শিলচর এনআইটিতে সিনিয়রদের দলবদ্ধ হামলায় গুরুতর আহত জুনিয়র ছাত্র

5 - মিনিট |

১৮ ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা – কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে, জানালেন এসপি -দিনের আলোয় হোস্টেলে নেশা করছে একাংশ পড়ুয়া! ‘মাটিতে ফেলে লাথি মেরে মাথায় তিনটি বোতল ভেঙেছে সিনিয়ররা’

চয়ন ভট্টাচার্য

শিলচরের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এনআইটি)-তে প্রকাশ্যে দুই জুনিয়রকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত করলো সিনিয়ররা। দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রটি গুরুতর আহত অবস্থায় শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছে আরেকটি ছাত্র। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরের পরিস্থিতি থমথমে হয়ে আছে তবে কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সেটা ঢেকে ফেলতে। একজন স্থানীয় ছাত্রকে এভাবে মারধর করায় গোটা শহর জুড়ে প্রতিবাদের সুর শোনা যাচ্ছে।

পুলিশ জানিয়েছে ১৮ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে ।শীঘ্রই পুলিশ তদন্ত শুরু করছে।। কাছাড়ের পুলিশ সুপার নোমাল মাহাত্তা জানিয়েছেন এক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় হবে। দোষীরা কোনভাবে নিস্তার পাবে না বলে তিনি জানান। এভাবে একটি জুনিয়র ছাত্রকে অমানবিকভাবে মারধর করায় প্রতিবাদ সংঘটিত হচ্ছে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার উত্তর-পূর্ব সভাপতি বিশ্বদীপ গুপ্ত এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, এভাবে এনআইটিতে কয়েকদিন পর পর স্থানীয় ছাত্রদের উপর আক্রমণ চলে এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। তিনি এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।

সেদিন কি ঘটেছিল – দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রটি শিলচরের বাসিন্দা এবং সে গাড়ি নিয়ে এনআইটি তে গিয়েছিল গত শুক্রবার। কোন একটা কাজে সেখানেই তাকে থেকে যেতে হয়েছিল আর সকালে উঠে দেখে তার গাড়ির চারটি চাকা কেউ ধারালো কোন কিছু দিয়ে কেটে টুকরো করে দিয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে সে জানতে পারে সিনিয়র কয়েকজন মিলে কাজটি করেছে এবং সে তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে। এক সময় কথাবার্তা এমন জায়গায় দাঁড়ায় যেখানে জুনিয়র ছাত্রটি তার সিনিয়রদের বলে ক্ষতিপূরণ না দিলে পুলিশের কাছে বিষয়টি তুলে ধরবে। এতেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সিনিয়ররা। তাকে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বেধরক মারধর করে তারা ফেলে চলে যায়।

ছাত্রটি জানিয়েছে তার মাথায় তিনটি কাঁচের বোতল ভাঙা হয়েছে, তার পিঠে, মুখে এবং শরীরের অন্যান্য জায়গায় শতাধিক ক্ষতের দাগ দেখা গেছে। শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার সিটি স্ক্যান সহ বহু পরীক্ষা হয়েছে শুক্রবার। পরিবারের তরফে থানায় মামলা করার প্রস্তুতি চলছে তবে তারা ভয় পাচ্ছেন যদি এমনটা করলে তাদের ছেলের উপর আবার আক্রমণ হয়। তারা জানিয়েছেন শিলচর এনআইটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর পুলিশে যাওয়ার কথা ভাববেন তবে যেহেতু তাদের ছেলে গুরুতরভাবে আহত, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা আগে করা হচ্ছে।

ছাত্রটি পুরো ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে একটা স্থানীয় এবং বাইরের বলে দলবাজি চলে। যেহেতু বরাক উপত্যকার ছেলেমেয়েদের সংখ্যা পড়ুয়া হিসেবে কম ফলে তাদের নানান হেনস্তার মুখোমুখি হতে হয়। ছাত্রটি বলে, ‘তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আমার গাড়ির চাকা ধারালো বস্তু দিয়ে কেটে দিয়েছিল। যখন খোঁজ নিয়ে তাদের কথা জানতে পারি এবং তাদের কাছে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে কথা বলি তারা সেখানে হঠাৎ করেই স্থানীয় এবং বাইরের ছাত্র বিতর্ক শুরু করে। তারা বলে, স্থানীয়দের দাদাগিরি চলবে না।

STUDENT BYTE

এখানে এই বিষয়টির কোন জায়গা ছিল না, আমি তাদের পরিষ্কার বলে দিই একথা অর্থহীন। তোমরা গাড়ির চাকা কেটে দিয়েছো তার ক্ষতিপূরণ দাও না হলে পুলিশের কাছে যাব। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, নাকে মুখে ঘুসি-চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আরো অনেকেই, আমাকে পেটের মধ্যে লাথি মারে, পেছন থেকে একজন কাচের বোতল আমার মাথায় ভেঙে দেয়। মুখে এবং পিঠে সজোরে মারছিল তারা। একসময় লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। সেখানেও অনেকেই মিলেই আমাকে লাথি মারতে থাকে।

আমাকে তুলে দু’বার আছাড় মারা হয়েছে। একসময় মনে হচ্ছিল আজ আমার জীবনের শেষ দিন। আমাকে বাঁচাতে এক বন্ধু এবং কয়েকজন শিক্ষক এগিয়ে এসেছিলেন কিন্তু তাদের উপরেও হামলা চালায় চতুর্থ বর্ষের ছাত্ররা। রক্তাক্ত অবস্থায় প্রায় যখন জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থায় পৌঁছে যাই, তারা আমাকে ফেলে চলে যায়। আমার এক বন্ধু আহত হয়েছে তবু সে ফিরে এসে আমাকে উঠিয়েছে এবং অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্যে আমরা শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছি।’

তার সহযোগী ছাত্রটি জানায় সে যখন বাধা দিতে গিয়েছিল তাকে পেছন থেকে একজন ধরে ফেলে এবং সামনে থেকে বেশ কয়েকজন থাপ্পড় মারতে থাকে। যখন তার সহযোগী বন্ধুকে আহত অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিল তারা অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। অনেক কষ্টে তাকে নিয়ে শিলচর এনআইটি চত্বর থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয় বন্ধুটি। হাসপাতালে পুলিশের আধিকারিকরা পৌঁছে আহত ছাত্রদের বয়ান নিয়েছেন। তবে এই বিষয়ে তারা প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।

সহযোগী ছাত্র

শিলচর এনআইটি সঞ্চালক ডঃ রজত গুপ্ত এদিন অন্য একটি অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিলেন। এই বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আজ ৩১ মার্চ, অনেক কাজ রয়েছে, এই বিষয়ে এখন কথা বলা যাবে না। আপনারা অন্য কারো সঙ্গে কথা বলে নিন।’ প্রতিষ্ঠানের একটি ছাত্র গুরুতর আহত অবস্থায় যখন শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, প্রতিষ্ঠানের প্রধান এই বিষয়ে কথা বলার মত সময় পাচ্ছেন না। অথচ তার একটু আগেই তিনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে প্রায় এক ঘন্টা আলোচনা করেছেন আরেকটি বিষয় নিয়ে।

শিলচর এনআইটি প্রতিবছর জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন নিরিখে তার রেংকিং উন্নত করে চলেছে। জাতীয় স্তরে যেকোন রেংকিংয়ে বরাক উপত্যকার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এটি, অন্তত পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে। তবে এই প্রতিষ্ঠানে অতীতেও সিনিয়র ছাত্ররা জুনিয়রদের ওপর হামলা করেছে এবং সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ এমনটাই অভিযোগ অনেকের।

গত বছর করিমগঞ্জের এক ছাত্রের উপর হামলা হয়, সিনিয়র রাতের বেলা হোস্টেলে ঠিক একইভাবে তার ওপর হামলা চালিয়েছিল এবং সে পরবর্তীতে বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরে। ছাত্রটি পুরো বিষয়টি এনআইটি কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরে প্রায় এক সপ্তাহ অপেক্ষা করেছিল।

এরপর সে পুলিশের ব্যবস্থা হয়। অথচ এক সময় সে পুলিশের কাছে অভিযোগ তুলে ধরায় তার বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছিল শিলচর এনআইটি কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে তৎকালীন ডিরেক্টর শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় নিগৃহীত ছাত্রটির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবেন না বলে জানিয়ে দেন এবং যে ছাত্রদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তাদের শুধুমাত্র হোস্টেল থেকে চলে যেতে বলা হয়।

উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এভাবে প্রকাশ্যে রেগিংয়ের পর কর্তৃপক্ষ যখন অভিযুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি, বিষয়টি অন্যান্য দুষ্ট বুদ্ধি সম্পন্ন ছাত্রদের মনে সাহস যুগিয়েছে বলেই মনে করেন স্থানীয়রা। তারা বলেন, ‘একটি ছাত্র সহজ করে এত বড় একটা ঘটনা প্রকাশ্যে এনেছিল অথচ এর বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বরং যে ছাত্রের সঙ্গে দুর্ব্যবহার হয় তাকেই হুমকি দেওয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষের তরফে। অন্যান্য দুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন ছাত্ররা সাহস পেয়েছে এবং তারা রাতের অন্ধকারে সূর্যের এন আই টির হোস্টেলে অনেক অপকর্ম করছে।’

গত মাসে হাইলাকান্দিতে মহারাষ্ট্রের অমরাবতী জেলার এক যুবক ড্রাগস পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল, সে শিলচর এনআইটির প্রাক্তনী। সে জানায় পড়াশোনা করতেই বরাক উপত্যকায় আসে, সেখানে থাকা অবস্থায় জড়িয়ে পড়ে ড্রাগস চক্রের সঙ্গে। পুলিশের কাছে যুবকটি জানিয়েছিল, শিলচর এনআইটির অনেক ছাত্রই ড্রাগ সেবন করছে এবং সেটা একেবারে মূল গেটের আশেপাশেই প্রকাশ্য হচ্ছে।

১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বলিউডের বিখ্যাত গায়ক মোহিত চৌহান এনআইটি চত্বরে কনসার্ট করেন, সেখানে বহু ছাত্র স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না বলে অভিযোগ ওঠে। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, বিনোদন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে ড্রাগ সেবন হয়েছে এবং একাংশ ছাত্র ছাত্রীরা সেদিন রাতে অস্বাভাবিক ব্যবহার করেছে।’ এদিন রাতে যখন মোহিত চৌহান স্টেজে ওঠেন এবং তার গানে মুগ্ধ ছাত্রছাত্রীরা গোটা অনুষ্ঠান উপভোগ করেছে।

তবে এর মধ্যে কিছু ছাত্রছাত্রী অনুষ্ঠান উপভোগ না করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এদিকে ওদিকে লুটিয়ে পড়ছিল। কিছু অশুভনীয় মুহূর্ত চোখে পড়েছে শিলচর এনআইটির মতো প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে। যদিও বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ নীরব ছিলেন। কিছু কিছু সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে বিষয়গুলো উঠে এসেছে। যদিও কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মানতে নারাজ। তাদের দাবি ছিল, তারা সপরিবারে গোটা রাত অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন এবং এমন কিছু তাদের চোখে পড়েনি। শুক্রবার দুপুরে যে ঘটনা ঘটেছে এর সঙ্গেও ছাত্রদের প্রকাশ্যে নেশা করার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *