প্রান্তিক মানুষের অর্থনীতি

3 - মিনিট |

কার্ল মার্কস যেমন চেয়েছিলেন আর্থিক অসাম্য দূর হোক, জন রলস মানুষের আর্থিক ব্যবধান দূর করতে চেয়েছিলেন, অমর্ত্য সেন মানুষের প্রাথমিক চাহিদা পুরণ করার কথা বলেন। তেমনি অভিজিত সেই পথ ধরেই একেবারে নিচুতলার মানুষের জীবনকে এঁদো গলি থেকে উন্নয়নের রাজপথে তুলে আনতে চেয়েছেন

অনিমেষ সাহা

পৃথিবীতে যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে সেই তুলনায় উন্নয়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছয়নি যাতে মানুষ নিশ্চিতে জীবনধারণ করতে পারে। অসাম্য আছে। ছিল। আর হয়তো থাকবে। প্রাচ্য বা প্রাচাত্যের সভ্যতার  বিকাশে সব ক্ষেত্রেই এই অসাম্য ছিল। এতগুলো কথার অবতারণা করছি কারণ অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পুরুস্কার  মনে করিয়ে দিয়েছেন নোবেলের মহত্ত্ব তখনি হবে যখন তা মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে যাবে।

অবশ্য এ কাজটা শুরু হয়েছে বহুদিন আগে থেকে।রাষ্ট্র বিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদরা পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য চেষ্টা করে গেছেন। বৈদিক যুগের ঋষিরা চাইতেন পৃথিবী যেন  সকলের বাসযোগ্য হয়। প্রাচীন গ্রিসে প্লেটো  অ্যারিস্টোটল গ্রিক  নগর রাষ্ট্রগুলিকে সুস্থভাবে থাকার পথ দেখিয়েছেন। সেই পথ বেয়েই মার্কসীয় অর্থনীতি নতুন দিশা  দেখিয়েছিল পৃথিবীকে। বিংশ শতাব্দীতে ধনতন্ত্র এবং সামাজতন্ত্রে ভাগ হয়েছে পৃথিবী।

এখন বিশ্বায়ন পরবর্তীকালে পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি বদলেছে। ধনতন্ত্রের প্রসারের সঙ্গে তাল রেখে বেড়েছে অসাম্য। বেড়েছে দারিদ্র। অর্মত্য সেন এবং অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্র, ক্ষুধা এবং অসাম্যের ক্ষেত্রকে করেছেন তার গবেষণার বিষয়।

আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রাওলস মানুষের অসাম্য সমাধানের চেষ্টায় যে তত্ত্ব তুলে  ধরেছিলেন। যার মুল বক্তব্য ছিল ধনতান্ত্রিক সমাজের মধ্যেই ধনীদের করের টাকায় গরিবের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হোক। তবে বিংশ শতাব্দীর শেষেরদিকে অর্মত্য সেন বললেন শুধু সাহায্য নয়, দক্ষ কর্মী গড়ে তুলে সাবলম্বি করা জরুরি। এ-কথার সমর্থনে অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের কর্মপরিধির বিস্তর ঘটিয়েছেন। রান্ডমাইজইজড কন্ট্রোল  ট্রায়াল  বা অরসিটি যে  বিষয়টির উপর ভিত্তি করে তিনি নোবেল পুরুস্কার পেয়েছেন তার মুল  পদ্ধতি  হল কোনও একটি স্থানে মানুষের ওপর গবেষণা চালানো যাতে সেই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে অন্য জায়গায় তা কাজে লাগানো যায়। তাই ২০০৩ সালে আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশান ল্যাব গঠন করেন। ৮০টি দেশে দারিদ্র দূরিকরণে এবং সামাজিক পরিকল্পনা রুপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যে পদ্ধতিকে ব্যবহার করে তাঁরা মানুষের উন্নয়নের কাজ করছেন তা একধরনের আচরণবাদ। কারণ মানুষের ব্যবহারকে গবেষণার মধ্যে নিয়ে এসে সাহায্যের প্রক্রিয়াকে নিশ্চয়তা দান করা।

১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে কার্ল মার্কসের লেখা কমিউনিষ্ট ম্যেনিফেস্টো সমাজের শ্রেণি শোষর কথা বলেছিল।সমাজতান্ত্রিক  সমাজ গঠনের চেষ্টা সারা পৃথিবী জুড়েই শুরু  হয়েছিল। বিশ্বায়নের ফলে  রাষ্ট পরিচালন  ব্যবস্থায় ধনতান্ত্রিক সমাজ তার  সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে।  কিন্তু তার সাথে ধীরে ধীরে বেড়েছে অসাম্য। আর তাই শিক্ষা, সাস্থ্য, বেকারি,  ক্ষুধা এই সমস্ত বিষয়গুলি মানুষকে ছেড়ে যায়নি।  সারা পৃথিবী জুড়ে উদ্বাস্তু থেকে সন্ত্রাস মানুষের জীবনকে বিদীর্ণ করেছে। তাই অভিজিতের পুওর ইকনমিক্স বা  গুড ইকনমিক্স ফর হার্ড টাইমস পথ দেখায় তাদের গবেষণার পদ্ধতির মাধ্যমে কীভাবে মানুষের  সমস্যাকে দূর করা যাবে। তাই তিনি  বলেন ধনীদের বহুল রোজগারে কর বসিয়ে দরিদ্রদের সাহায্য করা হোক। 

বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়েই আর্থিক মন্দা চলছে। ভারতও এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। অভিজিতের পুওর ইকনমিক্স সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ সংস্থানের কথা বলেন।ভারতে এখনও ব্যাংকিং ক্ষেত্র সেভাবে সম্প্রসারিত  হয়নি। তাই ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। তাই কোনোভাবেই বিকল্প গড়ে ওঠেনি।যার  ফলে মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে  সম্পদ  সৃষ্টি করতে পারেনি।তবে অভিজিত তাঁর স্ত্রী এথার ডুফলো বা মাইকেল ক্রমার প্রত্যকেই দেখিয়েছেন কীভাবে সাধারণ বিষয় মানুষের জীবনযাত্রা বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।অভিজিত ছাত্র আন্দলনের সময়দশদিন তিহার জেলে কাটিয়েছিলেন। সেখানেও আসাম্য লক্ষ করেছেন খাওয়া নিয়ে।

তাঁর মতে এই যে সারা দেশে রিয়েল স্টেটের প্রসার বেড়েছে তাতে বহু মানুষের কজের সংস্থান বেড়েছে  কিন্তু দেখা গেছে  দেশের বিভিন্ন  প্রান্তে মানুষেরা দারিদ্রের ফাঁদে পড়ে শেষ হয়ে গেছে। উন্নত দেশের সরকার নির্দিষ্ট দরিদ্রপূর্ণস্থানে যেভাবে বিনিয়োগ করে ভারতের মতো দেশে সেভাবে বিনিয়োগ হয়নি।আর তাই প্রকৃত শিক্ষা, স্বাস্থ্যপরিসেবা পায় না প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরা। যার ফলে দারিদ্রের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই  কখনো চুঁইয়ে-পড়া অর্থব্যবস্থা  আবার একশো দিনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। অভিজিত চান মানুষের হাতে অর্থ সংস্থান। যাতে মানুষ সরাসরি আর্থিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। চিন যেমন শ্রম নিবিড় উ্ৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে ভারত তা পারেনি।তাই কর্মসংস্থান সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি।

সারা পৃথিবী একসময় সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিল কারণ পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ মানুষকে সেইদিকে ঝুঁকতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু বিশ্বায়ন আজ রাষ্ট্রব্যবস্থার পটবদলে দিয়েছে।একদিকে  আমেরিকা, চিনের বাণিজ্যিক আগ্রাসনের সঙ্গে অন্যদিকে দারিদ্রের শুন্য ফাঁদ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের জীবনকে  নস্যাৎ করে দিয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান তাই আজ মুখ্য বিষয় মানুষের কাছে।অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই প্রয়োজনীয়  গবেষণা তুলে ধরেছেন মানুষের সামনে। তাই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থ্যয় অধিক আয়ের উপরে বেশি করে আরোপ করে দরিদ্র মানুষের সামাজিক উন্নয়নে  কাজে লাগাতে তিনি মত দিয়েছেন।তবে অমর্ত্য সেন যেমন উন্নয়নশীল অর্থনীতি নিয়ে গবেষণয় মানুষের উন্নয়নের কথা বলেছেন তেমনি অভিজিত তাঁর গবেষণায় মানুষের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলিকে তুলে ধরেছেন তাদের স্বাভাবিক আচরণকে গবেষণার মধ্যে দিয়ে।

কার্ল মার্কস যেমন চেয়েছিলেন আর্থিক অসাম্য দূর হোক, জন রলস মানুষের আর্থিক ব্যবধান দূর করতে চেয়েছিলেন, অমর্ত্য সেন মানুষের প্রাথমিক চাহিদা পুরণ করার কথা বলেন। তেমনি আভিজিত সেই পথ ধরেই একেবারে নিচুতলার মানুষের জীবনকে এঁদো গলি থেকে উন্নয়নের রাজপথে তুলে আনতে চাইছেন। যে মুহূর্তে এই লেখা শেষ করছি তখন খবরে দেখাচ্ছে কালীঘাটে এক পথ নাবালিকাকে ধর্ষণ করেছে এক যুবক। পুলিশ চাইছে মেয়েটিকে হোমে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু মেয়েটির মা তা চান না। কারণ সে তো ভিক্ষা করে। দুজনে মিলে কাজ না করলে তাদের খাওয়া জুটবে না।

তাই ভাবার সময় এসেছে কীভাবে নোবেলের মঞ্চ থেকে উন্নয়নমুলক অর্থনীতির এক টুকরো আলো যেন ওই গরিবের বুকে এসে পড়বে। যদি প্রান্তিক মানুষের হাতে অর্থ না আসে সামান্য প্রাথমিক শিক্ষা না থাকে তবে ছেলেভুলনো গল্প শুনিয়ে ধর্ষণ আর রাহাজানির জন্য কমিশন গড়তেই সময় চলে যাবে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related news