অসম কোনদিনই অসমীয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না
দেশভাগের জন্য বর্তমান অসমে বসবাসকারী হিন্দু বাঙালিরা দায়ী মোটেই দায়ী নন। তদানীন্তন কয়েকজন রাষ্ট্র নেতার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার বলি হয়েছেন এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। অথচ অসম চুক্তির দোহাই দিয়ে গত চল্লিশ বছর ধরে লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও মুসলিম বাঙালিদের অমানবিক ভাবে প্রতিনিয়ত হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, “অসম চুক্তি”র ৫(৮) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর অসমে প্রবেশ করা বিদেশি দের আইন অনুসারে শণাক্ত করা হবে এবং বহিষ্কার করা হবে। ভোটার তালিকা থেকে নাম বাতিল করা হবে। এমন বিদেশি দের তাৎক্ষণিক ভাবে এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ৫(৯) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৯৮৩ সালের অবৈধ প্রব্রজনকারী (ন্যায়াধীকরণ দ্বারা নির্ণয়) আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সারা অসম ছাত্র সংস্থা/সারা অসম গণ সংগ্ৰাম পরিষদ এ প্রকাশ করা কিছুসংখ্যক অসুবিধার প্রতি সরকার যথোপযুক্ত বিবেচনা করবে।
৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অসমিয়া মানুষের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ভাষিক পরিচয় এবং ঐতিহ্য রক্ষা, সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য যথোচিত সাংবিধানিক, আইনগত ও প্রশাসনীয় রক্ষা কবচ প্রদান করা হবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, ৫(৯) নম্বর অনুচ্ছেদ কোথাও তো আই এম ডি টি ১৯৮৩ আইনটি বাতিলের কথা বলা হয় নি।
শুধু কিছু অসুবিধার প্রতি সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রাজ্য সরকারের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্ৰী প্রয়াত তরুণ গগৈ সম্ভবত আইএমডিটি আইন টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেন নি বলে জানা গেছে। বিপরীতে অসমের হিন্দু বাঙালিরা কখনও এসব আইন ফাইনের ধার ধারে নি। আইনটি বাতিলের পর প্রয়াত তরুণ গগৈকে এই লেখক প্রশ্ন করার পর তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে মৌলানা বদরুদ্দিন আজমল কেন সুপ্রীম কোর্টে অভিজ্ঞ অ্যাডভোকেট নিয়োগ করেন নি? অবশ্য সম্ভবত বদরুদ্দিন আজমল ইতিমধ্যে এআইইউডিএফ দল খোলার জন্যই হয়তো এতো উষ্মা প্রকাশ করেছেন তিনি।
অথচ কী দূর্ভাগ্য! এন আর সি প্রস্তুত করণের পর ১৯,০৬,৬৫৭ জন মানুষ এন আর সি ছুট। তার মধ্যে প্রায় বারো লক্ষ মানুষ হিন্দু বাঙালি। আধারকার্ড থেকে বঞ্চিত রয়েছেন ২৭,৪৩,৩৯৬ জন মানুষ। ডিটেনশন ক্যাম্পে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। অসংখ্য মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। তথাপি তিন বছর পর আজও কেন্দ্ৰীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর নাগরিকত্ব সংশোধনী ২০১৯ আইনের রুলস প্রস্তুত করতে সক্ষম হয় নি। অনেকের ধারণা, রুলস তৈরি হওয়ার পর এই বিতর্কিত
আইনের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার দরুন, কেন্দ্রীয় সরকার ন্যস্ত স্বার্থে অযথা দেরী করে চলেছে। বলাবাহুল্য, অসমিয়া ও বাঙালির এই সংঘাত দেড়শো বছর পুরোনো বললেও ভূল বলা হবে না। কারণ ১৮২৪ সালে শেষ আহোম রাজা পুরন্দর সিংহ “মার” এর (ব্রহ্মদেশ) আক্রমণে পরাজিত হওয়ার পর ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত করেন ১৮২৬ সালে। তখন থেকে অসম ভারতবর্ষ এর অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী প্রথম কলকাতা আসে ১৭০৭ সালে।
স্বাভাবিক ভাবেই সবার আগে বাঙালিরাই বৃটিশের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। অফিসিয়াল কাজে বাঙালিরা ইংরাজি ভাষার ওপর যথেষ্ঠ পারদর্শিতা দেখাতে পেরেছিলেন। কারণ অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা রামমোহন রায় বাংলার নবজাগরণ এনেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে দেশের প্রচলিত সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করে পাশ্চাত্য দেশের সঙ্গে টেক্কা মারা যাবে না। তাই রাজা রামমোহন রায় বৃটিশ পার্লামেন্টে নিজে গিয়ে ভারতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন করেন।
তাই ভারতের সর্ব প্রথম কলেজ ও ইউনিভার্সিটি কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে। অতএব, অসম বৃটিশের শাসনাধীন হওয়ার পর কলকাতা রাজধানী থেকেই অসমের শাসনকার্য পরিচালনা করা হতো। শোনা মতে, অসমের অফিস আদালতে তখন পার্সি ভাষার প্রচলন ছিলো। কিন্তু অসমে কর্মরত বাঙালি বাবুরা তাঁদের কাজের সুবিধাৰ্থে ১৮৩৬ সালে অসমে বাংলা ভাষার প্রচলন করেন। জানা মতে, ১৮৩৫ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, গভর্ণর জেনারেলের আদেশ অনুসারে ভাষা আইন মতে পার্সি ভাষার পরিবর্তে অসমে বাংলা ভাষা চালু করা হয়েছিলো।
একই সঙ্গে, অবিভক্ত বেঙ্গল প্রভিন্সেও ১৮৩১ সালে পার্সি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার প্রচলন করা হয়েছে। অধ্যাপক প্রবীর কর এর লেখা “Muslim Politics in Assam” নামে প্রকাশিত বইটিতে এ কথার আভাষ পাওয়া যায়। অসমে বাংলা ভাষার স্থায়িত্ব ছিলো ১৮৭২ সাল পর্যন্ত। নাথান ব্রাউনের নির্দেশে ১৮৭২ সালে পুনরায় অসমিয়া ভাষার প্রচলন হয়। ওদিকে, ১৮৭৪ সালে অসমের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সিলেট সহ অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলা কে অর্থাৎ সমগ্র নিম্ন অসমকে অসমের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছিলো।
১৯৫০ সাল পর্যন্ত অসমের অফিস আদালতে অসমিয়া ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষারও প্রচলন ছিলো । প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত গোপীনাথ বরদলৈর নেতৃত্বে ১৯৫০ সালে রাজ্য পুনর্গঠন হয়েছিলো। তখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা রাতারাতি নিজেদের অসমিয়া ভাষী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। যার দরুন ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে অসমিয়া ভাষীর সংখ্যা এক লাফে ৫৬.৭ হয়েছিলো।
পর্যবেক্ষকদের মতে তখন বোড়ো, ডিমাসা, কার্বি ও মিরি মিসিং উপজাতি জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও নিজেদের অসমিয়া ভাষী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮৫ সালে প্রফুল্ল কুমার মহন্ত সরকারের কার্যকালে বোড়ো সম্প্রদায়ের বলিষ্ঠ নেতা প্রয়াত উপেন্দ্ৰনাথ ব্ৰহ্ম কে যথোচিত মর্যদা না দেওয়ার দরুণ এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। একই সঙ্গে তাঁদের মনে বদ্ধমূল ধারণা বাসা বেধেছিলো যে অগপ সরকার এই জনগোষ্ঠীর প্রতি চূড়ান্ত বৈষম্য করছে। ফলস্বরূপে, ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হাজার হাজার বোড়ো জনগোষ্ঠীর মানুষ গুয়াহাটির রাজপথে “ডিভাইড আসাম ফিফটি ফিফটি” শ্লোগান তুলে মিছিল করেছিলো।
এই সংঘাতে পরিণাম ১৯৯১ সালের আদমসুমাড়িতে প্রভাব পড়েছিলো বলে অনেকের ধারণা। ওদিকে, অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতি গ্রহণের পাশাপাশি “ন-অসমীয়া” সেজেও মুসলিমেরা ১৯৮৩ সালে রেহাই পান নি। অবিভক্ত নগাঁও জেলার নেলী-তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনহত্যা সংঘটিত হয়েছিলো। অথচ একজন অপরাধীকেও শাস্তি দেওয়া হয় নি। কারণ অসম চুক্তি মতে সমস্ত অপরাধ জনিত মামলা গুলি রাজ্য সরকার প্রত্যাহার করেছে।
বলাবাহুল্য, অবিভক্ত গোয়ালপাড়া ও সিলেট সহ বৃহত্তর অসমে কোনদিনও অসমিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো না। ১৯০১ সালের আদমশুমারিতে অসমিয়া ভাষীর সংখ্যা ছিলো মাত্র ২২.০ শতাংশ, ১৯১১ সালে ২১.৭ শতাংশ, ১৯২১ সালে ২১.৬ শতাংশ ও ১৯৩১ সালে অসমিয়া ভাষীর সংখ্যা ছিলো ২১.৬ শতাংশ। এ ছাড়াও বৃহত্তর অসমের মোট জনসংখ্যার সুরমা উপত্যকা ডিভিজনে (সিলেট ও কাছাড়) বাংলাভাষীর সংখ্যা ২৮,৪৮,৪৫৪ জন। অসমিয়া ভাষীর সংখ্যা ৩,৬৯২ জন। বিপরীতে অসম উপত্যকা বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ( গারো হিল ও ফ্রন্টিয়ার ট্র্যাক সহ) অসমিয়া ভাষীর সংখ্যা ১৯,৭৮,৮২৩ জন ও বাংলা ভাষীর সংখ্যা ১১,০৫,৫৮১ জন। অর্থাৎ ৩৯ লক্ষ বাংলাভাষীর বিপরীতে অসমিয়া ভাষীর সংখ্যা মাত্র প্রায় ২০ লক্ষ।
মুখ্যমন্ত্রী ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মা যতোই লম্ফজম্ফ করুন না কেন, তিনি ইতিহাস বদলাতে পারবেন না। কিছুদিন আগে ডঃ শর্মা বলেছেন যে ডঃ শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই নাকি ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমিয়া ভাষার বিভাগ খুলে অসমিয়াদের শৈক্ষিক উত্তর ঘটিয়েছিলেন। এসব পালের প্রলাপ মাত্র।
জানা মতে, ১৯১৬ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ভাষাভিত্তিক রাজ্য কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯১৭ সালে তিনি রসরাজ লক্ষীনাথ বেজবরুয়া কে অসমিয়া ভাষী রাজ্য গড়তে আবেদন দিতে বলেছেন। লক্ষীনাথ বেজবরুয়া অসমে এসে অন্যান্য বুদ্ধিজীবি দের সঙ্গে আলোচনা করে অসম কে অসমিয়া ভাষী রাজ্য বানাতে দাবি জানানোর পর সে বছরই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অসমিয়া ভাষী রাজ্য গঠন করেন এবং শোনামতে, তাঁর নির্দেশেই ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমিয়া ভাষার বিভাগ খোলা হয়েছিলো।
মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার আগে অর্থাৎ তিনি যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রী ছিলেন, তখন এক অনুষ্ঠানে লাইভ চ্যানেলে বলেছিলেন যে বরপেটা জেলায় সত্তর শতাংশ মুসলিম মানুষ। বিপরীতে, ত্রিশ শতাংশ হিন্দু। যদিও তার মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ বাঙালি হিন্দু। অথচ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে ৪৫ শতাংশ বাংলাভাষীর সংখ্যা পাওয়া গেছে। তার মানে, মুসলিমেরা সেনসাস বাংলাভাষীর পরিচয় দিয়েছেন। উল্লেখনীয়, ২০১১ সালে লোকগনণা মতে দেড় কোটি অসমিয়া ভাষী ও নব্বৈ লক্ষ বাংলাভাষীর সংখ্যা। অর্থাৎ ৪৮.৩৮ শতাং অসমিয়া এবং ২৮.৯২ শতাংশ বাংলা ভাষীর সংখ্যা।
এক যুবকেরা প্রশ্নের উত্তর ডঃ হিমন্তবিশ্ব একথা বলতেও শোনা গেছে যে আমরা মুসলিমদের অসমিয়া ভাষীর পরিচয় দিতে বলবো না। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করবো, ওরা বাধ্য হয়ে অসমিয়া ভাষীর দেন। তাই এখন অনেকে বলাবলি করছেন যে জেহাদীর অজুহাতে একের পর এক মাদ্রাসা বুলডোজার দিয়ে যেভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে, আসলে কী এটা এক ধরণের ভীতি প্রদর্শন?
