সিএএ আইনের মাধ্যমে যে সমস্ত অ-মুসলমান সম্প্রদায় যেমন হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টান, শিখ, বুদ্ধিস্ট এবং পারসি ধর্মের মানুষ যাঁরা আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং তার আগে ভারতে এসেছেন তাঁরা ভারতীয় নাগরিকতার অধিকার লাভ করবেন। অর্থাৎ পুরোনো আইন অনুযায়ী যেখানে ১২ বছর পর নাগরিকতা পাওয়া যেত এখন ২০১৪ সাল হিসাবে ৫ বছর থাকার পরই নাগরিকতা পাওয়া যাবে
এনআরসি এই শব্দবন্ধটা যেন পেঁয়াজের মুল্যবৃদ্ধির মতো সারা দেশের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে। তার সঙ্গে দোসর ক্যাব।মাননীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন যে এনআরসি-র ফুল ফর্ম কী? তবে সম্প্রতি দেশের পুর্ব এবং উত্তর-পুর্বাঞ্চলে এনআরসি অর্থাৎ ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন এবং ক্যাব যা সিটিজেনসিপ এমেন্ডমেন্ট বিল যা এখন নাগরিকতা সংশোধনী আইনে পরিণত হয়েছে তা কিন্তু সাধারণ মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
এটা ভালো বোঝা যায় সকালে বাজারে গেলে। পেঁয়াজের দামের সঙ্গে এনআরসি-র আলোচনা শুরু করে দেয় ক্রেতা থেকে বিক্রেতা।
১৯৫০ সালে যখন সংবিধান চালু হয় তখন ৫ থেকে ১১ ধারায় নাগরিকতার কথা বলা হলেও সংবিধান প্রণেতারা সিদ্ধান্ত নেয় আগামিদিনে সংসদীয় পথে নাগরিকতার আইন সংশোধন হতে পারে। সিদ্ধান্ত হয় যে ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের আগে যারা পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছে তারা সবাই ভারতের নাগরিক হিসাবে গন্য হবে। এরপর ১৯৫৫ সালে ভারতীয় সংসদ নাগরিকতা আইন পাশ করে। সেখানে সংবিধান প্রবর্তনের কালে জন্মসূত্রে নাগরিকতা, রক্তের সম্পর্কে নাগরিকতা, রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে নাগরিকতা, দেশীয়করণের মাধ্যমে নাগরিকতা এবং ভারতভুক্তির মাধ্যমে নাগরিকতা অর্জনের সাথে কীভাবে নাগরিকতার অবসান হবেও অন্যান্য বিষয়ও যুক্ত হয়।
তবে ১৯৮৫ সালে নাগরিকতা আইনের সংশোধন হয়। তাতে বলা হয় ১৯৬৬ সালের আগে যারা ভারতে এসেছেন তারাও ভারতীয় নাগরিক হিসাবে গন্য হবেন। তবে১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে যারা পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে অসমে এসেছেন তাঁরা তাদের নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন কিন্তু তাদের ১০ বছর ভারতে বসবাস করতে হবে।১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি অনুযায়ী নাগরিকতা আইনে এই বিষয়কে খুব গুরুত্বের সাথে মান্যতা দেওয়া হয়।
তখনই এনআরসি-র মাধ্যমে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্ণিত করার কথা বলা হয়।
বর্তমানে যেভাবে এই বিষয়কে নিয়ে আন্দোলন চলছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার কারণ স্থান ভেদে ভিন্ন। যেমন উত্তর পূর্বাঞ্চলের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে।এক ষষ্ঠ তপশিল এবং ইনেরলাইন পারমিট অর্থাৎ অন্তঃরাজ্য ছাড়পত্র। ২০২৯ শে এনআরসি যখন করা হয় অসমে তখন মুল উদ্দেশ্য ছিল যাঁরা বিদেশ থেকে ভারতে এসে নির্দিষ্ট তারিখের পরে বসবাস করছেন তাঁদের চিহ্নিত করা। কারণ এই সমস্যা বেশি প্রকট হয়েছে অসমে। তবে ২০১৯ শের নতুন নাগরিকতা আইন যা আগে ছিল ক্যাব অর্থাৎ নাগরিকতা সংশোধন বিল যা এখন আইন তা কিন্তু অসমে নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এ আইনের মাধ্যমে যে সমস্ত অ-মুসলমান সম্প্রদায় যেমন হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টান, শিখ, বুদ্ধিস্ট এবং পারসি ধর্মের মানুষ যাঁরা আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং তার আগে ভারতে এসেছেন তাঁরা ভারতীয় নাগরিকতার অধিকার লাভ করবে। অর্থাৎ পুরোনো আইন অনুযায়ী যেখানে ১২ বছর পর নাগরিকতা পাওয়া যেত এখন ২০১৪ সাল হিসাবে ৫ বছর থাকার পরই নাগরিকতা পাওয়া যাবে।
