সুরমারা এভাবেই বাঁচে

3 - মিনিট |

সুরমা আর টানতে পারেন না। কাহিল হয়ে পড়েন। অভাব আর টাকার চাহিদা সমানুপাতে বাড়তে বাড়তে একদিন মুখ থুবড়ে পড়ে তাদের সেই শরিকি বাড়ির ঘড়ঘড় শব্দের ঘরখানির মধ্যে

তৃষ্ণা বসাক

সুরমার ঘরে সারাদিন ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় করে চলতেই থাকে সেলাইয়ের হাতমেশিনটা। সুরমা কানে একটু খাটো। মেশিন চালাতে চালাতে তাকের ওপর তোলা মান্ধাতা আমালের বক্স টিভির বস্তাপচা সিরিয়ালগুলোর নির্বাক ছবি দেখেই দিনাতিপাত তার। সব্যসাচীর মত দুহাত চলত একসময়। সেলাই করত প্রচুর। শাড়ির ফলস, পিকো, ব্লাউজের বোতাম, হুক ছাড়াও পর্দা সেলাই, বালিশের ওয়াড়। কাছের কেতাদুরস্ত অভিজাত বাড়ির মহিলারা সুরমার বাঁধা খরিদ্দার ছিল একসময়। সুরমার চোখের ছানি পেকেছে। থাইরয়েডের সমস্যাও রয়েছে। তার মাঝে ছেলেটার চাকরি গেল। জুটমিলে সেবার পুজোর আগে সেই যে তালা ঝুলল আর খুলল না তা। হাহুতাশ করেছিলেন সুরমার হার্টপেশেন্ট স্বামী অতুলকৃষ্ণ চাটুজ্জ্যে। সুরমা শান্ত করেছিলেন তাঁকে। তিনটে মোটে পেট আমাদের। শরিকি বাড়ির ভাড়া দিতে হয় না। শুধু ইলেকট্রিক, ওষুধপালা আর খাওয়া।

সেলাই করে এভাবে তুমি পারবে কি করে সুরমা? বলেছিলেন অতুলবাবু। সুরমা কিন্তু পারছিল তার মনের জোরে সংসারকে সামলে নিতে। ছেলেটা কেমন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল কিছুদিনের মধ্যেই। তারপর যেমন হয় সব অভাবের সংসারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেলাই মেশিনে কাজের পরিমাণ কমতে থাকে।তিনজনের ডাক্তারবদ্যি আর ওষুধের চাপ ক্রমশই বাড়তে থাকে। তখন ধারদেনা হয়। সুরমা আর টানতে পারেন না। কাহিল হয়ে পড়েন। অভাব আর টাকার চাহিদা সমানুপাতে বাড়তে বাড়তে একদিন মুখ থুবড়ে পড়ে তাদের সেই শরিকি বাড়ির ঘড়ঘড় শব্দের ঘরখানির মধ্যে। শ্বেতপাথরের টেবিলখানি আজও তার মেহগিনি পালিশের মধ্যে থেকে উঁকি দিয়ে বলে, দাও দাও, সব তো গেল এবার আমাকে বিদেয় করে খোরাকি আনো হে। সুরমা তাকায় না তার দিকে।

এদিকে বুড়ো বয়সে শারীরিক শক্তি বয়সের সঙ্গে ব্যস্তানুপাতিক। চোখের ছানি, কানের মেশিন, দাঁতের ব্যথা, বুক চিন্‌চিন্‌ সারাই হয় না। মুখ থুবড়ে পড়ে সংসারের টানা ও পোড়েন। মোবাইল ফোন নেই? সুরমার ক্লায়েন্টরা অভিযোগ করতে থাকে। সেলাই পেতে দেরি হয় তাদের। চোখরাঙানি, তুচ্ছতাছিল্য সব উপেক্ষা করেও সুরমা সেলাইকলে মেশিন অয়েল দেয়। এখনও বহু কষ্টে ছুঁচে সুতো পরায়। ঊষা সেলাইমেশিন তার লক্ষ্মী। খুব যত্ন করে তাকে। স্বামীর মতো, ছেলের মতো।

অতুলবাবুকে হার্টের ডাক্তার রোজ ফল খেতে বলেন কিন্তু ফলের যা দাম! ভালো করে ভাত আর একটা ডাল সবজির জোগান দিতেই হাঁফিয়ে মরে যায় সুরমা। ছেলেটার দিকে তাকাতে পারে না। ঘরে বসে বসে কেমন যেন ঘোরলাগা, বিকারগ্রস্ত চেহারা তার। চুলদাড়ি নিয়ম করে কাটার পয়সা নেই তার হাতে। অতুলবাবু নিজের রিস্টওয়াচটিকে খুব যত্ন করেন। বিয়ের যৌতুক, ওমেগা সি মাস্টার। কে জানে কবে তাকেও বুঝি খোয়াতে হবে দারিদ্রের সংসারে। সুরমার গয়নাগুলি সব গেছে একে একে। হাতের সোনার লোহাটুকুনি শেষ সম্বল। ক্ষয়ে গিয়ে লোহা বেরিয়ে গেছে তবুও তাকে হাতে রাখবেই সুরমা।

মহালয়ার প্রোগ্রাম হচ্ছে পাড়ায়। কোনও এক রাজনৈতিক দল অয়োজন করেছে দিনের বেলায় দরিদ্রসেবা রাতেরবেলায় ভুরিভোজ। সুরমা কী করে যাবে সেখানে? পাড়ায় সবাই চেনে জানে তাদের। বহুদিনের বাসিন্দা তারা। এদিকে পুজোয় ইচ্ছে করে নিজের অঙ্গে নতুন সুতো ওঠাতে। সারাটা বছর ধরে মুখ বুঁজে অন্যলোকেদের নতুন জামাকাপড়ে ফোঁড় তুলে চলে সে। পুজোয় ইচ্ছে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ছেলেটার নতুন পাঞ্জাবি বা অতুলবাবুর একটা ফতুয়া যদি কেউ দিত। পাড়াতেই যাবে তিনজনে আজ। বড়লোকের দান নেবে। লজ্জা কীসের? রাতে পেট পুরে খাবে তিনজনে কব্জি ডুবিয়ে। লজ্জা কীসের্? নাহ্! পারল না তিনজনের একজন‌ও। ভাগ্যিস মহালয়ার গান শুনতে পায় না সে কানে। মনের ভেতরটা ডুকরে কেঁদে উঠত একসময়। পুজো এসে গেলেই মনে পড়ে কি বোলবোলাই না ছিল একসময় তাদের এই বাড়িতে। তাঁতি এসে গাঁটরি করে শাড়ি ধুতি দিয়ে যেত। সবাইকে শাড়ি দিতেন অতুলবাবু। আজ আর অতুলবাবুর জন্যে একটা ফতুয়া কেউ দেয় না। সংসারের এমনি নিয়ম। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ভাইপো, ভাইঝি, ভাগ্নে, ভাগ্নী অন্তপ্রাণ অতুলবাবুর অবস্থা যবে থেকে পড়তির দিকে কেউ তাদের আর খবর পর্যন্ত নেয় না। ষষ্ঠীর আর মোটে দুদিন বাকি। গাড়ি থেকে এসে এক ক্লায়েন্ট নামল সুরমার কাছে।

বড়লোকের গিন্নী নেমেই চোখ কপালে তুলে বলেন, এখনও হল না? পুজোয় পরতে পারব তো? সুরমা একদিন নিজের শাড়ি এভাবে দোকানে গিয়ে ফলস পিকো লাগিয়ে আনত। মনে পড়ে যায় সেসব কথা। পায়ের নখ খুঁটতে খুঁটতে সুরমা বলে, রাতে যে চোখে দেখতে পাই না মোটে। হয়ে যাবে ম্যাডাম। অতগুলো শাড়ি তো। চিন্তা করবেন না। আমি একা। ষষ্ঠীর আগেই ঠিক দিয়ে দেব।

এভাবেই গড়াতে থাকে সুরমাদের জীবন। পাড়ার চেনা এক বাড়ির বউদি এসে একটু বে টাকা দিয়ে যায় সেলাই করিয়ে। সেই বৌদি বলেন, ঈশ্বর আপনাদের সহায় হোন। সুরমা সেদিন শুনতে পায় সেকথা। বলে, না বউদি, বলবেন না ও কথা। তিনি আমাদের নয়। যে দেখছেন আমার ঐ তাকে তোলা লক্ষ্মীর ঘট? আমপাতা, কাঁঠালি কলা, সিঁদুর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে কালো পেতলের সুদৃশ্য ঘটের ওপরে। বহুদিনের অযত্নের ছাপ সেটায়। সারাজীবন বেস্পতিবার লক্ষ্মীপুজো করে কি হল বলতে পারেন বউদি? লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তাম মন দিয়ে। আমার স্বামী প্রতি মাসে পৈতে বদল করতেন নিষ্ঠার সঙ্গে। ব্রাহ্মণ হয়ে কি লাভ হল আমাদের বলবেন বউদি? আমার ছেলেটা ইস্কুলে নিজের টিফিন বন্ধুদের দিয়ে দিত রোজ, বলত মা, ওরা বড় গরিব, টিফিন আনতে পারেনা। কী লাভ হল ওর বলবেন বউদি? আমার ঠাকুরের তাকে রাখা আমার শাশুড়ির গীতা, চণ্ডী আমি আর ছুঁয়ে দেখি না বউদি। মহালয়া থেকে নবরাত্রি চণ্ডীপাঠ করতাম অমি আর আমার স্বামী একসঙ্গে। কী হল বউদি? মা চণ্ডী কি দেখতে পেলেন আমাদের দুঃখ?

ব্যাগ থেকে আরও দুশোটা টাকা বের করতে গেলেন সুরমার ক্লায়েন্ট। সুরমা কেঁদে উঠে বলল, বউদি, আমাদের সর্বাঙ্গে ঘা। আপনি এত ওষুধ কোথায় দেবেন ?

ভদ্রমহিলা বললেন, রাখুন এটা। আজ রান্না হয়েছে ঘরে?

সুরমা আবারো হাউমাউ করে কেঁদে বলে উঠল। বউদি আজ এই দুশো টাকা নিয়ে আমি কি কিনি বলুন তো? ওষুধ না খাবার? আজ বাড়িতে রান্না হয়নি বলে ছেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। বলে গেছে যেমন করে হোক টাকা নিয়ে আজ বাড়ি ঢুকবে সে। ওর বাবা সেই শুনে নিজের পৈতে দুহাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে ঘর থেকে সেই যে বেরিয়ে গেলেন কোথায় এখনো ফেরার নাম নাম নেই তার।

আজ আমি সব ঠাকুরের ছবি এই ষষ্ঠীতলায় বটগাছের নীচে রেখে আসব । এত ঠাকুর পুজো করে আমাদের কি লাভ হল বলতে পারেন?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *