দুর্গাপুজোকথা

3 - মিনিট |

দুর্গাপুজো হিন্দুর সার্বজনীন পূজা। একটু বিচার করে লক্ষ করলে এই সমস্ত কাজে একটা সার্বজনীনতার রূপ দেখতে পাওয়া যায়…

বাসন্তী কর

মার্কণ্ডেয় পুরাণে আছে আদ্যাশক্তি মহামায়া বিশেষ প্রয়োজনে যুগে যুগে নানারূপে নিরাকারা থেকে সাকারা হয়ে আবির্ভূত হন।

আমরা বিশেষভাবে বাঙালিরা দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার মহিষাসুরমর্দিনী রূপেরই পূজা করে থাকি। আমরা অর্থাৎ বাঙালি হিন্দুরা যে এই মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো করি সঙ্গে থাকেন লক্ষ্মী,সরস্বতী,কার্তিক, গণেশ। প্রশ্ন জাগে মনে, এই সমন্বয় কীভাবে সম্ভব।এর একটা উত্তর মনে হয়, শরৎকালের মহাপূজার বাঙালির হৃদয়ে দেবীর অধিষ্ঠান হয় কন্যারূপে। দেবীর তখন শান্ত ভাব। কার্তিক গণেশরা দেবীরই সন্তান, দেবীরই পরিবারভুক্ত। বাঙালিরা মনে করে এই শারোদৎসবের মাধ্যমে দেবী যেন সপরিবারে পিতৃগৃহে তিনদিনের জন্য এসেছেন।এই দেশের আগমনি সংগীত এরই সাক্ষ্য বহন করে।

আরেকটা কারণ হতে পারে, দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে লক্ষ্মীধনের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক বীরত্বের, গণেশ সাফল্যের প্রতীক। দুর্গার দশটি হাত ও দশটি প্রহরণ বলবীর্যের  দ্যোতক। সিংহ বশ্যতার প্রতীক। মহিষাসুর সমস্ত অশুভের প্রতীক। একটি বলিষ্ঠ জাতি সমস্ত অশুভ দলিত করে পরিপূ্র্ণতা লাভ করার জন্য চাই প্রচুর শক্তি। তাই এই দুর্গাপুজো। দুর্গা অনন্ত শক্তির প্রতীক, দুর্গাপুজো অনন্ত শক্তির প্রতীকী পূজা।

মায়ের অসংখ্য বাহু। অসংখ্যের প্রতীক দশ। মায়ের বাহুতে পালনী শক্তি। অসংখ্য বাহুদ্বারা তিনি অসংখ্য সন্তান পালন করেন। মা্য়ের দশ-দশটি অস্ত্র। এই অস্ত্রগুলির প্রত্যেকটি আধ্যাত্মিক অর্থ আছে। যেমন, ত্রিশূল দ্বারা স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ এই তিন দেহ লয় করে মা সিদ্ধ দেহ জাগিয়ে দেন। সেইরূপ খড়্গ অর্থ তত্ত্বজ্ঞানের অসি। এর দ্বারা মা সাধকের অজ্ঞানতা নাশ করেন। এইরূপ প্রত্যেকটি অস্ত্রেরই ব্যবহারিক ও পারমার্থিক অর্থ আছে।

মায়ের বাহন সিংহ। সিংহ রজোগুণের প্রতীক। মা দুর্গা শুদ্ধ সত্ব গুণময়ী। অসুর ঘোর তমোগুণের মূর্তি। মায়ের সঙ্গে অসুরের যুদ্ধ সত্ব ও তমোগুণের লড়াই। এই যুদ্ধে রজোগুণ যার পক্ষে থাকবে তারই জয় অবশ্যম্ভাবী। তাই মা পশুশক্তিকে পক্ষে রেখেছেন, কিন্তু চরণতলে চেপে। তাছাড়া মায়ের বাহন হওয়ার যোগ্যতাও সিংহের আছে। মা আমাদের, বিশ্বরাজ্যের সাম্রাজ্ঞী, আর সিংহও পশুরাজ। সিংহের নখ, দাঁত  ও গর্জন এই তিনও মায়ের দশহাতের বিশেষ ক্ষমতাযুক্ত অস্ত্রসাধ্যরূপে পরিগণিত।

লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা। এত সুন্দরী লক্ষ্মী। তার বাহনটি এত কুৎসিত। পেঁচা দিবান্ধ। পেঁচক সকলকে বলে, আমি যমের দূত। কুপথ যদি ধন অন্বেষণ করো, যমের দণ্ড মাথায় পড়িবে। আমার প্রভু যমের চিন্তা করো, মৃত্যুর কথা ভাবো। কিছুই সঙ্গে যাইবে না। সুতরাং কুপথে ধন আনিও না। পবিত্রপথে ধন উপার্জন করো, পবিত্রকাজে ব্যয় করো। পেঁচক মুক্তিকামী সাধককে বলে, সকলে যখন ঘুমায়, তখন তুমি আমার মতো জাগিয়া থাকো। আর সকলে যখন জাগ্রত, তখন তুমি আমার মতো ঘুমাইতে শিখো, তবেই সাধনে সিদ্ধি। কৈবল্যধাম লাভ।