তবে সে বিষয়ে তাদের সমস্ত নথি জমা করতে হবে। কারণ তাঁরা সেই সমস্ত দেশে সংখ্যালঘু যেখান থেকে তাঁরা এসেছেন এবং বাধ্য হয়েছেন ভারতে আশ্রয় নিতে। এখন এই আইন অসমবাসী মেনে নিতে পারছেন না।তার মুল কারণ অসমের ইতিহাস পড়লে জানা যায় ১৮২৬ সালে অহম সাম্রাজ্য শেষ হলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে এই রাজ্যের ক্ষমতা আসে।অসমিয়াদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা তখন থেকে চলছে। ১৯৩০শের দশক থেকে গোপিনাথ বরদোলই আন্দোলন শুরু করেন অসমে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে। এই আন্দোলন কিন্ত আরও সম্প্রসারিত হয়েছে আসু অর্থাৎ অল অসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের মাধ্যমে ১৯৭৯-এ। এর মুল কারণ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রচুর মানুষ অসমে এবং পশ্চিমবঙ্গে আসতে শুরু করে।ফলে অসমে আন্দোলন শুরু হয়।যার পরিণতি ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি। তাই নতুন নাগরিকতা আইন এনএরসি-র মাধ্যমে চিহ্নিত মানুষে যা মোটামুটি ১৯ লাখ তার বেরভাগ আবার নাগরিকতা অর্জন করবে নতুন আইনবলে। যার ফলে ধরে নেওয়া যায় ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি থেকে বিচ্যুত হবে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই অসমবাসী আন্দোলন শুরু করে।
তবেএখানেই গুরুত্ব রয়েছে ষষ্ট তপশীলের। এই তপশীলে স্পষ্ট বলা হয়েছে অসম,ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজরাম এই চার রাজ্যে নির্দিষ্ট আদিবাসী পূর্নস্থানে আঞ্চলিক স্বায়াত্বশাসনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অসমের কার্বি আলং এবং মিজরামে চকমা অঞ্চলে শায়াত্বশাসনের কথা বলা হয়েছে। এরপর দায়িত্ব যে পদ্ধতি রয়েছে তাহল আন্তঃ রাজ্য অনুমোদন পত্র (ইনার লাইন পারমিট)। যার মাধ্যমে অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যন্ডে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যেখানে বহিরাগতরা জমি বা বাড়ি কিনতে পারবে না।তাই সেই সমস্ত রাজ্যে নাগরিকতা আইনের প্রভাব পরবে না।
এখন অসমের ভুমিপুত্ররা মনে করছেন যে অঞ্চলে এই সংরক্ষনের সুবিধা নেই সেখানে তাদের বহিরাগতদের চাপে পড়ে নিজেদের অস্তিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। তাই তারা আন্দোলন শুরু করেছে। নিজেদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না যদি এই বিদেশিরা তাদের রাজ্য থেকে চলে না যায়।।তবে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা কিন্তু আলাদা। এই যে বিশাল সংখ্যক মানুষকে নাগরিকতার জন্য নথিভুক্ত করতে হবে যারা দেশে রয়েছেন ১৯৭১ সালের পরে এবং ২০১৪ সালের আগে ভারতে এসেছেন এবং তার মধ্যে যারা মুসলিম তারা কিন্তু সেই সুবিধা পাবে না।
তাতে বিশাল সংখ্যক মানুষ তাদের বর্তমান বাসস্থান হারাবে। তাই প্রশ্ন উঠছে দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে হয়েছে এবং মুল সংবিধানের ১৪নং ধারায় সাম্যের অধিকারকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তবে নির্দিষ্ট জাতির প্রতি এই অসাম্য কেন করা হচ্ছে। তাছাড়া অ-মুসলিম যে সমস্ত মানুষ এই আইন মারফত নিজেদের নথিভুক্ত করবে তাতে কিন্তু এটি তারা নিশ্চিত হয়ে যাবে তারা ভারতীয় নাগরিক নন।অন্য দেশ থেকে এসেছেন এমনও হতে পারে তাদের নিজেদের ওই সময়কালের আগের কোন তথ্য নেই। আবার কিছুদিন আগে রোহিঙ্গারা মায়ানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে আসতে শুরু করে আবার শিয়া রা পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতার শিকার, তামিলরা শ্রীলঙ্কায় এই সমস্ত বিষয় ভাবা হয়নি। সরকার মনে করছে এতে নাগরিকদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করবে।সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি শরদ বোরদে নির্দেশ দিয়েছে মানুষকে এই সম্পর্কে সচেতন করতে।
এই সামগ্রিক অবস্থা অনেক রাজনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করছে। ধর্মিয়মেরুকরণের রাজনীতি তার প্রধান ফসল। একপক্ষের প্রচার দেশীয় মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে এই আইন এসেছে।তবে ৯০এর দশকে তৈরি করা ভোটার কার্ড বা বর্তমানে আধার কার্ড করে কি লাভ হল।আর একপক্ষের মতো যাঁরা আগে থেকে দেশে আছেন তাঁদের কোনও সমস্যা নেই। এরপর শুধু মুসলমান সম্প্রদায় বাদে কিছু নির্দ্ধষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ নাগরিকতা পাবে।
রাজনৈতিক ফায়দা যে কোনও বিষয় নিয়ে তোলা যায়।রাম মন্দির বাবরি মসজিদ নিয়ে আমরা দাঙ্গা দেখেছি, নির্বাচনের রুপ রেখা তৈরি হয়েছে।কর্পোরেট অফিসের আদলে পার্টি অফিস বানিয়ে রাজনৈতিক বিশেষঙগদের দিয়ে রাজনৈতিক ইস্যুও তৈরি হচ্ছে কিন্তু মনে রাখতে হবে মানুষ রাজনৈতিক দলের গিনিপিগ নয়।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুশো বলেছিলেন, মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র তৈরি করেছিল। তাই গণতন্ত্র রক্ষা করতে মানুষ নিজেই ক্ষমতা প্রকাশ করবে। এর মধ্যেই ১৫০ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে।আমরা জানি না আর কোনও সত্য আমাদের অজানা আছে। তাই মনে হচ্ছে গণতন্ত্রের স্তম্ভ যারা যেন তারাই আজ বর বেশি বিপন্ন।