রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন ও মহম্মদ ইউনুসের পর আরও এক আদ্যন্ত বাঙালি পেতে চলেছেন এই সর্বোচ্চ সম্মান। দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য এই সম্মান দেওয়া হচ্ছে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে…
The 2019 Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences in Memory of Alfred Nobel has been awarded to Abhijit Banerjee, Esther Duflo and Michael Kremer “for their experimental approach to alleviating global poverty.”#NobelPrize
ভেবেছিলাম কোনও প্রবীণ অর্থনীতিবিদ পাবেন। পয়ষট্টি বা সত্তরের পরই তো সাধারণত পান। আটান্নতে পাব ভাবিনি। তবে স্বীকৃতি পাওয়া নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। একদিন পাবই, বিশ্বাস ছিল। তবে এত তাড়াতাড়ি পাব, সত্যিই ভাবিনি। —নোবেল প্রতিক্রিয়া অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
‘ছেলে নোবেল জিততে পারে ভাবিনি’, আবেগতাড়িত অভিজিতের মা
অর্মত্য সেনের পর অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন আমেরিকায় বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৯-র অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার মোট তিনজনকে দেওয়া হচ্ছে। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও যৌথভাবে এই পুরস্কার পাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী এসথার ডাফলো ও মাইকেল ক্রেমার।
গত দু’দশক ধরে দারিদ্র দূরীকরণে নিরলস গবেষণা করছেন ওই তিনজন। তাঁদের নতুন পরীক্ষাভিত্তিক পদ্ধতির জন্য অনেক পরিবর্তন এসেছে উন্নয়নের অর্থনীতিতে। এর মাধ্যমে গবেষণার নতুন নতুন দিক খুলে গিয়েছে। সারা বিশ্বের ৭০ কোটি মানুষ অতি দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন। প্রতি বছর ৫০ লক্ষের বেশি শিশু তাদের পাঁচ বছরের জন্মদিনের আগেই মারা যাচ্ছে। এই অবস্থায় তিনজন অর্থনীতিবিদের গবেষণা তাঁদের জীবনের মানোন্নয়নে সহায়ক হবে। সেই কারণে তাঁদের নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যেকেই এই সাফল্যের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
তাঁর গবেষণার একটা বড় অংশ রয়েছে বীরভূমকে ঘিরে। সেখানে দারিদ্র দূরীকরণ নিয়ে নানা কাজ করেছিলেন। গবেষণায় দারিদ্রের নয়া সংজ্ঞা খুঁজে বের করেছেন। তাঁর কথায়, ‘দারিদ্রকে শুধু ক্রয়ক্ষমতার আলোয় বেঁধে রাখার চেষ্টা করিনি। বরং বলা চেষ্টা করেছি, দারিদ্র মানে কোনও একটা সমস্যা নয়। অনেকগুলো সমস্যার সমাহার। ভুল ডাক্তারের কাছে যাওয়াটাও দারিদ্র। তথ্য কম থাকাটাও দারিদ্র।‘
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, সরকারও বুঝতে পারছে অর্থনীতির হাল ভালো নয়। বিগত বছরগুলোর তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতি যথেচ্ছ খারাপ। যা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির সামনে একটা বড় সংকট। মুদ্রাস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী দারিদ্র দূরীকরণে বিরল গবেষণা করার জন্য পুরস্কার পাচ্ছেন ওই তিন অর্থনীতিবিদ। ১৯৯৮ তে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বাঙালি অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন। তার ঠিক ২১ বছর বাদে পেলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৬১ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান। আর মা নির্মলাদেবী ছিলেন সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতার অর্থনীতি বিভাগের একজন অধ্যাপক। বাবা ও মা দু’জনেই অর্থনীতির মানুষ হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই এই বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল অভিজিৎবাবুর। তাই সাউথ পয়েন্ট স্কুলের পালা সাঙ্গ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে ভরতি হন। সেখান থেকে ১৯৮১ সালে অর্থনীতিতে বিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৩ সালে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেন। ১৯৮৮ সালে পিইচডি জন্য ভরতি হন ইংল্যান্ডের হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি আমেরিকার এমআইটির ফুড ফাউন্ডেশনের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক।
সন্তানের সাফল্যে গর্বিত নোবেলজয়ীর মা। আবার পুত্রবধূও একই কৃতিত্বের অধিকারী। তাই কলকাতার হিন্দুস্থান পার্কের বাড়িতে বসে ছেলে এবং তাঁর স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে গর্বিত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছেলের সাফল্যে গর্বিত মা। একটাই কথা তাঁর মুখে, ছেলে যে এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে তা যেন ভাবতেই পারিনি।নির্মলাদেবী নিজেও একজন অর্থনীতিবিদ। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবাও অর্থনীতির অধ্যাপক। নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ছোট থেকেই আমার ছেলে অত্যন্ত মেধাবী। সাউথ পয়েন্টেই পড়াশোনা করে। সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে পড়ার আগ্রহ দেখায় অভিজিৎ। তাই ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভরতি হয়েছিল। কিন্তু এরপর পড়াশোনা এবং গবেষণার জন্য অর্থনীতিকে বেছে নেয় ছেলে। মায়ের কথায় অল্প বয়স থেকে অর্থনীতির মতো কঠিন বিষয়কে বেশ ভালবেসে ফেলেছিলেন নোবেলজয়ী। খুব সহজেই নাকি সকলকে অর্থনীতির মতো জটিল বিষয়ও বুঝিয়ে দিতে পারতেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ক্ষমতা এবং মেধাই হয়তো নোবেল জয়ের পথকে আরও সুগম করেছে বলেই দাবি মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
মায়ের কথায়, হাত ধরে কিছুই শেখাইনি ছেলেকে। আমার মনে হয় যা বাবা-মা করেন তা একটা শিশু দেখে শেখে। তেমনই আমরাও অর্থনীতি নিয়ে বেঁচেছি। তাই হয়তো ছেলেও তাই করেছে। তবে ও যে নোবেল জয় করতে পারে তা ভাবিনি। প্রায়ই ওর সঙ্গে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয় আমার। কোনও কোনও সময় আমি বলি এটা নিয়ে কাজ করতে পারো বা ওটা নিয়ে করতে পারো। তাতে অবশ্য আমার ছেলে হ্যাঁ-ও বলে মাঝে মধ্যে।