পটুয়ারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড ও উড়িষ্যা রাজ্যে এবং বাংলাদেশের কিছু অংশে পাওয়া শিল্পী সম্প্রদায়। কিছু পটুয়া হিন্দু, অন্যরা মুসলমান। হিন্দু পটুয়া সম্প্রদায় কলকাতায় কালীঘাট ও কুমারটুলি অঞ্চলে সক্রিয়, পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশেতাদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়ায় পটুয়াদের গ্রামে। সেই গ্রামে গিয়ে খুঁজে পেলাম এক নতুন জগৎ।
এই গ্রামের কয়েকশো মানুষ পেশায় পটুয়া৷ দশ বছর আগেও তাঁরা ভেষজ রংয়ে পট এঁকে জেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন৷ এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টেছে সরকারি সহযোগিতায়৷ এখন দেশ, বিদেশ ঘোরা জলের মতো সহজ হয়ে গিয়েছে৷ বিদেশিদের কাছে ভেষজ পটের কদর থাকায় এঁদের অনেকেই বিদেশে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেন।
মোবিয়া-সরলাবালার দেখা পেয়েছিলাম পশ্চিম মেদিনীপুরের এই নয়ায় পটুয়াদের গ্রামে। এক রবিবার হাওড়া থেকে চেপে বসলাম মেদিনীপুর এক্সপ্রেসে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের খড়্গপুর ডিভিশনে ফুলেশ্বর, উলুবেড়িয়া, বাগনান, কোলাঘাট, পাঁশকুড়া প্রভৃতি ২৮টি স্টেশন ডিঙিয়ে বালিচক। সেখান থেকে বাসে মুন্ডুমারি মোড় ছুঁয়ে নয়া। কলকাতা থেকে গাড়িতে আসতে হলে মেচেদা নিমতৌরি হয়ে আসতে হবে।
নয়ায় পটুয়াদের গ্রামে প্রায় সবাই পটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। সবাই মুস্লিম। পদবী চিত্রকর। মোবিয়ার তিনটি ছেলে— ৬, ১১ ও ১৭ বছরের। ‘কন্যাশ্রী’-র তিন পর্যায়ের একটি পট রোদ্দুরে শুকোতে দিচ্ছিলেন। জানতে চাইলাম, কত দাম হতে পারে এটার? জানালেন, হাজার চার টাকা! প্রথমে সাদা কাগজে ছবি এঁকে তার পর কাপড়ের ওপর চিট দিয়ে সেঁটে দেন।
ইদানীং মাটির সরা বা হাল ফ্যাশনের শাড়িতেও জায়গা করে নিয়েছে পট। পটুয়া জয়া চিত্রকর, ইয়াকুব চিত্রকর, আনোয়ার চিত্রকররা সকলেই মুসলিম। কিন্তু শিল্পীর তো আলাদা জাত থাকে না। তাই খোল বাজিয়ে গেয়ে চলা পটের গানে সাবলীল ভাবেই ফুটে ওঠে রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্যের কাহিনি। ‘পটমায়া’ উৎসবে আলাদা গান মেলারও আয়োজন রয়েছে। মঞ্চে হচ্ছে বাউল গান। মেলার অন্যতম উদ্যোক্তা বাহাদুর চিত্রকর বলেন, “আমাদের মেলার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সরকার নজর দিলে এই মেলার জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।”
ক’ বছর আগে মেলা উদ্বোধনের পর নেপালের কনস্যুলেট রামেশ্বর পাউডেল ও তাঁর স্ত্রী ঊষা পাউডেল গোটা গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। কেমন লাগছে? রামেশ্বর ও ঊষা যেন আপ্লুত। বললে, “খুব ভাল লাগছে। আমাদের নেপালে মঙ্গলীয়রা ‘থানকা’ করেন। তবে সেটা তিব্বতি ধাঁচের। এখানকার পটের সঙ্গে মৈথিলীর যোগ পাচ্ছি। খুব উৎকৃষ্ট মানের কাজ করছেন ওঁরা।” অতিরিক্ত কিছু স্টলে বর্ধমানের ডোকরা, দক্ষিণ দিনাজপুরের মুখোশ, পুরুলিয়ার ছৌয়ের মুখোশ নিয়ে শিল্পীরা এসেছিলেন। দক্ষিণ দিনাজপুরের উৎপল সরকার জানালেন, বাঁশের মুখোশ ২০০ টাকা ও কাঠের মুখোশ ৩০০টাকা।
গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বাইরের দেওয়ালে সুন্দর পটচিত্র। সরকারি উদ্যোগে তৈরি হয়েছে কমিউনিটি সেন্টার বা সংগ্রহশালা। সেখানে প্রাকৃতিক রঙ তৈরি বা পটচিত্র আঁকা শেখার সুযোগ আছে সেখানে।
মোমিন চিত্রকর (ফোন নং ৭৫৮৫৮০২২২৪) জানালেন, এখানে পরিবার প্রায় ৮০টি। লোক সাড়ে তিনশ-র মত। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেও আগ্রহীরা দেখতে বা কিনতে আসেন।
বর্ষায় পটুয়াপাড়ার চরিত্রটা একটু অন্য রকম। পটুয়া গ্রামে সকলেই এই সময়ে ব্যস্ত থাকেন রং সংগ্রহের কাজে৷ বর্ষার সময়েই সব থেকে বেশি সেইসব ভেষজ পাওয়া যায়, যা থেকে রং তৈরি করা যায়৷ রং সংগ্রহের মধ্যেই তাঁদের অনেকে বর্ষার প্রাকৃতিক চিত্র এঁকে চলেন নিজেদের পটে৷ জেলাতে বন্যা তেমন না হওয়াতে বন্যাকে বাদ দিয়ে মাছ, বর্ষার সময়ের পূজ্য দেবদেবী, চাষবাস-এর চিত্র ফুটে ওঠে পটে৷
দুখু চিত্রকর বললেন, “আমাদের কাছে এই সময়টা বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ৷ কারণ, এই সময়েই সবুজের সমাহার সব থেকে বেশি হয়। যে কারণে আমাদের প্রয়োজনীয় রং-দায়ক গাছগুলি এখনই বেশি সংগ্রহ করতে পারি আমরা৷ তাই এটা আমাদের রং সংগ্রহের মাসও বলা যেতে পারে৷” প্রবীন পটুয়া গুরুপদ চিত্রকর বললেন, “আমরা সব সময়েই কমবেশি সবরকমের পট এঁকে থাকি৷ তবে ঋতু অনুসারে পটের চিত্রে একটা প্রভাব থাকে৷ যেমন এখন বর্ষার সময়ে মাছ, চাষ, বন্যা স্থান পায়৷ দুর্গা পুজোর আগে দুর্গার চিত্র আঁকাতে ব্যস্ত সকলেই৷”
একটি কুঁড়েতে ঢুকে দেখি কাজে ব্যস্ত সন্ধ্যা সূত্রধর। জানালেন, এখন বয়স ২৪। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের কাছে শিখেছেন পটের কাজ। ওড়না, শাড়ি, দোপাট্টা ছাড়াও ছবি আঁকেন ছাতা-পাখা-কুলো-ক্যানভাসের ওপর। এগুলিতে সাধারনত ফেব্রিক রঙ ব্যবহার করেন। তবে, পটের ছবিতে ব্যবহার করেন প্রাকৃতিক রঙ।
কীভাবে তৈরি হয় এই প্রাকৃতিক রঙ? কাঁচা হলুদ দিয়ে হলুদ রঙ, চাল ভেজে-পুড়িয়ে কালো, অপরাজিতা ফুল থেকে নীল রঙ, লটকন (জ্যাবরং) থেকে লাল রঙ, এগুলি একটার সঙ্গে অন্যটা আনুপাতিক মিশিয়ে অন্য রঙ। দেখা হল সন্ধ্যার স্বামী তাপস চিত্রকরের সঙ্গেও। ওঁর বাড়ি নারাজলে। মেচেদা স্টেশন থেকে বাসে ঘন্টাখানেকের পথ। এখানে স্ত্রী-র সঙ্গে থেকে গিয়েছেন।
সন্ধ্যা জানান, নারাজলেও অনেকে পটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। গত বছর সেখানে চন্ডীপুরে শুরু হয়েছে পটমেলা। সন্ধ্যার মত ব্যস্ত গুরুপদ চিত্রকর (৯৪৭৪৫৫৯৯৭৯), অমিত চিত্রকর (৯৭৩৩৭৩৭৩১৮),
স্বর্ণ চিত্রকর (৯৭৩২৭৯৯১০৭), রহিম চিত্রকর (৯৯৩২৮৫১৩২১)। ব্যস্ততার কারণ এখানে ‘চিত্রতরু‘ আয়োজিত পটশিল্পীদের মেলা ‘পটমায়া’। এই উপলক্ষে প্রতি বছর এই সময়ে দু‘দিন ধরে নানা রকম গ্রামীণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।গত কয়েক বছরে পট-গ্রাম নয়ার কথা দেশ বিদেশের বহু মানুষের কানে গিয়েছে।
বছরের পর বছর ওঁদের হাতেই ফুটে উঠছে রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গলের ছবি। গাছের পাতা, ফুল, ফলের রং দিয়ে সাজানো সেই পটের ছবিই পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার নয়া গ্রামের শিল্পীদের দেশ-বিদেশে পরিচিতি দিয়েছে। গ্রামে ঢুকলেই মনপ্রাণ ভরে যায়। বাড়ির দেওয়াল থেকে উঠোন, সর্বত্র পটের ছোঁয়া। মেলার সময় শিল্পীরা বাড়ির সামনেই নিজেদের আঁকা পটচিত্রের পসরা সাজিয়ে বসেন। পরিবারের খুদে সদস্য থেকে বাড়ির কর্তা, সকলেই এই শিল্পে সামিল।