ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হলে পঞ্চাশ লাখ থাকলেও পাওয়া যাবে শুধু পাঁচ লাখ

4 - মিনিট |

সামগ্রিক ভাবে যদি ভারতের ব্যাঙ্কগুলো আর্থিক দৃঢ়তা লাভ করে তবে সব মানুষ আরও বেশি উপকৃত হবে। মানুষের সব অর্থই যদি বিমাকৃত হয় তবে আমরা আরও ব্যঙ্কের উপর নির্ভর করতে পারব

অনিমেষ সাহা

সবে মাত্র ব্যঙ্কে ঢুকেছি কয়েক জন জটলা করে আলোচনা করছে। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল,আমাদের ব্যঙ্কের গচ্ছিত টাকার সুরক্ষা কি শুধু পাঁচ লাখ। এতদিন আলোচনা হতো চিটফান্ড নিয়ে। কারণ সেখানে জন সাধারণের কাছ থেকে টাকা তুলে কিছু কোম্পানি তা আত্মসাৎ করেছে।এখন তো ব্যঙ্কে টাকা রেখেও মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।কারণ আইনত আমরা যত টাকাই রাখি না কেন ব্যাঙ্ক যদি দেউলিয়া হয় তবে পাবো কিন্তু পাঁচ লাখ। যা আগে ছিল এক লাখ।তবে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে প্রধান শহরে বসবাস করা প্রচুর মানুষ টাকা রাখে ব্যঙ্কে। এখন ব্যাঙ্ক ছাড়া বাণিজ্যিক লেনদেন হয় না। আর তাতে পাঁচ লাখ থেকে বহু বেশি মুল্যের অর্থ লেনদেন হয়। শুধু তাই নয় সরকারি কর্মচারী থেকে যেকোনো সংস্থা তাদের মাইনে দেয় ব্যাঙ্ক মারফত।তাই ব্যাঙ্কের ভুমিকা বর্তমান দিনে অপরিসীম।

