ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না
বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না। কিন্তু বাস্তবটা হলো গোটা শিলচর শহর এখন বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছে। দশমীর গন্ডগোল নিয়ে চাপা উত্তেজনা রয়েছে। এবং যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো ঘটনা ঘটতে পারে। এই সত্যটা জানার পরও দেখা যাচ্ছে যাদের এইগুলো সামাল দেওয়ার কথা তারা কিন্তু চুপচাপ। ঠিক চুপচাপ নয়। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। যার ফলে বিষয়টা দিন দিন জটিল হচ্ছে।
অথচ এটা একেবারেই সাধারণ ঘটনা। দশমীর শোভাযাত্রায় একটা মারামারি সংঘটিত হয়েছে। বিয়ারের বোতল দিয়ে কয়েকজন যুবকের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা যদি আমরা খুব সাদা চোখে দেখি তাহলে আইন-শৃঙ্খলা জনিত ঘটনা। পুলিশ তার নিয়মমাফিক যা কাজ করার করবে। সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীদের গ্রেফতার করবে। আদালতে তুলবে। সেখান থেকে যদি তারা জামিন নিতে পারে নেবে
কিন্তু বাস্তবে কি হল দুজনকে ধরে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হলো। এর ফলে যারা মার খেয়েছে তাদের মনে ধারণা হয়েছে এভাবে চললে তো আর আমরা বাঁচতে পারব না। আরো মার খেতে হবে ।পুলিশ অপরাধীদের ধরে ছেড়ে দেবে। এরপরই সব পূজা কমিটি গুলি মিলিত হয়ে প্রতিবাদ জানালো। তাদের বক্তব্য কেন একটি বিশেষ জায়গার পূজা কমিটি বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে। এই সভায় অনেকেই মন্তব্য করেছে নানাভাবে।
যে এলাকার পূজা কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল সেই তপবননগর এলাকার মানুষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়লেন উপস্থিত বক্তারা। এবং তারা যে কথাগুলো বললেন সেখানে গোটা শহরের মানুষের একটা মানসিকতা ফুটে ওঠে। যে মানসিকতা একদিনে তৈরি হয়নি। কেন এই বিশেষ এক এলাকার লোক সব ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা সঙ্গে জড়িত থাকে এই প্রশ্ন তোলা হয়।
স্বাভাবিকভাবে এসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে তপবননগর আশ্রম রোড এলাকায় নাগরিক সভা হলো। সেখানে সবাই এক বাক্যে এই ধরনের বিদ্বেষ মূলক মন্তব্যের প্রতিবাদ জানালেন। কেন একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে কথা বলা হবে এই প্রশ্ন তারা তুলেছেন। ওরা কেউ কেউ উগ্র মন্তব্য করলেও সব বক্তব্যের সুরে ছিল , বিষয়টা সমাধান হোক।
এই যে দুটো সভা হলো দুদিনের ভিতরে, এগুলি যদি আমরা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখব একটা বিভাজন রেখা স্পষ্ট হয়েছে শহরজুড়ে। এভাবে একটা শহর চলতে পারে না। এই বিভাজনটা যদি বাড়তে থাকে তাহলে শিলচরে আগামীতে আরও সমস্যা দেখা দেবে। এই যে প্রতিটি সভায়” আমরা ” “ওরা “শব্দ দুটি বারবার প্রয়োগ করা হচ্ছে এটা কি শহরের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য শুভ হবে? এখানে কারা “ওরা “আর কারা “আমরা”।
সবাই শিলচর শহরের নাগরিক। একটি শহরে এভাবে নাগরিকদের মধ্যে যদি বিভাজন রেখা থাকে, তাহলে এই শহর কর্পোরেশন হয়েই বা কি লাভ। প্রত্যেক পক্ষেরই আত্মসমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। আর শহরের এই সংকটজনক সময়ে আমাদের রাজনীতিবিদ্যার চুপ রয়েছেন এটা অনেক দুঃখের কথা।
বিশেষ করে এখানে শাসক দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে দু তিনটা প্রশ্ন রাখা যায়। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি শিলচর থেকে ৯৯ হাজার ভোট পেয়েছে। এই ভোটের মধ্যে তপবননগর সহ গোটা শিলচরের হিন্দু ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। তারমানে এই দলের দায়িত্ব বর্তায় এই যে একটা টানাপোড়েন চলছে সম্পর্কের,সেটাকে সমাধান করার।
কিন্তু এরকম কোন উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এই যে সভা পাল্টা সভা এসব কিছু প্রয়োজনে ছিল না। যদি পুলিশকে তার কাজ করতে দেওয়া হতো। এটা একটা আইন-শৃঙ্খলার ঘটনা। পুলিশ অপরাধীদের ধরবে। আদালতে পাঠাবে চার্জশিট দেব। ব্যাস আর কোন কথা নেই শহরের মানুষ খুশি। কারণ যে চার পাঁচ জন ব্যক্তি সেদিনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরকে যে তপন নগরের গোটা নাগরিক সমাজ আশ্রয় দিচ্ছেন এমন তো নয়।
তাই এই চার পাঁচজনের জন্য একটা সমাজকে কোন অবস্থায় দায়ী করা যায় না। কিন্তু যখন পুলিশ অপরাধী কে ধরবে না। অপরাধীকে আড়াল করতে যখন এক শ্রেণীর লোক এগিয়ে আসেন, তখন অন্যরাও ভাবতেই পারেন ,দেখছো এদের জন্য আজ আমাদের কি অবস্থা। আর এই ভাবা থেকে নিরাপত্তাহীনতা। আর নিরাপত্তা হীনতা থেকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ। এরপর শহর দুটি গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যাওয়া।
এসব প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে একটি পরে একটি চলতেই থাকবে। এইযে ঘটনা প্রবাহ যার থেকে একটা বিদ্বেষের মনোভাব তৈরি হয়ে যায়, এটা আটকাতে পারেন রাজনীতিবিদরা। কিন্তু তাদের তো কোনো উদ্যোগ নেই। তারা কি চাইছেন ঘটনাটা আরও বাড়ুক। একটা রক্তারক্তি না দেখা পর্যন্ত কি তাদের চৈতন্য উদয় হবে না।
তারা কোন ভোট ব্যাংক রক্ষা করতে চাইছেন? এভাবে চললে তো কোনো ব্যাংকই থাকবে না। একটা ভাতৃ-ঘাতী সংঘর্ষের দিকে শহরকে নিয়ে যাওয়ার আগে আটকানোর দায়িত্বটা তারা কেন নিচ্ছেন না।
শিলচর শহরের একটা ঐতিহ্য রয়েছে সেটা হল সমন্বয়ের ঐতিহ্য। অনেক ঘটনায এই শহরে ঘটেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সেটা রুখে দিয়েছেন। অজস্র উদাহরণ এই শহরে রয়েছে। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজটাই যদি কলুষিত হয়ে যায় তবে রাজনীতি কাকে নিয়ে করবেন।
ইতিহাস এসব ঘটনার সাক্ষী থেকে যায়। বাধ্য হয়ে সাধারণ মানুশ যারা বুদ্ধিজীবী নন, যাদেরকে চেনেন না কেউ তারাই এখন মাঠে নেমেছেন। কারণ সবারই তো শহরে চলাফলের একটা তাগিদ রয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে শান্তিতে ঘরে ফিরব এটা শহরের সব নাগরিকই চান।
তাই আমরাওরা করে শহরটাকে জঙ্গল রাজত্বের পরিণত হতে দেওয়া যায় না। কেন আমরা ওরা এসব প্রশ্ন আসছে, এর উত্তর খুঁজে সমাধান বের করাটা খুব জরুরি। বিশেষ করে শাসক দলের রাজনীতিবিদদের উচিত এ বিষয়ে এগিয়ে আসা। কিন্তু তারা তো এখন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র হয়ে বসে আছে ন। এটাই এখন শিলচর শহরের বিড়ম্বনা।
বিজ্ঞাপন