কমলদা

3 - মিনিট |

কমলদা অন্যদের থেকে একদম আলাদা। রোগা-লম্বা মৃদুভাষী কমলদা কোনোদিন গুনে পয়সা নেয় না…

সুজাতা রায়

‘তুমি যে রোজ ওর রিকশায় ওঠো জানো তো ওর কুষ্ঠ আছে,খেয়াল করে দেখো ওর আঙুলগুলো কেমন দোমড়োনো আর ক্ষয়াটে’–অবাক আমি ‘ওমা তাতে কি এত বছর ধরে ওর রিকশায় চাপছি কই কিছু তো অঘটন বাধায়নি,দিব্যি চালায়!’ খিঁচিয়ে ওঠে তমসা–‘উফফ কী গো তুমি কুষ্ঠ কত ছোঁয়াচে তুমি জানো? আমার তো ওকে দেখলেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে।’ তমসা আমার খুড়তুতো বোন, ইংরেজিতে এমএ কমপ্লিট করে শেক্সপিয়রের নাটকের ওপর পিএইচডি করছে। আমি ধোঁয়াটে চোখে ওর দিকে চেয়ে রইলাম– ওকি দিনরাত শেক্সপিয়র ঘাঁটতে ঘাঁটতে সেই যুগেই বাঁধা পড়ে গেছে? নৈলে এযুগের একটা শিক্ষিত মেয়ে কি করে বলে কুষ্ঠ ছোঁয়াচে!ওর মুখ বিকৃতির পরিমাণ দেখে বুঝলাম ওকে বোঝানো আমার সাধ্য নয়,চুপ করে গেলাম।

কমলদাকে আমি চিনি আজ প্রায় বছর দশেক হল। আমাদের পাড়ার মোড়ে গোটা পনেরো রিকশার একটা স্ট্যান্ড আছে,সেই স্ট্যান্ডের একমাত্র অমদ্যপ রিকশাঅলা কমলদা,বাকিদের মুখনিঃসৃত সুগন্ধ যখন চলন্ত রিকশার হু-হু বাতাসে মথিত হয়ে পিছনপানে ধায় তখন সিটে বসে অন্নপ্রাশনের ভাত ওঠার জোগাড় হয়।কখনও স্ট্যান্ডে কমলদা না থাকলে দিশেহারা দশা হয় আমার। আজ তমসার কথা শুনে খেয়াল হল সত্যি এতদিন কমলদার রিকশায় চাপছি কোনোদিন ওর হাতটা খেয়াল করিনি তো,আচ্ছা কমলদার মুখটাই কি কোনোদিন মন দিয়ে দেখেছি? যদি রিকশা ছাড়া,লুঙ্গি ফতুয়া ছাড়া,ঘাড়ে গামছা ছাড়া,প্যান্ট শার্ট পরে কমলদাকে দেখি চিনতে পারব? নিশ্চিত পারব না –আসলে এই ক্লাসের মানুষগুলোকে কন্টেক্সট্ ছাড়া চেনার প্রশ্নই ওঠে না। যদিও কমলদা অন্যদের থেকে একদম আলাদা। রোগা-লম্বা মৃদুভাষী কমলদা কোনোদিন গুনে পয়সা নেয় না। একসঙ্গে একগাদা কাজ নিয়ে বেরোই। মুদিখানা-দর্জি-ব্যাঙ্ক-পোস্টাফিস-ইলেকট্রিক বিল- ওষুধের দোকান সব সেরে ফিরি।এইসব মফস্বল শহরের নিজস্ব টাউন সার্ভিস হল রিকশা আর আমার নিজস্ব রিকশাঅলা কমলদা। দশটায় বেরিয়ে দুটো-আড়াইটায় ফেরা। বিয়েবাড়ি গেলে পৌঁছে দিয়ে আবার সময়মতো নিয়ে আসা– এসব কবে কেমন করে কমলদার দায়িত্ব হয়ে গেছে আর মনে পরে না।কিন্তু আজ তমসার কথায় মনে কি একটু খোঁচ ধরল,কেন ঝেড়ে ফেলতে পারছি না!এমনও তো হতে পারে আমিই ভুল জানি! মেয়েটাও তো ওই রিকশাতেই রোজ ইস্কুল যায়।জিশুকেও কমলদাই রোজ সকালে স্টেশনে পৌঁছে দেয়! জিশু আসুক কথা বলতে হবে।কিন্তু জিশু আসতে তো সেই আটটা-সাড়ে আটটা এখন সবে দুপুর দুটো। খচখচানিটা যাচ্ছে তো নাই-ই উলটে আরও বাড়ছে যেন,থাকতে না পেরে তথাগত কে ফোন করলাম,তথাগত আমার দিদির ছেলে সদ্য এমবিবিএস করে ইন্টার্নশিপ করছে। ওর সঙ্গে কথা বলে ভয়টা তো আরও চেপে বসল ও বলল–‘এমনিতে ভয়ের কিছু নেই তবে ওই গলে যাওয়া জায়গার রস যদি কারুর কাটা জায়গায় লাগে সেখান থেকে রক্তে মিশে গেলে বিপদের একটা আশঙ্কা থেকেই যায়।’ এমনিতে রিকশাঅলার সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ির কোনও ব্যাপার নেই কিন্তু হতেই পারে সিটে কোথাও ওই রস লাগল আর সেখানে আমাদের কাটা জায়গা ঠেকে গেল।তরকারি কাটতে গিয়ে তো প্রায়ই আমার আঙুল কাটে।শিউরে উঠে দৌড়ে আয়নার সামনে গেলাম– নাকটা কেমন একটু ব্যাঁকা লাগছে না!বারবার আঙুলগুলো দেখতে লাগলাম। ঘুমন্ত মেয়েটাকে এপাশ-ওপাশ আতিপাতি করে খুঁজতে লাগলাম কোনও লক্ষণ নেই তো।জিশুকে ফোন করে ফেললাম কখন আসছে! ফোনে বললাম না এলেই সামনাসামনি বলব। কী যে অস্হির অস্হির লাগছে!