ভারতে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ এটুকু আশা জুগিয়েছিল মানুষের সঞ্চয়ের অর্থটুকু অত্যন্ত নিরপদে রাখা যাবে। ১৯৬৯সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রথম ১৪ টি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করার সন্মতি দেন। এরপর ১৯৮০ সালে আরও ছটি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ সম্পূর্ণ হয়। এই ভরসায় সবাই টু শব্দটি দেশের মানুষ করে নি যে তাদের সঞ্চয়ের টাকা নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রয়েছে। শহর ভারত থেকে গ্রামিন ভারত সবাইকে তাই একটা ব্যাঙ্কের খাতা খুলতেই হয়। আর নতন এনডিএ সরকার আসার পর ব্যাঙ্কে খাতা খোলানোর একটা হিড়িক পড়ে গেল।
এই উদ্যোগের মুল কারণ ছিল ডিজিটালাইজেশন।কিন্তু ধীরে ধীরে একটা বিষয় স্বচ্ছ হয়ে উঠছে যে পরিমাণ অর্থ আমরা ব্যঙ্কে গচ্ছিত রাখা রয়েছে তার একলক্ষ টাকা অব্দি সুরক্ষিত রয়েছে। আর বর্তমান বাজেটে তা পাঁঁচ লক্ষ টাকা করা হয়েছে।
এ বিষয়টা এখনো পরিষ্কার নয় মানুষের কাছে তাদের জমানো নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সুরক্ষিত কিনা। বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারি ব্যঙ্কের মুল্যয়ণ করলে দেখা যাবে বেশিরভাগ ব্যাঙ্ক আর্থিক লোকসানে ভুগছে। ভারতের সব চাইতে বড় ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ছাড়া বেশিরভাগই লোকসানে চলছে। তার কারণ হিসাবে চিহ্নিত হল ব্যঙ্কের ঋন দেওয়া টাকা উদ্ধার না হওয়া। বিগত কয়েক বছরে যে নাম গুলো খবরের শিরনামে ছিল তারা হল কিংফিশার এয়ারলাইন্সের বিজয় মালিয়া, হিরে ব্যবসায়ী নিরব মোদি। তারা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, পিনবি,ইউবিআই প্রভৃতি আরও ব্যঙ্কের থেকে ঋণ নিয়েছিল। শুধু পিনবি নীরব মোদিকে ঋণ দেয় ১৪হাজার কোটি টাকা। বিজয় মালিয়াকে দেয় ৫৯৭ কোটি,উইন সাম ডায়মন্ডকে দেয় ৮৯৯কোটি টাকা যুম ডেভ ল পার পায় ৪১০ কোটি।এরকম বহু সংস্থা আছে যারা ব্যাঙ্ক থেকে ঋন নিয়ে শোধ করে না। সামগ্রিক ভাবে যদি দেখা যায় এরকম দেদার যাচাই করে ঋন দেওয়ার প্রবণতা ব্যঙ্কের মূলধন নষ্ট করে দিয়েছে। আর এই অদৃশ্য কালো হাত যা দেশের মানুষের বিশ্বাস কেও নষ্ট করে দিয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠছে দেউলিয়া হওয়ার।
এখন সরকারি পদক্ষেপ বলতে লোকসানে চলা ব্যঙ্ক গুলোকে এক সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া আর নতুন করে ব্যঙ্কের হাতে অর্থের জোগান দেওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হলো লোকসানে চলা ব্যাঙ্ক গুলোর কর্তারা সেই নতুন পরিস্থিতিতে থাকবেন আর লাভজনক ব্যঙ্ক গুলোর কাধে সেই বোঝা এসে চাপবে।২০০৮সালের ল্যেমন ব্রাদারস এর কথা হয়তো অনেকের জানা।আমারিকার চতুর্থ বিনিয়োগ ব্যঙ্ক হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। তারাই নিজেদের দেউলিয়া ঘোষনা করেছিল।তার মুল কারন ছিল সাবপ্রাইম ক্রাইসিস। যেভাবে ২০০০সালের পর আবাসন ক্ষেত্রে বাজার বৃদ্ধি পেয়েছিল। আর তার জেরে প্রচুর মানুষ ঋন নেয় ব্যঙ্ক থেকে। কিন্তু নতুন আবাসনের দাম হুহু করে পড়তে শুরু করলে ব্যঙ্কের ঋণ শোধ করা বন্ধ হয়।যার জেরে তারা পরে আর্থিক সংকটে। সারা বিশ্বজুড়ে শেয়াবাজারে ধস নামে। আর বিভিন্ন দেশে নেমে আসে আর্থিক মন্দা। যদি ভাল করে আমদের সরকারি ব্যঙ্ক গুলোর বেশিরভাগ ত্রিমাসিক লাভ লোকসানের হিসাব দেখলে পেয়ে যাবেন তাদের লোকসানের বহর। ভারতেও প্রচুর ঋণ নেয় আবাসন থেকে গাড়ি এছাড়াও বহু শিল্পক্ষেত্রের উদ্যোগপতিরা।ইউনিটেকের মতো আবাসন সংস্থা যারা প্রচুর অর্থ jব্যাঙ্ক থেকে নিয়ে শোধ করতে পারেনি।
এখন প্রশ্ন হল এই দায় কার। যারা ব্যাঙ্ককে টাকা রাখল তাদের। যে সমস্ত আধিকারিকদের মাধ্যমে টাকা লেন দেন হল তারা। নাকি সরকার। তবে সরকার তো বলল হবে। আমরাই নির্বাচিত করে সরকারে নির্দিষ্ট দলকে নিয়ে এসেছি। তাহলে যতটা সুরক্ষা আমাদের আমানতের পাওয়ার কথা তা তো পাওয়া গেল না। প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে পুরো আমানত কেন সুরক্ষিত নয়। যেখানে আমেরিকায় ১.৭৫কোটি টাকা ব্রিটেনে ৭৭লক্ষ টাকা, চিনে ৫০ লক্ষ টাকা সেখানে ভারতের মতো দেশ যেখানে প্রচুর মধ্যবিত্ত মানুষ রয়েছে। অসংগতি ক্ষেত্রের মানুষ যারা তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন ব্যঙ্কের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। তাতে সুরক্ষা যদি এরকম হয় কি বিশ্বাসে টাকা ব্যঙ্কে রাখা যাবে। ইতিমধ্যে সরকার রাষ্ট্র‍্যয়াত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে ৩,৫০০০০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে।
আমাদের দেওয়া করের অর্থ তাতে বিনিয়োগ হয়, আর তা আবার দুষ্ট চক্রের হাত ধরে ব্যঙ্কের ঋন মারফত চলে যাচ্ছে নীরব মোদি মেহুল চোস্কিদের মতো মানুষের কাছে। বাজেটের পরের দিন এক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার কি এই সমন্ধে প্রশ্ন করেছিলাম প্রথমেই উত্তর এল আপনার টাকা সুরক্ষিত। আমি জানতে চাইলাম নিয়ম টা কি। উত্তর এল কোনও ব্যাঙ্ক কি দেউলিয়া হতে এখন শুনেছেন। তৃতীয় বার একাই প্রশ্ন করলাম আমি নিয়মটা জানতে চাই। কারন ৫০ লাখ টাকা রাখলেও আমি ৫০ লাখ টাকাই পাব কী? উত্তরটা এবার এল কোটিটাকার। সেটা হল নিয়ম অনুয়ায়ী ৫ লাখ টাকা
পাওয়ার কথাই বলা হয়েছে। কতগুলো তথ্য অনেক প্রশ্ন তুলে দেয়, যেমন ইউকো ব্যাঙ্ক ডিসেম্বর ২০১৯ এর লোক সানের পরিমান ৯৬০.১৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ এর আর্থিক বর্ষে এই ব্যাঙ্কের লোক সানের পরিমান ৪৩২১.১০ কোটি টাকা। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ডিসেম্বরের ২০১৯ লোকসানের পরিমান ৪৯২.২৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ সালের আর্থিকবর্ষে লোকসানের পরিমান ৯৯৭৫.৪৯ কোটি টাকা। এরকম আরও কিছু ব্যাঙ্ক রয়েছে যাদের এই ধরনের লোকসানের বহর লক্ষ করা যায়। এই তথ্যগুলো প্রমান করে কোন পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কগুলো বয়েছে। এবার প্রশ্ন হল এই ব্যাঙ্কগুলো কতটা সুরক্ষিত। এটা ত প্রমাণিত যে এর পেছনে রয়েছে সরকারের আর্থিক সাহায্য। কিন্তু ক্রমাগত লোকসান বেড়ে গেলে আর অসাধু ব্যবসায়ীদের তাড়না বৃদ্ধি মানুষের করের টাকা দিয়ে কতদিন এই লোকসানের প্রকৃত সত্যকে আটকে রাখা যাবে। আর তাতে যদি কোন ব্যাঙ্ক নিজেকে দেউলিয়া ঘোষনা করে তবে ৫০ লাখ থাকলে ও মানুষ পবে শুধু ৫ লাখ। কিন্তু আমাদের দেশে যেখানে বহু মানুষ আর্থিক বিনিয়োগের দিক সম্পর্কে অতটা তথ্য জানা নেই তার
ফলে সামগ্রিক ভাবে বুঝে উঠতে পারে না হঠাৎ করে কি বিপদ তাদের আসতে পারে। তাই ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ মানুষকে যেমন নিশ্চয়তা দিয়েছিল তেমনি মানুষও তার বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের মাধ্যমেই নিজেদের কাজের
ক্ষত্রকে সম্প্রসারিত করেছিল। তাই সামগ্রিক ভাবে যদি ভারতের ব্যাঙ্কগুলো আর্থিক দৃঢ়তা লাভ করে তবে সব মানুষ আরও বেশি উপকৃত হবে। মানুষের সব অর্থই যদি বিমাকৃত হয় তবে আমরা আরও ব্যঙ্কের উপর নির্ভর করতে পারব।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *