কখনও বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া বিবাদ, কখনও পরিবারের অন্তর্কলহ। কখনও বা আইনি জটিলতা। কলকাতার পুরনো বাড়িগুলি ভুগছে অস্তিত্বের সঙ্কটে। এ ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন ‘ক্যালকাটা হাউজ ওনার্স
“Thus the midday halt of Charnock—
more’s the pity!
Grew a City.
As the fungus sprouts chaotic from its bed,
So it spread—
Chance-directed, chance-erected, laid and built
On the silt—
Palace, byre, hovel—poverty and pride
Side by side;“
প্রায় ১০০ বছর আগে ‘এ টেল অফ টু সিটিজ‘-এ এই ভাষাতেই কলকাতার ছবি এঁকেছিলেন রুডিয়ার্ড কিপলিং। সেই শহরের প্রাচীন ইমারতগুলি আজ অসুস্থ। ক্রমেই বাড়ছে অসুখের মাত্রা বা গভীরতা।
বনেদি কলকাতার ঐতিহ্যবাহি বাড়িঘর বললে চোখের সামনে কোন দৃশ্য ভেসে ওঠে? সিংহ-ওয়ালা সিংহদরজা পেরিয়ে বিরাট সদর, বেলজিয়াম টাইলস-এর মেঝে, বার্মাটিকের আসবাব। সাতরঙা শার্সি যেন কোনও বড় শিল্পী সাজিয়ে দিয়েছেন। দক্ষিণ কলকাতার উজ্জ্বলা সিনেমাহলের পাশেই কালীঘাটের ৪৭/এ, গুরুপদ হালদার রোডের প্রাসাদোপম বাড়িটি ঠিক তাই।
এক বিঘা তিন ছটাক জমির উপরে ৪০টি ঘর, ৪টি ছাদওয়ালা বাড়িটি কলকাতার অন্যতম হেরিটেজ বিল্ডিং। তিন তলা লাল রঙের এই বাড়ির দালান-গম্বুজে যেভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে হুতোমের কলকাতা, তাকে জানতে বুঝতে গেলে ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু ছাত্রের দু’দিন সময় লাগবে। বাড়িটি ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে অন্তিম শ্বাস নিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর বাসস্থান থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে প্রোমোটারের থাবায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে গুরুপদ হালদার নির্মিত স্বপ্নের খাসমহলটি। ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে নির্বাক হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আইনি বিবাদে জড়িয়ে থাকায় মার খাচ্ছে পুরনো বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ
প্রায় ২০০ বছর আগে কালীঘাট মন্দিরের অন্যতম সেবায়েত কেনারাম হালদার বাড়িটি তৈরি করেন। তাঁর ছেলে গুরুপদ হালদার বাড়িটিকে তিলে তিলে সাজিয়েছিলেন। বিদেশ-বিভুঁই থেকে আনিয়েছিলেন শৌখিন সামগ্রী। সে সময় গ্রিকো-রোমান স্থাপত্যের সিংহ সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বাড়িতে লাগানোর চল ছিল। চল ছিল, ইংল্যান্ড থেকে ডেকোরেটিভ সানলাইট গ্রিল আনার। কার্পণ্য করেননি গুরুপদ। খাস কলকাতার অন্যতম প্রধান স্থাপত্যটিকে তিনি নির্মাণ করেন অতি যত্নে। মৃত্যুর আগে উইলে ‘স্ত্রী-ধন’ করে দিয়ে যান গোটা সম্পত্তিটিকে। অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী ছাড়া সম্পত্তিটি সম্পর্কে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। গুরুপদবাবুর স্ত্রী ১৯৫৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ২ ছেলে ও নাতিকে বেশ কিছু বিষয় সম্পত্তি দেন। শুধু বাড়িটিকে দেবোত্তর সম্পত্তি করে দেন। অর্থাৎ বিনা খাজনায় বসবাস, রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলেও তা বিক্রয় করতে পারবেন না কেউ।
