মহারাষ্ট্র কুর্সি দখলে কূট-রাজনীতি

3 - মিনিট |

সরকার গড়তে আদালতে দেওয়া হল দেবেন্দ্র ফড়নবীশের তরফে রাজ্যপালকে দেওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার চিঠি এবং অপরটি হল রাজ্যপালের ফড়নবীশকে সরকার গড়তে আমন্ত্রণ জানানোর চিঠি

শ্রীজীব

মহারাষ্ট্রের কুর্সি দখল ঘিরে এখন কূট-রাজনীতি তুঙ্গে।ফল প্রকাশে দেখা গেল বিজেপি এককভাবে কোথাও ক্ষমতাদখলের মতো জায়গায় নেই। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা সরকার হবে। কেননা সেখানে ঘোষিত জোট। তবে মাথাব্যথার কারণ হতে পারে হরিয়ানা। কিন্তু সেখানেও সংকট তৈরি হল না। অমিত শাহর চাণক্যগিরিতে বোল্ড হয়ে গেলেন জনতা পার্টির নেতা দুষ্যন্ত চৌতালা। দশটি আসনে জয়ী হয়েও তিনি বিজেপিকে সরকার গড়তে সাহায্য করলেন। এবং নিজে উপমুখ্যমন্ত্রী পদ নিলেন। উলটোদিকে মহারাষ্ট্রে সহজেই সরকার গড়া হয়ে যাবে বলে এমনটাই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু ফল ঘোষণার পর বেঁকে বসল শিবসেনা। তারা দাবি করল, আমরা আধাআধি ভাগ চাই। আড়াই বছর কুর্সিতে থাকবে বিজেপির কেউ আর বাকি আড়াই বছর কুর্সি থাকবে শিবসেনার হাতে। নরমসরম রাজনীতিক উদ্ধব হঠাৎই ছেলেকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য নাছোড় হয়ে উঠলেন। শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরেকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন তিনি আগ্রাসী নন। অথচ তিনি মরিয়া হয়ে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি দখলে।

এদিকে ফলপ্রকাশের পরই হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠেন উদ্ধব ঠাকরের স্ত্রী রশ্মি ঠাকরে। তিনিও দীর্ঘদিন রাজনীতিকে কাছ থেকে দেখেছেন। একটা সময় শিবসেনায় সংকট তৈরি হয়েছিল। বালাসাহেব-পরবর্তী সময়ে দলের নিয়ন্ত্রণ কার দিকে যাবে? ছেলে উদ্ধব, নাকি ভাইপো রাজ?  রাজ অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন। দলের কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও তাঁর বেশি।এদিকে উদ্ধবের রাজনীতিতে মন নেই। তাঁর শখ ফোটোগ্রাফিতে। সেটাই তাঁর ভালোলাগার জগৎ। কিন্তু রশ্মি সেদিন প্রভাব খাটিয়ে দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এলেন উদ্ধবের দিকে। শেষমেষ শিবসেনা ভাঙল। রাজ গড়লেন। রশ্মি এদিকে একজন রাজনীতিক হিসেবে গড়ে তুলতে লাগলেন উদ্ধবকে। বালাসাহেবের অনুগতদের বেরোতে দিলেন না রাজের দিকে। নিজেই থেকে গেলেন আড়ালেই। কিন্তু শিবসেনার সকলেই জানেন আড়ালে থাকলেও তিনি দলের একজন বড় নীতিনির্ধারক। রাজনীতির অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তাঁর অনায়াস পদক্ষেপ। দলের সবাই তাঁকে ডাকেন ‘বহিনি-সাহিব’ বলে। কিন্তু আসলে তিনি দ্বিতীয় ‘মা-সাহিব’। প্রথম মা ছিলেন বাল ঠাকরের স্ত্রী মীনা ঠাকরে। আর এখন তিনিই দ্বিতীয় মা। বহু ক্ষেত্রেই দল তাঁর নীতি অনুসরণ করে চলে।

ফলপ্রকাশে দেখা গেল তিনিই ঠিক করছেন কী হবে, কার সঙ্গে দল কথা বলতে হবে ইত্যাদি। তিনিই প্রথম আড়াই বছর করে ক্ষমতা দখলের কথা বলেন। বিজেপি তা অস্বীকার করে। তখনই রশ্মিই ঠিক করেন, পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় বসবেন তাঁর স্বামী উদ্ধব। এজন্য যে সংখ্যা দরকার, তা নেওয়া হবে কংগ্রেস ও এনসিপির কাছ থেকে। দলের সকলকে বলে দেওয়া হল, প্রেসের কাছে কেউ মুখ খুলবেন না। যা বলার একা সঞ্জয় রাউতই বলবেন। সঞ্জয় দলের খুবই বিশ্বস্ত এবং অনুগত। ঘটনার দু’দিন আগে মাত্র তাঁর অ্যাঞ্জিওপ্ল্যস্টি হয়েছিল। সেই অবস্থায় দলের নির্দেশকে মাথা পেতে নিয়ে নেমে পড়লেন কাজে।

এদিকে ঘটনাবশত কেন্দ্রে বিজেপি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন শিবসেনার অরবিন্দ সাওয়ান্ত। এটাই রশ্মির কাছে হয়ে উঠেছিল মোক্ষম চাল। তিনি বিজেপিকে ধাক্কা দিতে শিবসেনার এক নম্বর হয়ে ওঠার পথ খুঁজলেন।
শুরু হয়ে গেল সরকার গড়ার নাটক। দু’পক্ষই তৎপর হল। কিছু খেলা চলল প্রকাশ্যে, আবার কিছু চলল গোপনে। বিভিন্ন দলের মধ্যে আলোচনা যেটুকু চলতে লাগল, সবটাই দলীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে। মানুষ যে সমীকরণ দেখে ভোট দিয়েছিলেন, ভোটের পর সেই সমীকরণ বজায় রাখার ইচ্ছে কারও দেখা গেল না। পক্ষের ভোট এবং বিরোধী ভোট জট পাকিয়ে ফায়দা তুলে ক্ষমতা দখলের সেই পুরনো খেলা চলতেই লাগল।
যখন কুর্সি দখলের লড়াই টানটান উত্তেজনায় ঠিক তখনই মোক্ষম চাল দিলেন শরদ পাওয়ার। তিনি দেখা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। সেদিন মিটিং থেকে বেরিয়ে পাওয়ার বলেছিলেন, ‘আমাদের আলোচনা হয়েছে কৃষি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে।’ আশ্চর্য, এমন একটা মিটিং হল, অথচ সেখানে পাওয়ারের দলের কেউ নেই। মোদির সঙ্গেও কেউ ছিলেন না। এমনকী কৃষি নিয়ে আলোচনায় ডাকা হয়নি দেশের কৃষিমন্ত্রীকেও। অনেকেরই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল। কেননা পাওয়ার রাজনীতিতে এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি কখন যে কী করবেন, কেউই জানেন না। তার আগে সংসদের অধিবেশনের শুরুতে মোদি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন দুই দলের। নবীনের বিজেডি এবং শারদের এনসিপি-র। পরিষ্কার হল জল কোনদিকে গড়াচ্ছে।

বহুযুদ্ধের, বহু ওলোটপালোটের ঘোড়া হলেন পাওয়ার। অজিত রাতারাতি ডিগবাজি খেলেন আর পাওয়ার তার কিছু জানতে পারলেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য! এমন অতর্কিত চালে পাশা উলটে দেওয়ার ইতিহাস পাওয়ারের আছেই। সেটা ১৯৭৮ সাল। তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বসন্তদাদা পাতিল। উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নাসিকরাও তিরপুরে। আর এই সরকারের মন্ত্রিসভায় শ্রমমন্ত্রী ছিলেন শারদ পাওয়ার। কাকপক্ষী টেরও পেল না, একদিন হঠাৎ করে দান পালটে সরকার ফেলে পাওয়ার হয়ে গেলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সেই খেলাই পাওয়ার ভাইপোকে দিয়ে খেললেন না তো!

এদিকে শুনানি শুরু হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। আজ আদালতে দু’টি চিঠি জমা দেওয়ার কথা কেন্দ্রীয় সরকারের। যার মধ্যে একটি হল দেবেন্দ্র ফড়নবীশের তরফে রাজ্যপালকে দেওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার চিঠি এবং অপরটি হল রাজ্যপালের ফড়নবীশকে সরকার গড়তে আমন্ত্রণ জানানোর চিঠি। চিঠি জমা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের তরফে আরও সময় চাওয়া হল। কিন্তু আদালত সেই আর্জি গ্রহণ করেনি। এদিকে আবার আস্থাভোটের দাবি জানায় বিরোধীরা। তবে সে-দাবিও গৃহীত হয়নি শীর্ষ আদালতে। এতে নৈতিক জয় হয়েছে বলে দাবি করতে শুরু করেছে বিজেপি। এরমধ্যে এদিন সকাল দশটা নাগাদ বিধায়কদের সমর্থনের চিঠি নিয়ে রাজভবন পৌঁছে যান এনসিপি-কংগ্রেস এবং শিবসেনার এক প্রতিনিধি দল।সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্য়াগরিষ্ঠতা রয়েছে বলে তাঁরা দাবি তুলেছেন।অন্যদিকে মহারাষ্ট্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরোধিতায় আদালতে যৌথ পিটিশন করেছে শিবসেনা-এনসিপি এবং কংগ্রেস।

এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, মহারাষ্ট্র কুর্সি দখলে কোন খেলা অপেক্ষা করছে। দেখার, ক্ষমতা দখলের কূট-কৌশলে কতটা মজে দেশের মানুষ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related news