সন্তানদের নিজের স্কুলেই পড়ানো উচিত বলছেন সরকারি স্কুলের শিক্ষকরাই

3 - মিনিট |

সরকারি স্কুলে পড়ে আমার সন্তানরা ইঞ্জিনিয়ার ও শিক্ষক হয়েছে, বললেন শিক্ষক চন্দন শুক্লবৈদ্য

প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের সরকারি কাজে বেশি ব্যস্ত রাখায় ক্ষতি হচ্ছে পড়ুয়াদের

চয়ন ভট্টাচার্য

শিলচর : আলোচনার স্থান কেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু বিষয়বস্তুটা অত্যন্ত গভীরে। সরকারি স্কুলে সরকারি শিক্ষকরা কেন সন্তানদের পড়াতে চান না এবিষয়টা উঠে এসেছিল এই আলোচনায় । আসলে অনুষ্ঠানটি ছিল ১৪৩৭ নম্বর আওলাটিলা প্রাথমিক স্কুলের দুইজন শিক্ষকের বিদায় সংবর্ধনা। আর এই সভায় শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন বক্তার বক্তব্যের সূত্র ধরে আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা।

উপস্থিত শিক্ষকদের মধ্যে যেমন নতুন প্রজন্মের টেট শিক্ষকরা ছিলেন তেমনি পুরনো শিক্ষকেরাও ছিলেন। দুই প্রজন্মের শিক্ষকরাই মনে করছেন প্রাথমিক শিক্ষাকে এতদিন তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে নিজের সন্তানদের সরকারি স্কুলে ভর্তি না করে প্রাইভেট স্কুলে পড়ানোর যে মানসিকতা শিক্ষকদের রয়েছে এটা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষতি করছে।

এটা সবাই স্বীকার করলেন। এসবের মধ্যে সবচাইতে করা যে বিষয়টা বেরিয়ে আসে সেটা হল উদারবন্দের একজন শিক্ষক চন্দন শুক্লবৈদ্য বললেন আমার সব সহকর্মীরা যখন তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছে তখন আমি আমার ছেলে মেয়েদের আমার স্কুলে বা অন্য কোন বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়িয়েছি। বাংলা মাধ্যমে পড়িয়েছেন তার মানে আপনার ছেলে মেয়েরা তো মানুষ হয় নি? জিজ্ঞেস করলেন অনুষ্ঠানের মুখ্য বক্তা।

উত্তরে এই শিক্ষক বললেন মানুষ হয়নি মানে! আমার প্রথম মেয়েটি টেট শিক্ষকের চাকরি করছে। দুই নম্বর ছেলে সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ।তিন নম্বর মেয়ে চাকরি করছে। এ যুগে বাংলা মাধ্যমের পড়িয়েও আমার ছেলে মেয়েরা চাকরি করছে এটা কম বড় কথা নয়। অর্থাৎ শিক্ষকরা তাদের সন্তানদের বাংলা স্কুলে পড়ালেও সন্তান যে মানুষ হবে না এমন কোন কথা নয় । অন্য শিক্ষকরা আবার বললেন যে ,পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা এবং সামাজিক চাপে অনেক সময় নিজেদের সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে দিতে হয়। এই বাস্তব সত্যটাকে অস্বীকার করা যায় না।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রণব কান্তি দাস ১৪৩৭ নম্বর আওলাটিলা স্কুলটাকে যেভাবে সাজিয়েছেন তাতে যে কোন বেসরকারি স্কুলকে হার মানাবে এটা নিশ্চিত। সুন্দর গাছ গাছালী দিয়ে একটি মনরোম পরিবেশ। পড়াশোনার মান ভালো। তার কথায়,বেসরকারি স্কুলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সরকারি স্কুলগুলিও পারবে যদি তারা তাদের মাইন্ড সেটটা বদলায়। আসলে মানসিকতা বদলাতে হবে এটাই বললেন সব শিক্ষকরা। এই অনুষ্ঠানে এছাড়াও অন্য শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন তারাও একই কথা বললেন।

তবে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচাইতে যে বড় সমস্যা সেটা হল শিক্ষকদের শিক্ষার চাইতে অন্য কাজে বেশি লাগানো হচ্ছে। একথা বললেন শিক্ষক দেবকান্ত দাস।তিনি বলেন,একজন শিক্ষক যদি বিএল ওর দায়িত্ব পান তাহলে তিনি পড়াবেন কোন সময়। স্কুলের প্রধান শিক্ষককে হোটেল ম্যানেজারের মত মিড ডে মিলের হিসাব রাখতে হয়।

এভাবে বিভিন্ন স্কুলে দু একজন শিক্ষককে রেখে দিতে হয় এসব কাজের জন্য। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কচিকাঁচা ছাত্ররা। প্রাথমিক শিক্ষায় এর একটা বিরাট প্রভাব পড়ে। এভাবে যদি একজন শিক্ষককে সবসময় অন্য সরকারি কাজ করতে হয় তাহলে শিক্ষার কি হবে। রিপোর্ট বানাতে বানাতেই সময় চলে যায় ।বাচ্চাদের দেখার সময় কোথায়। এসব বাস্তব সমস্যার কথা তুলে বলেন শিক্ষকরা। এই শিক্ষকরা তেমন ইন্টেলেকচুয়াল বলতে আমরা যা বুঝি সেটা নন। কিন্তু তারা যে কথাগুলো বলছেন এটা বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলছেন।

এমনকি ওয়ান ওয়ান ইচ টু থার্টি অর্থাৎ ৩০ ছাত্র কিছু একজন শিক্ষকের যে নিয়ম সেটাও কতটুকু বাস্তব এনিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলেন। ধরুন একজন শিক্ষক তিনটি ক্লাস পড়াতে হলে তার আলাদা রুমের প্রয়োজন । তিনি একসঙ্গে তো আর সব ক্লাস কে পড়াতে পারবে না। এছাড়া সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে ক্লাসরুমের ব্যবস্থা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। একটা হলঘরের মত বড় ঘরে ছাত্রদের পড়াতে হয় শিক্ষকদের। এতে সমস্যা দেখা দেয়।

আরেকজন শিক্ষক বললেন যেদিন রাজনৈতিক নেতারা তাদের ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে পড়াবেন সেদিন শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হবে। তখন শিক্ষক হোক বা কোন সরকারি কর্মচারীও তাদের সন্তানদের সরকারি স্কুলে পড়াতে বাধ্য হবেন। অনুষ্ঠানে এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক প্রদীপ নুনিয়া, বিধান দেব দেবাকান্ত দাস নিলয় নাথ প্রমুখ। সভায় পৌরোহিত্য করেন আব্দুল লতিফ মিয়া। এদিন শিক্ষক অনুপমা সিংহ ও তাহানা বেগম লস্করকে সংবর্ধনা জানান হয়। অনুষ্ঠানে এ ছাড়া বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক শুভ্র কান্তি ভট্টাচার্য ও উত্তম সরকার।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *