শুধু রোগীদের নয়, ডাক্তারবাবুদের বিপদতারণ মধুসূদনও তিনি
এই রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অভিমত হল, তাঁদের আঠেরো মাসে বছর। কোনও কাজই তাঁরা সহজে করতে চান না। কিন্তু বাংলার সমস্ত সরকারি কর্মচারীই যে এই দোষে দুষ্ট নন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ধূপগুড়ির কৃষ্ণ দাস। তাঁর অবস্থা এখন অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো। দু-বছর আগে ধূপগুড়ি হাসাপাতালে কর্মরত অবস্থায় অবসর নিয়েছেন একজন গ্রুপ ডি কর্মী হিসাবে। কিন্তু নিজের পুরনো কর্মস্থলের মায়া এখনও কাটাতে পারেননি কৃষ্ণবাবু। এখনও প্রতিদিন কর্মজীবনের মতোই নির্দিষ্ট সময় মেনে উপস্থিত হয়ে যাচ্ছেন ধূপগুড়ি হাসপাতালে।এমনকি হাসপাতালের অন্যান্য স্থায়ী কর্মীদের আগেই হাজির হয়ে যাচ্ছেন তিনি।তবে সময় কাটানোর জন্য নয়। হাসপাতাল পরিষ্কার রাখতে চালাচ্ছেন রীতিমতো নজরদারি। ছোটখাটো কাজ থেকে শুরু করে নিজের হাতে নোংরা পরিষ্কার- বাছ-বিচার নেই কোনও কিছুতেই। চোখে পড়লেই হল, ঝাড়ু হাতে ছাদের মাকড়সার ঝুলই হোক বা নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে পড়ে থাকা যে কোনও নোংরা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে নিমেষের মধ্যে। রয়েছে হাসপাতালের বাগান পরিচর্যা, ওয়ার্ডগুলিতে পরিদর্শন করে বিভিন্ন খামতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণও।
অবশ্য সব বিষয়েই পারদর্শিতা দেখিয়ে চলেছেন অবসরপ্রাপ্ত কৃষ্ণ দাস। হাসপাতালে অপারেশন থাকেলই তাঁর উপস্থিতি অনিবার্য।শুধু রোগীদের নয়, ডাক্তারবাবুদের বিপদতারণ মধুসূদনও তিনি। ওটিতে চিকিৎসককে সাহায্য, অপারেশন থিয়েটারের প্রস্তুতি একার হাতে সামলানো, পাশাপাশি ব্লাড ব্যাংক বা স্টোর রুম দেখাশোনা তো আছেই। তবে ৬২ বছরের চিরতরুণ এই সব কাজ করে চলেছেন কোনও আর্থিক প্রত্যাশায় নয়, মানব সেবার তাগিদে। সেবার তাড়নাতেই তাঁর এই কর্মযজ্ঞ।
এমনিতেই ধূপগুড়ি হাসপাতালে কর্মী সংখ্যা অপ্রতুল। বহুদিন ধরেই হচ্ছে না নতুন নিয়োগ। স্বাভাবিক ভাবেই এর প্রভাব পড়েছে রোগী পরিষেবায়। এই বিষয় মাথায় রেখেই একবারে ঘড়ি ধরে কর্মজীবনের মতোই নির্দিষ্ট সময়ে কর্তব্যে অবিচল কৃষ্ণবাবু হাজির হয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালে। তাঁর বক্তব্য হল, ‘যতদিন শরীর চলবে, ততদিন চালিয়ে যাব।’ মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার পাশাপাশি একমাত্র মেয়ে দেবস্মিতাকেও তিনি এই পেশা বেছে নিতে শিখিয়েছেন। দেবস্মিতা এখন একটি বেসরকারি নার্সংহোমে নার্সিংয়ের প্রশিক্ষা নিচ্ছেন।
হাসপাতালের কর্মী সংখ্যা কম থাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে কোনও খামতি রাখেননি কৃষ্ণবাবু। বলেলন, ‘২৯ বছর বযসে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম। প্রথম পোস্টিং ছিল ধূপগুড়ি ব্লকের দূরামারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। প্রায় চোদ্দ বছর সেখানে চাকরির পর ধূপগুড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে বদলি হয়ে আসি। এরপর দীর্ঘ ১৭ বছর এই হাসপাতালে চাকরির পর অবসর নিলেও কর্মস্থলের মায়া ত্যাগ করতে পারিনি।’ পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতালের ১৯ জন স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে এই মুহূর্তে ১৬ জন রয়েছেন। কর্মী কম থাকায় রোগীদেরও সমস্যা হচ্ছে। তাই আমি নিয়মমাফিক ডিউটি করে চলেছি।’
কৃষ্ণবাবুর স্ত্রী সুতপা দাস জানান, ‘অসুস্থতা বা অন্য কারণে হাসপাতালে যেতে না পারলে মন খারাপ হয়ে যায় ওনার। এই কাজ করেই উনি উল্লসিত থাকেন। অন্য কোনও আড্ডা নেই। তাই যেখানে আনন্দ মেলে, সেখানেই যাক। আমরাও কোনেদিন বাধা হয়ে দাঁড়াইনি।’ কর্মক্ষেত্রে অবিচল সাধাসিধে কৃষ্ণ দাস সবসময় চেয়েছেন প্রচারের আলো থেকে দূরে থা্কতে।
ধূপগুড়ি ব্লকের স্বাস্থ্য আধিকারিক সব্যসাচী মণ্ডলের কথায়, ‘প্রায় দু-বছর হল কৃষ্ণবাবু অবসর নিয়েছেন। কিন্তু সরকারি ভাবে অবসর নিলেও অবসরের পরের দিন থেকেই আগের মতোই নিয়মিত কাজে যোগ দিয়ে চলেছেন আগের মতোই। হাসপাতালে কর্মীর অভাব, পাশাপাশি প্রাক্তন কর্মস্থলকে নিজের পরিবারের মতোই ভালোবেসে নিজের কাঁধে দায়িত্ব উনি তুলে নিয়েছেন ছোট বড় কাজ নির্বিশেষে। আমরাও ওনাকে অভিভাবক হিসাবেই মনে রাখি।’