সেই সুযোগই নিয়েছেন বাড়ির শেষ প্রজন্ম। ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ ছবিটিরই বাস্তব দৃশ্যায়ন যেন। প্রোমোটারের হাতে বাড়িটি তুলে দিয়েছেন গুরুপদ হালদারের বংশধরেরা। কিন্তু তা কি আইনত সম্ভব? এই জিজ্ঞাসা নিয়েই ২০১৫ সালের ২০ মার্চ নিম্ন আদালতে খোদ বাবার বিরুদ্ধেই ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন এই বংশের কনিষ্ঠতম সন্তান প্রিয়জিৎ হালদার। ২০১৮ সালের গোড়ায় নিম্ন আদালত জানান দেয়, কোনও ভাবেই এই বাড়ি (দেবোত্তর সম্পত্তি) বিক্রয়যোগ্য নয়। প্রিয়জিৎ-এর বাবা হাইকোর্টে মামলা নিয়ে যান। সেই মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই বাড়ির কফিনে শেষ পেরেক।
পুজোর সময়ে যখন আদালতের কাজকর্ম পুরোপুরি বন্ধ, হঠাৎ হামলা চালায় প্রোমোটার। দু’দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলা হয় বাড়িটির ষাট শতাংশ। প্রোমোটারের যুক্তি, মিউনিসিপ্যালিটি অনুমতি দিয়েছে। স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই বোঝা যায় কুযুক্তি, আইনের এক্তিয়ারে থাকা বিষয়ে পুরসভা নাক গলাতেই পারে না।
তবে কি জোর যার মুলুক তার? এই যুক্তিতেই এই শতাব্দীপ্রাচীন স্থাপত্যে হাত বসাচ্ছে প্রোমোটার-চক্র? প্রিয়জিৎ চেষ্টার কসুর করেননি। আইনের পথে সমাধান চাইছিলেন তিনি। কিন্তু সিন্ডিকেট-প্রোমোটার-পরিবার— এই ত্রয়ীর বাহুবলের সঙ্গে লড়ার জোর তাঁর নেই। তাঁর থাকার অংশের জল ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। স্নান-খাওয়ার জন্য তাঁকে বাধ্য হয়ে প্রোমোটারের দেওয়া সাময়িক ভাড়াবাড়িতে যেতে হয়। বাকি সময় আলো-বিদ্যুৎহীন ভাবে কাটে।
এত বড় শহর, এত শিল্পরসিক, এত সমঝদার, সর্বোপরি ন্যায়ের পরাকাষ্ঠা প্রশাসন, কারও চোখেই পড়ল না এই ধ্বংসের নির্মাণ! আশ্চর্য হতে হয় বৈকি। নাকি রাজনীতির নীল সাদা রঙের ধারের কাছে ফিকে হয়ে হয়ে যায় সাতরঙা বেলজিয়াম কাচের ভার? জানা নেই। তবে কিছু আশা এখনও অবশিষ্ট আছে। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক অমিত চৌধুরীর সংস্থা ‘ক্যালকাটা আর্কিটেকচারাল লিগ্যাসি’-র উদ্যোগে সাড়া দিয়েছেন বহু মানুষ। সামান্য হলেও টনক নড়েছে প্রশাসনেরও। হেরিটেজ কমিশন এই জায়গাটিকে ‘হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা’ দিয়েছে। আপাতত সকলেই তাকিয়ে আছে হাইকোর্টের রায়ের দিকে।
কালীঘাটের এই বাড়িটির ব্যাপারে এখনও ক্ষীণ আশার আলো আছে। আইনি সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনও অংশ ভাঙা চলবে না। যদিও বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ক্যালকাটা আর্কিটেকচারাল লেগ্যাসি-র প্রচারে মানুষ কিন্তু যথেষ্ট সচেতন। তারা চান না এমনটা হোক।
গত ২৫ বছরে বহু এমন বাড়ি বিক্রি হয়েছে। তারপর তাকে তুলে দেওয়া হয়েছে প্রোমোটারের হাতে। বাড়ির মালিকের এক্তিয়ার আছে তা বিক্রি করার। কিন্তু প্রোমোটারকে বাড়িটি দিয়ে দেওয়াই একমাত্র সমাধান নয়। কিছু মানুষের বক্তব্য, বাড়ির মালিক সব সময় যে অর্থের প্রয়োজনে বাড়িটি প্রোমোটারের তুলে দেন, তা নয়। এ ব্যাপারে ঔদাসীন্যর অভিযোগ উঠেছে। বাড়িগুলিকে অন্য ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতিটি শহরের তো কিছু চিহ্ন থাকে, তা দিয়েই সেই শহরকে চেনা যায়। কলকাতার এই বাড়িগুলি তার চিহ্ন। সেগুলিকে নষ্ট করলে কলকাতার কোনও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যই আর অবশিষ্ট থাকবে না। এক্ষেত্রে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন আইন তৈরি করা, বলবৎ আইনগুলিকে শ্রদ্ধা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এটা হল মুদ্রার একটা পীঠ। কালীঘাটের এই পুরনো বাড়ি আদৌ রক্ষা করা যাবে কিনা বা গেলেও কত দিন করা যাবে, একমাত্র সময়ই তার উত্তর দেবে। কিন্তু মুদ্রার অন্য পীঠও রয়েছে। এ শহরের পুরনো বাড়িগুলি নিয়ে অজস্র গৃহমালিক সঙ্কটে পড়েছেন। সঙ্কটের মাত্রা কতটা তীব্র, তাঁরা বা তাঁদের ঘনিষ্ঠরা ছাড়া তা অনুভব করা প্রায় কারও সম্ভব নয়। বেশ কিছু বাড়ি জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝেই ঘটছে দুর্ঘটনা।
কেন মালিকরা মেরামত করছেন না? কারণ, পারছেন না। অবিশ্বাস্য কম পুরনো ভাড়ায় ভাড়াটিয়া এবং উপ-ভাড়াটিয়াদের বসবাস। বাজারে সব জিনিসের দাম চাহিদা অনুযায়ী বাড়লেও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে। ফলে, ৩০-৪০ টাকা ভাড়াতেও লোকজন বসবাস করছেন। এই সামান্য টাকায় মালিক বাড়ি মেরামতিতে অপারগ।
এই মুহূর্তে বাড়িওয়ালাদের প্রায় ২৫০ কোটি টাকা রেন্ট কন্ট্রোলের দফতরে জমা আছে। কলকাতা হাইকোর্টের রেজিষ্ট্রার বিতর্কিত বাড়িভাড়া রেন্ট কন্ট্রৌলে জমা দেওয়ার বদলে বাড়িওয়ালার নামে আলাদা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই নির্দেশ কার্যকর হয় নি। ১৯৯৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ বাড়িভাড়া আইনে ভাড়াবৃদ্ধির সব দায়িত্ব রেন্ট কন্ট্রোলারকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে বছরের পর বছর মামলার পাহাড় জমে। একটা মামলা নিস্পত্তি হতে ৮-১০ বছর লেগে যায়। ফলে ভাড়াবৃদ্ধির বিষয়টি তলিয়ে যায় বিশ বাঁও জলে।
কিন্তু কেন এই সমস্যা? কলকাতা পুরসভা ভাড়ার ৪০ শতাংশ হারে পুরকর আদায় করে। এর মধ্যে ভাড়াটিয়া প্রদত্ত ২০ শতাংশ এবং কমার্শিয়াল সারচার্জ রয়েছে। একে ভাড়া যৎসামান্য, তার ওপর করের অর্থ যদি বাড়িওয়ালাকে দিতে হয়, তাঁর পক্ষে সম্পত্তির দেখভাল অসম্ভব। এ কারণে গুরুপদ হালদারের বাড়ির মত কলকাতার পুরনো বাড়িগুলিএকে একে চলে যাচ্ছে প্রমোটরদের হাতে।
পুরনো সব বাড়ি নেওয়ার মত প্রমোটর তো নেই। বাড়িওয়ালারা প্রস্তাব করেছেন, ভাড়াটিয়া প্রদত্ত অংশ তাঁদের কাছ থেকেই পুরসভা আদায় করুক। সম্প্রতি আত্মারাম চৌহান বনাম মহম্মদ আহমেদ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়ে বাড়িভাড়া বাজারদরে করার আইন প্রনয়ণ করতে বলেছে। বিচারপতি দীপক মিশ্র নির্দেশ দিয়েছেন তিন বছর অন্তর ১০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করতে হবে। সম্পত্তিকর পুরোপুরি ভাড়াটিয়াদের প্রদত্ত। বাড়ির রক্ষনাবেক্ষণের খরচও ভাড়ািয়াকে দিতে হবে। এই নির্দেশ কার্যকর করে নতুন আইন প্রনয়ণ করলে পুরনো বাড়ি ভাড়াটিয়াদের দিয়েই রক্ষনাবেক্ষণ করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গ বাড়িভাড়া আইনের ১৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল প্রতি চার বছর অন্তর ভাড়া বৃদ্ধির হার পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আইন লাগু হওয়ার সময় অর্থাৎ ২০০১ সাল থকে আজ পর্যন্ত এই ধারা মোতাবেক বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার পুনর্বিবেচনা করা হয় নি। এই রকম যে একটা আইন আছে, সেটাই সরকার ভুলে গিয়েছে। ফলে, ভাড়াবৃদ্ধির যে ন্যূনতম সুযোগ ছিল, সেটাও অপসৃত। ফলে, বাড়িওয়ালারা কোনও ভাবে ভাড়া বাড়াতে পারছেন না। মেরামতি তাই দুরস্থান।
বাড়ি মেরামতির ক্ষেত্রে অনেক সময় কলকাতা পুরসভা নানা অছিলায় অনুমোদন আটকে রাখে। দিনের পর দিন পুরসভায় আবেদন ফাইলমুক্ত করতে ছোটাছুটি করতে হয় মালিকদের। পুরকর্মীদের পান-সুপুরি খাওয়ানোটাও যেন বাধ্যতামূলক। পুরনো বাড়ির মেরামতির তৎক্ষণাৎ (অন দি স্পট) অনুমোদনের দাবি জানিয়ে লাভ হয়নি। অসৎ পুরকর্মী ও কাউন্সিলরদের অসাধুতা বাড়ছে। ফলে অসহায় বাড়িওয়ালা অনেক সময়ে পূর্বপুরুষের ভিটে হস্তান্তর করে দায়মুক্ত হতে চান।
কলকাতা পুরসভার ১৯৮০-র আইন সংশোধন করে ইউনিট এরিয়া আ্যাসেসমেন্ট চালু করেছে। যার মোদ্দা কথা হল, বর্গফুট অনুযায়ী পুরকর। কিন্তু বর্গফুট-পিছু ভাড়া নির্ধারণ করার ব্যবস্থা নেই। বাগরি মার্কেটে সাম্প্রতিক অগ্নিকান্ডের উদাহরণ তুলে গৃহমালিক সংগঠনের তরফে বলা হয়েছে রক্ষনাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই বলে এই অবস্থা।
কী বলছেন রাজনীতিকরা? বাম আমলে দাদাগিরি করেছেন, রাজনৈতিক পালাবদলের পরে নামাবলী বদলে শাসক পক্ষে যোগ দিয়েছেন, এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক নেতা এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন, বামফ্রন্ট আমল থেকেই ভাড়াটিয়া প্রীতির এই আইনের নেপথ্যে প্রচ্ছন্ন রাজনীতি। হিসেবটা হল, বাড়িওয়ালা একটি পরিবার, কিন্তু ভাড়াটিয়ারা অনেক। তাই, ভাড়াটিয়াদের পক্ষে আইন কর এবং ভোটবাক্সে তার সুদ পেয়ে ক্ষমতায় টিঁকে থাক। তাতে সর্বনাশ বাড়ল।
কিছুকাল আগে ঠিক হয়েছে, জীর্ণ বাড়ি মেরামত করতে প্রথমে বাড়িওয়ালা, তার পর ভাড়াটিয়াকে বলা হবে। দু’পক্ষই অপারগ হলে পুরসভা লোকজন দিয়ে বাড়ি ডেভলপ করাবে। গৃহমালিক সংগঠনের তরফে এর বিরোধিতা করা হয়। প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন যে পুরসভা বাড়িওয়ালার গলায় গামছা দিয়ে বছরে চার বার করে পুরকর আদায় করল, এখন তারাই ‘দালাল‘ হয়ে উঠেছে?