জিশু ফিরতেই সব খুলে বললাম। দেখলাম অস্থিরতা কুষ্ঠর চেয়েও সংক্রামক। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল পরদিনই কমলদাকে বলে দেওয়া হবে মেয়েকে ইস্কুলে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই, ওকে ইস্কুলের খাঁচায় পাঠানো হবে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে, জিশু আপাতত যাবে।মাসের মাঝখানে দুজনেই ছেড়ে দিলে গরিব মানুষটা বিপদে পড়বে না? এতটা অমানবিক কি হতে পারি? জিশুকে বললাম যতটা সম্ভব আলগোছে বসতে কোনোরকমে দিন পনেরো কাটাতে পারলেই হয়!পরদিন কমলদাকে মেয়ে যাবে না বলতেই কেমন অবাক চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর একটাও প্রশ্ন না করে মাথা নুইয়ে চলে গেল,সেই ফাঁকে আমি দেখে নিলাম কমলদার ডানহাতের অনামিকা আর কড়েআঙুল দুটো মোটা কাপড়ে মুড়িয়ে বাঁধা।হাফ ছেড়ে বাঁচলাম রস গড়িয়ে লাগার সম্ভাবনা তাহলে নেই। এরপর আমি টুকটাক বেরোনো কদিন বন্ধ রাখলাম। দিনদশেকের মাথায় জিশু অফিস থেকে বেশ হাসিখুশি হয়ে ঘরে ঢুকেই হইহই করে জানান দিল–‘জানো স্টেশন চত্বরে আজ দুটো টোটো দেখলাম।এবার এখানেও টোটো চালু হয়ে গেল,বাঁচা গেল। যেখানে যাও বাঁধা রেট,নো দরাদরি! ভদ্রবাড়ির লেখাপড়া জানা ছেলেরা চালাবে,মদখোর ছোটোলোকগুলোর হাত থেকে মুক্তি! সবচেয়ে বড়ো কথা কমলদাকে ছাড়ানোর আর কোনও প্রবলেম রইল না।’

আমাদের মোড়ের রিকশাস্ট্যান্ডটা আস্তে আস্তে উঠে গেল। মাসছয়েক পর কমলদাকে একদিন শিবমন্দিরের বাইরে দেখলাম এককোনে চট পেতে ভিক্ষা করছে। আমাকে দেখেই উদ্যত কান্না সামলাতে মাথা নুয়ে পড়ল মাটির ওপর, তফাত শুধু বাড়ানো হাতটা কাপড়ের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *