২০শে মার্চ লোকসভায় প্রশ্ন করেছিলেন যে ভারতের কোন কোন রাজ্যে কতো ঊদ্বাস্তুকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিলো? উত্তরে কেন্দ্ৰীয় পুনর্বাসন উপমন্ত্রী জি ভেঙ্কটস্বামী জানান, ১৯৭১ সালের আগে ভারতে আসা হিন্দু বাঙালির এগার হাজার নয় শো আটাশ টি পরিবারকে ১৯৭৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত অসমে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। এদের কথা বাদ দিলাম। এখন দেখা যাচ্ছে, ১৯৫১ সালের পরে অসমে আসা মানুষের নাগরিকত্ব হারানোর সম্ভাবনাই বেশি বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন। একজন মানুষের শরীরে যেমন হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি ইত্যাদি থাকে, তবে তাকে সুস্থ বলে ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু যদি কিডনি ও হৃদপিণ্ড কেটে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে ওই মানুষ টি আর বেঁচে থাকতে পারবে না। ঠিক তেমনি আইএমডিটি আইন বাতিলের পর এবার ভিত্তিবর্ষ পরিবর্তন এর জন্য সুপ্রীম কোর্টে মামলা টি এডমিট হয়েছে। অসম চুক্তির অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠে আসছে। তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন সংগঠন যদি অসম চুক্তি টাকেই বাতিল করার জন্য আবেদন করে, তাহলে সুপ্রীম কোর্ট এই আবেদন গ্রহণ করবে কী না সেটাই এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে উঠবে।
(লেখক অসমের বাঙ্গালিদের অধিকার আদায়ের এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব।)