পুরসভার সংশোধনীতে বাড়ি মেরামতির কথা থাকলেও সেই বাড়িতে মালিকের অধিকারের কথা বলা হয়নি। ভাড়াটিয়া বলে যাঁদের কথা বলা হয়েছে, তাঁদের ক‘জন, কোন সুবাদে ভাড়াটিয়া, কত টাকা ভাড়া দেন, নিয়মিত ভাড়াড় বিনিময়ে না দখলদার হিসাবে আছেন— এ সব বিচার করার বিধান নেই। সেক্ষেত্রে এই আইন বাড়িওয়ালাদের গৃহ অধিগ্রহণের নামান্তর।
বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়াদের এই টানাপড়েনের মধ্যে কিছু নামী নির্মাণ সংস্থা পুরনো বাড়ি কিনে নিয়েছে। পুরনো বাড়ি নিয়ে জটিলতার কারণ সব সময় যেবাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়াদের এই টানাপড়েন, তা নয়।
বেশ কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়েছে শরিকি বিবাদে। ঠাকুর্দার তৈরি বাড়ি তিন পুরুষের মধ্যে কীভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে, কে রক্ষনাবেক্ষণ করবে! তা নিয়ে মতানৈক্য।
অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের শরিকরা কর্মসূত্রে বিদেশে বা ভিন রাজ্যে চলে যাওয়ায় বাড়ি তদারকির কেউ নেই। আইনি মালিক থাকলেও তা নিয়ে রয়েছে শূন্যতা, মানে তাঁর দেখা মেলেনা। রয়েছে আইনি জটিলতা। এ রকম অবস্থায় কিছু ক্ষেত্রে ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছে এলাকার ‘দাদা‘। তৈরি হচ্ছে রাজনীতি ও পুলিশের সঙ্গে অশুভ আঁতাত। ঠিকা জমি, দেবোত্তর সম্পত্তিও চলে যাচ্ছে নির্মাতা সংস্থার হাতে। পিএস গ্রুপ, সিদ্ধা, মার্লিন— প্রভৃতি গোষ্ঠী পুরনো নানা বাড়ি কিনে তৈরি করছেন নয়া আবাসন। সাফল্য দেখিয়েছেন। নামী নির্মাতাদের দাবি, তাঁদের কাজ ১০০ শতাংশ আইনসিদ্ধ।
কী বলছে পুরসভা? কলকাতায় বিপজ্জনক বাড়ির স্থায়ী সমাধানে ২০১৭-র ১১ মার্চ বিল পাশ হয় বিধানসভায়। তাতে বলা হয়, বিপজ্জনক বাড়ির সংস্কারে মালিক কোনও ভাবে অক্ষম হলে বাসিন্দা বা ভাড়াটে সেই ভার পাবেন না। সে ক্ষেত্রে কলকাতা পুরসভাই বাড়ি অধিগ্রহণ করে সংস্কার বা পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করবে। তারাই পুরনো বাসিন্দা বা ভাড়াটেদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দেবে এবং মালিকের প্রাপ্য অংশ ও টাকা তাঁর হাতে তুলে দেবে।
কলকাতা পুরসভার বর্তমান আইনের ৪১২ ধারার পাশে ৪১২এ ধারা যুক্ত করতেই ওই সংশোধনী বিল আনা হয়েছিল। বিলটি পেশ করে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানান, এ শহরে হাজার তিনেক বিপজ্জনক বাড়ি রয়েছে। আতঙ্কে রয়েছেন সে সব বাড়ির বাসিন্দারা। নতুন ওই সংশোধনী কার্যকর হলে জীর্ণ বাড়ি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থেকে রেহাই পাবেন কলকাতাবাসী।
এমন একটা বিলের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে বিধানসভায় কলকাতার মেয়র তথা মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি উত্তর কলকাতার একটি এলাকায় বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে দু’জনের মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তাঁর মতে, শহরে এমন ঝুরঝুরে বাড়ি আর যাতে কারও প্রাণহানির কারণ হয়ে না ওঠে, তা নিশ্চিত করতেই এই আইন সংশোধন করাটা জরুরি ছিল।
