সারা দেশে এখন একটা শব্দ তাড়া করে বেড়াচ্ছে তা হল ভয়। শাসকের বিরুদ্ধে কথা বললে ভয়। ব্যবসা করতে গেলে ভয়। ব্যাঙ্ক ঋণ দিতে পাচ্ছে ভয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট হয়েও সরকার গড়তে পারবে কি না তার ভয়। দেশের নাগরিকের নাগরিকত্ব থাকবে কি না তাতেও ভয়। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী সুলেমানির হত্যা সৃষ্টি করেছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের ভয়
সারা দেশে এখন একটা শব্দ তাড়া করে বেড়াচ্ছে তা হল ভয়। শাসকের বিরুদ্ধে কথা বললে ভয়। ব্যবসা করতে গেলে ভয়। ব্যাঙ্ক ঋণ
দিতে পাচ্ছে ভয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট হয়েও সরকার গড়তে পারবে কি না তার ভয়। দেশের নাগরিকের নাগরিকত্ব থাকবে কি না তাতেও ভয়। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী সুলেমানির হত্যা সৃষ্টি করেছে আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের ভয়।
এপর্যন্ত এসে ভাবার সময় এসেছে এত ভয়ের পর আশার ক্রমন্নোতি হবে কি না।
পারার মোড়ে চায়ের কাপে তুফান তুলতে তুলতে খবরের আলোচনায় প্রথমেই উঠে আসছে এনআরসি এবং সিএবি। আর এখন ঐশী ঘোষের ওপর আক্রমণ। শুধু আমদের দেশ নয়
সব দেশের সংবিধান রচনার সময় সাম্য স্বাধীনতার কথা বলা হয়। অথচ ভয় এমন বড় বালাই যে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইম্পিচমেন্টের মুখে পড়তে হয়। কারণ তার ক্ষমতার অপব্যবহার। আমাদের দেশেও ভয় সঠিক উপায়ে আন্দোলন করার অধিকার নিয়ে।কারণ যে শাসকই হোক না কেন নিজেদের রাজনীতির উদ্দেশ্য কে চরিতার্থ করার জন্য ভয় দেখাতে তারা বেশি উৎসাহী।
আমাদের দেশের অর্থনীতি নিয়ে এখন বড় ভয়।
জিডিপি বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম। গতবছর গাড়ি বিক্রির হার যেভাবে কমেছে তাতে মারুতি, টাটা মোটরের মতো সংস্থার বাড়ছে ভয়। গাড়ি বিক্রি বহু বছর পর এত নীচে নামেছে যে এই শিল্পে মন্দা।
আর তার সঙ্গে টেলিকম শিল্পে বহুদিন ধরে মন্দা চলছেই। সাধারণ মানুষের কাছে কম দামে মোবাইল ফোনের পরিষেবা দিতে গিয়ে মারাত্মক ক্ষতির সন্মুখিন হয়েছে ভারতী এয়ারটেল বা ভোদাফোনের মতো সংস্থা।
তাই বহু সংস্থা বন্ধ করে দিয়েছে তাদের পরিষেবা। এখন প্রশ্ন উঠছে ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে। কারণ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ক্রমাগত কমিয়েছে তাদের সুদের হার। এতে ভয় বেড়েছে আগামী দিনে সুদের ওপর নির্ভর করে থাকা বরিষ্ঠ নাগরিকরা কিভাবে দিন গুজরান করবেন তা নিয়ে বাড়ছে ভয়।
আবার সুদের হার কমার সুবিধা নিয়ে যে বাণিজ্যিক সংস্থা ঋণ নিতে চাইছে তাদের ঋণ দিতেও ভয় পাচ্ছে ব্যাঙ্কগুলি। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিজয় মালিয়া বা নীরব মোদি স্কাম প্রমাণ করে দিয়েছে ব্যঙ্কের ঋণ নিয়ে কীভাবে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়া ছোটো বড়ো সংস্থা তো আছেই যারে ঋণ নিয়ে শোধ করতে রাজি নন। সম্প্রতি ভিডিওকন সংস্থা কে ঋণ দিতে গিয়ে আইসিআসি ব্যাঙ্কের চন্দা কোচর ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার করে। তার জন্য তদন্ত চলছে। এখন ঋণ নিয়ে চিন্তিত সবাই। যে ঋণ নেবে তারা যেমন ভাবচ্ছে তেমনি ব্যাঙ্ক আধিকারিকরাও চিন্তিত। কিছুদিন আগে অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায় নবেল পুরুস্কার পেয়েছেন। তাঁর গবেষণার মুল বিষয় ছিল কীভাবে দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন করা সম্ভব। তিনি বারবার বলেছেন সাধারণ মানুষের হাতে অর্থের প্রয়োজন আছে। কারণ সেই অর্থই অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে সাহায্য করবে। বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করবে। কিন্তু যে ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে তা হল কর্মসংস্থান নেই, বাজারে চাহিদা নেই, নতুন বিনিয়োগ নেই।
এত অব্দি এসে এটা উপলব্ধি করা যাচ্ছে কীভাবে ভয়ের পরিবেশ সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। আমরা জানি না কতদিন এই ভয়ের পরিবেশ থেকে বের হতে পারব। কারণ অর্থনীতিকে ছাপিয়ে এখন ধর্মীয় মেরুকরণ স্থান পাচ্ছে রাজনীতিতে। যদি এটা মেনেওনি ধর্ম রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে তাহলেও বোঝার সময় এসেছে দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, বাজার, সামগ্রিক পরিকাঠামো উন্নয়নে আগে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