উল্টো দিকে, হিন্দু বাঙালিদের নামে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নোটিশ হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে ডঃ শর্মার বিজেপি সরকার। বড় সখ ও আহ্লাদ করে হিন্দু বাঙালিরা বিজেপি কে ভোট দিয়ে মসনদে বসিয়েছিলেন । এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে ভিক্ষা পরে, আগে কুত্তা সামলাই। কারণ আজ ২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২২ সুপ্রীম কোর্ট ভিত্তিবর্ষ ১৯৫১ সাল হবে কী না, তা নিয়ে শুনানি শুরু হয়েছে।
অসমের ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালির ভাগ্যাকাশে ক্রমশই কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে। তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। দেশভাগের পর থেকে বিনা অপরাধে অসমে নানা ঘাত প্ৰতিঘাত নিরন্তর সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন। আজ হিন্দু বাঙালি যাঁরা “আকৌ এবার মোদী সরকার” বলে উদ্বাহু তুলে নেচেছিলেন, তেমন অদূরদর্শি ও অপরিপক্ক বাঙালি দেশভাগের সময়ও ছিলো। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে সিলেট জেলা কে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিলো।
স্বাভাবিক ভাবেই তদানীন্তন অসমের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ অসমিয়া জাতির স্বার্থে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাংলাভাষী ঘন বসতি জেলা টিকে অসম থেকে বাদ দিতে অত্যাধিক সক্ৰিয় হয়েছিলেন। কিন্তু স্বজাতির বিরুদ্ধে যোগেন্দ্ৰ নারায়ণ মণ্ডলও কম যান নি। করিমগঞ্জের পাশেই হবিগঞ্জের অবস্থান রয়েছে। সেখানে হিন্দু বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ওই বাঙালিরা গণভোটে কিছুতেই পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার সমর্থনে ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
যোগেন্দ্ৰ নারায়ণ মণ্ডল এ খবর পেয়ে হবিগঞ্জে গিয়ে হিন্দু বাঙালি দের বোঝানোর চেষ্টা করেন। যদিও ওই গ্রামে হিন্দু বাঙালিরা তাঁকে স্পষ্ট ভাষায় ভারতের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। হবিগঞ্জ থেকে ফেরার পথে বিরাট বড় জলাশয় যাকে পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় “হাওর” বলা হয়, নৌকো দিয়ে ফেরার পথে যোগেন্দ্ৰ নারায়ণ মন্ডল অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন। শোনা মতে, তিনি রাগে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হুসেন সূরাবর্দীর পাকিস্তান পন্থী সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথাবাৰ্তা বলে চলে গেলেন। রাতে তারা অসামরিক পোশাকে হবিগঞ্জ গ্রামে হিন্দু বাঙালি দের বাড়িতে আক্রমণ করলেন।
ওই গ্রামে হিন্দু বাঙালিরা পর দিন ভয়ে আর গণভোটে অংশগ্ৰহণ করতে যান নি। ফলস্বরূপে, সিলেট সহ হবিগঞ্জ পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গেই থেকে গেলো। ওদিকে, পুরষ্কার স্বরূপ যোগেন্দ্ৰ নারায়ণ মন্ডল পাকিস্থান এর আইনমন্ত্রী হন। কিন্তু ভগবান বিরূপ! হিন্দু বাঙালির ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন ও নারী ধর্ষণ দেখার পাশাপাশি নিজে প্রাণের মায়ায় তাঁর লক্ষ লক্ষ সমর্থকদের ফেলে রেখে কলকাতায় পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তাঁর কুকর্মের হাত থেকে অভিশাপ মুক্ত হতে পারেন নি। আমার ভয় হচ্ছে প্রাক্তন বিধায়ক শিলাদিত্য দেবের জন্য। তিনি তো ১৯৫১ সালের পরিবর্তে ১৯৪৮ সাল কেই ভিত্তিবর্ষ করতে তাবেদারি করে আসছেন। নিজের নাক কেটে সতিনের যাত্রা ভঙ্গ করতে চান। তাঁর অবশ্য কলকাতার মধ্যমগ্রামে বিশাল সম্পত্তি রয়েছে। এ ছাড়াও নয়াদিল্লিতেও দুটো সম্পত্তি রয়েছে বলে শুনেছি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কয়েকটি আগাছা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢেউয়ে উতরে গেছেন। যাদের নেতৃত্ব দেওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই বলে অনেকেই মনে করেন।
গত ২৯ শে আগষ্ট থেকে সুপ্রীম কোর্টে সাংবিধানিক বিচার পীঠে নিঃস্ব, অসহায় যাঁরা দুবেলা অন্নের সন্ধানে দিনান্ত কায়িক পরিশ্রম করেন, তাঁদের নাগরিকত্বের ভাগ্য ঝুলে রয়েছে। তাঁরা এ খবরও রাখেন না যে তাঁদের বিরুদ্ধে কী ঘটতে চলেছে? গত ২০১২ সালে ৫৬২/২০১২, ৮৭৬/২০১৪,৩১১/২০১৫ এবং ৬৮/২০১৬ নম্বরে সুপ্রীম কোর্টে মামলা করা হয়েছে। “অসম সন্মিলিত মহাসংঘ” বনাম ভারত সরকার ৫৬২/২০১২ মামলা টি লিষ্টে ছয় নম্বরে রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মহাসংঘের সহযোগী সারা অসম আহোম সভা, দেউরি, চুতিয়া, কৈবর্ত, মিসিং, সোনোয়াল, খামতি, রাভা, গারো ও কোচ রাজবংশীরা মিলে ৮৭৬/২০১৪ নম্বরে মামলা করা হয়েছে। তাঁদের দাবি, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৬ (ক) ধারা সংযুক্ত করার বিষয় টি অবৈধ। নাগরিকত্ব আইন ২০০৩ সালে অনুচ্ছেদ ৪ (ক) যুক্ত করে নাগরিকত্ব পঞ্জীয়ন ও জাতীয় পরিচয় পত্র প্রদান সম্পর্কীয় নিয়মাবলীও অবৈধ বলে প্রত্যাহ্বান জানিয়েছে।
কারণ, এই নিয়মে অধীনেই ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকা অবৈধ বিদেশিরা রেশন কার্ড, গ্রাম প্রধানের সার্টিফিকেটের মাধ্যমে নাগরিক পঞ্জীতে নাম সন্নিবিষ্ট করতে পারবে। এ ছাড়াও, ৬৮/২০১৬ নম্বর মামলায় বিদেশি আইন ১৯৪৬ এর অধীনে বিদেশি আদেশ ১৯৪৮ এর সংশোধন করে ৩ (ক) যুক্ত করার পাশাপাশি পাসপোর্ট আইন ১৯২০ এর অধীনে রুলস ১৯৫০ সংশোধন করে রুলস ৪ উপ বিধি (১) যুক্ত করে ২০১৫ সালের সাত সেপ্টেম্বর জারি করা অধিসূচনা অবৈধ বলে প্রত্যাহ্বান জানিয়েছে।
এই অধিসূচনা মাধ্যমে দেশের ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি কে কুঠারাঘাত করে শুধু হিন্দু বিদেশি কে নাগরিকত্ব প্রধানের ব্যবস্থা করেছে। সুপ্রীম কোর্টের মুখ্য বিচারপতির উদয় উমেশ ললিতের নির্দেশে পাঁচ জন সদস্য বিশিষ্ট বিচারপতির দ্বারা সাংবিধানিক বিচারপীঠে গত ২৯ আগষ্ট থেকে শুনানি শুরু হয়েছে। গত ২৭ আগষ্ট থেকে মাত্র চুয়াত্তর দিনের জন্য মুখ্য বিচারপতির কার্যকাল। তার আগেই এই পঁচিশটি মামলা রায়দান সম্পন্ন করবে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছেন।
উল্লেখনীয়, পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু ১৯৫০ সালে Immigrants Expulsion from Assam 1950 Act এর ২ (খ) অনুসারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের বলি হয়ে আগত হিন্দু বাঙালিরা নাগরিকত্ব প্রধানের আইন লোকসভায় প্রণয়ন করেছিলেন। এখন এই আইনটি বাতিলের দাবি তোলা হয়েছে। ওদিকে, ২০১৫ সালের সাত সেপ্টেম্বর কেন্দ্ৰীয় সরকার যো জোরা নোটিফিকেশ্যন জারি করেছিলো, সেটা বাতিলের দাবি তোলা হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে বিজেপি সরকার হিন্দু বাঙালি দের সন্তুষ্ট করতে একদিকে যেমন নোটিফিকেশ্যন জারি করেছে, অন্যদিকে, এই নোটিফিকেশ্যন বাতিল করার ব্যবস্থাও করেছে?
গত শনিবার শোণিতপুর জেলার বরসলা বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত তিন নম্বর চিতলমারি গ্রামে তিনশো বাড়ি ঘর ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মার সরকার বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। এক হাজার বিঘা সরকারি জমিতে তাঁরা বসবাস করছিলেন। তার মধ্যে ৫৪ টি পরিবার হিন্দু বাঙালি। চিরাং জেলার বিজনী শহরে হিন্দু বাঙালি পরিবারের এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঊনত্রিশ বছর পর ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নোটিশ পাঠিয়েছে এই সরকার। মুখ্যমন্ত্রী এখন হিন্দু বাঙালি ও মুসলিমদের প্রতি প্রতিশোধ প্রায় হয়ে উঠেছে বলে সর্বত্রই চর্চিত হচ্ছে।
সারদা কেলেঙ্কারিতে তাপস পাল, মাতঙ সিং, রঞ্জনা সিং ও প্রাক্তন সাংসদ কুনাল ঘোষ সহ অনেকেই জেল খেঁটেছেন। একমাত্র ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মাই সি বি আইয়ের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কয়েক বছর আগে কলকাতার তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সিবিআই – র দল তাঁর বাড়িতে আসার প্রেক্ষিতে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে বচসা বাধে। এমন কী সিবিআই কে ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হয় নি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সিবিআই কার্যালয়ের সামনে দিনজোরা ধর্ণা দিয়েছিলেন। তিনি সুদীপ্ত সেনের চিঠির প্রতিলিপি মিডিয়ার সামনে তুলে ধরে বলেছিলেন, ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মাও তো সুদীপ্ত সেনের কাছে থেকে তিন কোটি টাকা নিয়েছিলেন, তাঁকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? অবশ্য বিশিষ্ট আইনজীবী দের মতে যেহেতু কুনাল ঘোষ কলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে সুদীপ্ত সেনের চিঠির সার্টিফায়েড কপি বের করেছেন, সেখানে অবধারিত ভাবে ডঃ শর্মার নাম থাকাটা একপ্রকার নিশ্চিত। সারদা কেলেঙ্কারির বিচার হচ্ছে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে কলকাতা হাইকোর্টে ।
সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিঙে ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মার সঙ্গে চা- বিস্কুট খাওয়ার পরিবর্তে কলকাতা হাইকোর্টে ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মা কেও তদন্তের আওতায় আনার দাবিতে রিট পিটিশান বা পিআইএল করছেন না কেন? এমন প্রশ্ন অসমের হিন্দু বাঙালির মনে আসতেই পারে। সুদীপ্ত সেনের টাকা খেয়ে সবাই জেল খাটবে। আর তুমি হরিদাস পাল বিজেপি তে যোগদান করে বেঁচে যাব?
অসমের হিন্দু বাঙালির পিঠ আজ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তূণ থেকে তীঁর বেরিয়ে গেলে যেমন ফিরিয়ে আনা যায় না। ঠিক তেমনি অসমের হিন্দু বাঙালিরাও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অপরিপক্কতার দরুণ আজ নাগরিকত্ব হারানো পথে এগিয়ে যাচ্ছেন।
(লেখক অসমের বাঙ্গালিদের অধিকার আদায়ের এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব।)
Advertisement
Above article explains the real problems of the Bengali Hindus.The writer of the article is an experience revoulutinist n fighting for the the cause of Bengali Hindus since 35yrs as known to the people of Assam.He was the pioneer of Samagra Bengali Yuva parishad almost three decades ago.He always speaks for the interest of Bengalis.people from the Bengali community should support n realise his views.