বিলের নতুন ধারার ব্যাখ্যা দিয়ে মেয়র জানান, পুর প্রশাসন ওই সব বাড়ি চিহ্নিত করে অনেক আগেই সেগুলির গায়ে ‘বিপজ্জনক’ নোটিস টাঙিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওই সব বাড়িতে বসবাসকারী মানুষজন সেখান থেকে সরতে না চাওয়ায় মানবিক কারণে সেগুলি ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়নি। আর আইনেও তেমন কোনও সুযোগ ছিল না।
নতুন ধারায় তাঁদের যেমন প্রয়োজনে সরানোর ক্ষমতা থাকবে পুর প্রশাসনের, তেমনই যাঁদের সরানো হবে, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়েছে। বাড়িটির সংস্কার বা পুনর্গঠনের জন্য প্রথমেই মালিককে প্রস্তাব দেওয়া হবে। তিনি রাজি না হলে পুর প্রশাসন দরপত্র ডেকে ওই কাজে পারদর্শী কোনও সংস্থা বা ব্যক্তিকে সেই কাজের বরাত দিতে পারবে।
পাথুরিয়াঘাটায় জীর্ণ বাড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনার পরে বিশিষ্ট জনেদের নিয়ে কলকাতার পুরভবনে একটি সভা হয়। সমাধানসূত্র বার করতে রাজ্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, বিচারপতি প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি নতুন বিলের খসড়া তৈরি করে। তাতে প্রথমে ছিল, ওই ধরনের বাড়ি সংস্কারে মালিক গররাজি হলে ভাড়াটে (যাঁদের ‘অকুপায়ার’ বলে খসড়া বিলে উল্লেখ করা হয়েছিল) তা সংস্কার করতে পারবেন। মালিক এবং ‘অকুপায়ার’ অক্ষম হলে তখন পুরসভা তার সংস্কারের দায়িত্ব কাউকে দিতে পারবে। আইন দফতরের পরামর্শে নবান্ন খসড়ার অংশে অকুপায়ারের সেই ক্ষমতা কেটে দেয়। অকুপায়ারের হাতে দায়িত্ব গেলে তা নিয়ে মামলা হতে পারে ভেবেই সেটি কেটে দেওয়া হয় বলে খবর। ঠিক হয়, বিপজ্জনক বাড়ির সংস্কার বা পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব পাবেন মালিক। তাতে তাঁরা রাজি না হলে পুরসভা নিয়ম মেনে দরপত্র ডেকে তৃতীয় কোনও পক্ষকে দায়িত্ব দিতে পারবে।
পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানান, ভাড়াটেদের প্রত্যেককে নতুন বাড়িতে জায়গা দিতে হবে। পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে ওই বাড়ির পরিমাণ যত বর্গফুট ছিল, তার সমপরিমাণ জায়গা বাড়তি ছাড় অর্থাৎ ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা এফএআর মিলবে। নতুন আইন হওয়ার পরে পুর প্রশাসন নিয়মাবলী তৈরির কাজ শুরু করবে। কিন্তু গোটা বিষয়টা রয়ে গিয়েছে খাতায়-কলমে।
“সেই মাটিতে গাঁথব আমার শেষ বাড়ির ভিত
যার মধ্যে সব বেদনার বিস্মৃতি,
সব কলঙ্কের মার্জনা,
যাতে সব বিকার সব বিদ্রূপকে
ঢেকে দেয় দূর্বাদলের স্নিগ্ধ সৌজন্যে ;”
বাড়ির ভিতের মধ্যে এ ভাবেই ‘সব বেদনার বিস্মৃতি’ খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রায় শতবর্ষ আগে পূর্বপুরুষের তৈরি বাড়িঘরের পরতে পরতে ছিল অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। আজ অতীতের সেই অনুভূতি অনেকাংশেই যেন ধূলিসাৎ। তবু খারাপ লাগে পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলার দৃশ্যে। আমাদের অনুভূতিকে যেন খামচে ধরে অব্যক্ত একটা ব্যথা।