আমার আজ খুব মনে পড়ছে ইতালীয় রাষ্ট্রদার্শনিক গ্রামসির আধিপত্যবাদের কথা।এক শ্রেণি মানুষ যেমন নিজের মত প্রতিষ্ঠা করছে নিজস্ব বুদ্ধিজীবী দ্বারা তেমনি সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় সমস্যা নিয়ে তার সমাধানের জন্য তৈরি করতে হবে সাধারণ মানুষের বৌদ্ধিক সামাজ। যারা মানুষের রোটি কাপড়া মাকানের সমস্যাকে তুলে ধরতে পারবে। কিন্তু শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে সেরকম সমাজ এবং বুদ্ধিজীবী এখন নেই। কারণ ভয় বড় বালাই।
তবে এ ভয় কিন্তু শুধু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ছড়িয়েছ। ইউকে-র প্রধানমন্ত্রী জনসন এবং আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প যাদের আগ্রাসী মনোভাবও পৃথিবীর চিন্তার বিষয়। কারণ ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারে। ইরানের সঙ্গে সাম্প্রতিক বিবাদ এবং তাদের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি অনেক দেশের আর্থিক ক্ষতি সৃষ্টি করেছে। এরা চায় সারা পৃথিবীব্যাপী ভয় সৃষ্টি করতে। পরমাণু অস্ত্র নিয়ে ভয় সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু হয়েছে । আজ সারা পৃথিবীতে বহু পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র রয়েছে। ইরান তার পরামাণবিক গবেষণা চালাতে চায়। সেখানে ভয়। এপর্যন্ত এসে একথা বোঝা যায় আন্তর্জাতিক জাতীয় এবং রাজ্য ক্ষেত্রে ভয় ছড়িয়ে রয়েছে। আন্দোলন হয়েছে সব সময়ই। কিন্তু সাধারণ মানুষ বড় বেশি বিপন্ন সেখানে।
এই মুহূর্তে যে আন্দোলন ভারতে বেশি করে হচ্ছে তা হল এনআরসি এবং ক্যাব নিয়ে, যা এক
রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলন। কিন্তু বর্তমানে এসময় দেশে চরম মুল্যবৃদ্ধি, বেকারি, শিল্পোৎপাদন তলানিতে। একেবারে নিম্ন শ্রেণির মানুষের হাতে টাকা নেই। অথচ অতি প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি নিয়ে যথেষ্ট আন্দোলন নেই। সেই বুদ্ধিজীবী নেই যাঁরা নেমে এসে বলুক রাজা তোর কাপড় কোথায়?
এই সারা পৃথিবী জুড়ে রাষ্ট্রনায়কের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে যারা ভয়ের বাইরে যেতে পারবে। তবে এটা সত্যি এমন একদিন আসবে যখন শোলে ছবির সেই দৃশ্যের মতো অবস্থা হবে যখন ইংরেজ জামানার জেলার বোলবে একদল বাঁদিকে একদল ডানদিকে আর বাদবাকি পেছনে আসুক। কিন্তু সবাইকে অবাক করে তাকে সঙ্গ দেওয়ার আর মানুষ থাকবে না।
কেনো একটা আন্দোলন খাদ্যের জন্য হবে না। কোনো একটা আন্দোলন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য হবে না। যা মানুষের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে পারে। ভারতের সংবিধানের প্রস্তবনায় গনতান্ত্রিক সামাজন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। বিআর অম্বেদকর বলেছিলেন আর্থিক গণতন্ত্র সহায়ক শক্তি নাহলে গণতন্ত্র সুনিশ্চিত হতে পারে না। রাষ্ট্র যাতে সম্পদের সম বন্টন হয় তার দিকে নজর দেবে। আর ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে সব ধর্মকে সমান মর্যাদা দেবে। রাষ্টের নিজস্ব কোনো ধর্ম নেই। তাই কোনো ধর্মীয় মৌলবাদ এখানে স্থান পাবে না। কিন্তু এই কথাগুলো কি শুধু সংবিধানের পাতায় রয়ে যাবে। মানুষের জীবন-জিবিকার পথ মসৃণ করতে ভয়ের পরিবেশের বাইরে যেতে হবে। সম্প্রতি সরকার কর্পোরেট কর কমিয়েছে। কিন্তু তাতে খুব কমসংখ্যক মানুষ উপকৃত হবে। অথচ ওই টাকা মানুষের কাজে লাগানো যেত। এই বক্তব্য অভিজিত বন্দোপাধ্যায়ও রেখেছিলেন। সম্প্রতি বিভিন্ন মুল্যায়নকারী সংস্থা ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে খুব আশার আলো দেখাতে পারেনি। তাছাড়া ইরান আমেরিকার দ্বৈরথ তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। এগুলো সবই ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে অশুভ সংকেত। তাছাড়া যেভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছে তাতে অর্থনীতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন না বলা থেকে যাচ্ছে। তবে এই প্রশ্ন এখন সারা বিশ্ব জুড়েই শোনা যাচ্ছে। চিনের সঙ্গে আমেরিকা বাণিজ্যিক সম্পর্ক কী হবে তা নিয়ে চলছে জল্পনা সারা বিশ্ব জুড়ে। একদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্যদিকে শি জিংপিং। আজ এই বৃহৎ শক্তিধর দেশের কাছে এবং নিজের দেশের নেতৃবর্গের কাছে প্রশ্ন থাকবে কীভাবে মানুষ সমস্ত ভয়ের পাড়ে যাবে।