গণেশের বাহন ক্ষুদ্র ইঁদুর। মাথায় যাঁর বিশাল হস্তীর মুণ্ড, তাঁহার বাহন কিনা ক্ষুদ্র মূষিক। এই বড় আর ছোটোর মিলন ঘটানোই জাতি গঠনের মূল মন্ত্র। এবং তারই প্রতীক এটা। এছাড়াও গণেশের অর্চনায় মুক্তিলাভ হয়। আমাদের অক্টোপাসের বন্ধন থেকে অব্যাহতি দিতে অর্থাৎ এই পাশরজ্জু কাটতে ইঁদুরের মতো দুই ধারালো দাঁতের অর্থাৎ বিবেক বৈরাগ্যের প্রয়োজন।

সরস্বতীর বাহন শ্বেতহংস। জল-দুধ মিশিয়ে দিলে হংস তার থেকে দুধ গ্রহণ করে জল ত্যাগ করে। সকল বস্তু থেকে অনিত্য, অসার বস্তু ত্যাগ করে নিত্য সারবস্তু গ্রহণ করার শিক্ষাই আমরা এতে পাই। তাই জ্ঞানমূর্ত সরস্বতী হংস সমারূঢ়া।

কার্তিকের বাহন ময়ূর। কিন্তু বীরশ্রেষ্ঠ কার্তিক উচ্চৈশ্রবা ঘোড়াকে বাহন না করিয়া ময়ূর বাহন করলেন কেন। সৈনিক পুরুষের যে সকল গুণ অপিরহার্য, ময়ূরের মধ্যে সেগুলি দেখিয়া কার্তিক তাকে বেছে নিয়েছেন। কার্তিক পরমসুন্দর পুরুষ, প্রাণীর মধ্যে ময়ূর পরম সুন্দর। কার্তিক ওই সৌন্দর্য লাগানো ধর্মযুদ্ধ, দেবগণের হৃতরাজ্য উদ্ধার সাধনে। ময়ূর তার সুন্দর পেখমটা লাগায় হিংসার প্রতীক সর্পের সঙ্গে যুদ্ধে। পেখমরূপী চাল দিয়ে বিষধরকে ঠেকায়, আর ঠোঁট ও নখ দিয়ে তাকে নাশ করে। ময়ূরের মতো অনলস, কর্মকৌশলী, বিষাক্ত ভক্ষক, স্বজনপ্রীতিমান, পরম সৌন্দর্য়শালী আর কোন প্রাণী আছে, যাকে কার্তিক বাহনরূপে নিতে পারেন।

দু র্গা পু জো র  সা র্ব জ নী ন তা

দুর্গাপুজো হিন্দুর সার্বজনীন পূজা। একটু বিচার করে লক্ষ্য করলে আমরা এই পূজার সমস্ত কাজে একটা সার্বজনীনতার রূপ দেখতে পাই। যেমন,

প্রতিমার সার্বজনীনতা

দুর্গা একা নহেন, অন্যান্য দেবদেবীরাও আছেন এবং পূজা পান।

মন্ত্রে সার্বজনীনতা

তিষ্ঠ দেবীগনৈঃ মঃ। অর্থাৎ হে দেবী! সমস্ত দেবতার সহিত তুমি আমার পূজামণ্ডপে বিরাজ করো।

পুজোবিধিতে সার্বজনীনতা

দুর্গার সঙ্গে দুর্গার বাহন সিংহের এবং অন্যন্য দেবদেবীর বাহনদের যেমন ময়ূর, ইঁদুর প্রভৃতির, এমনকী মহিষাসুরেরও অর্চনা করতে হয়।

পূজার অঙ্গীয় দ্রব্যে সার্বজনীনতা

গঙ্গাজল, সাগরের জল যে কোনও জল আহরণ করতে পারে। সেখানে জাতি, বর্ণের কোনও প্রশ্ন নাই।

অনুষ্ঠানকারীদের মধ্যে সার্বজনীনতা

কুম্ভকার প্রতিমা গড়ে। পুরোহিত পূজা করেন। নাপিত দর্পণ দেয়, মালি ফুল জোগায়, বাদ্যকার ঢাক বাজান।

পুষ্পাঞ্জলি প্রদানে সার্বজনীনতা

ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য সকলে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে ধন্য হন। এরপর বিজয়া। বিজয়া তো অবাধ মিলন। পূজা প্রাঙ্গণ তখন এক মহামিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়।

দুর্গাপুজোর ঐহিক ফলশ্রুতি তিনটি— শক্তিলাভ, মমত্ত্ব ও বিশ্বমৈত্রী। মায়ের প্রতিমা দর্শন করে ও পুজোর সার্বজনীনতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যেদিন আমরা সর্বপ্রকার ভেদাভেদ ভুলে বিশ্বমৈত্রী প্রতিষ্ঠা করতে পারব সেই দিনই হবে আমাদের দুর্গাপুজো ও প্রতিমা দর্শন সার্থক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *