বেলা, রানি আর মীরা। এই হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনকন্যা। আমাদের বাংলার ছড়ায় শিবঠাকুরের বাড়িতে যে তিনকন্যার কথা পাওয়া যায়, বাস্তবে এই তিনকন্যা তা নয়। আনন্দ কিংবা সুখের বদলে দুঃখই যেন তাঁদের জীবনে পরতে পরতে জড়িয়েছিল। বাবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হওয়া সত্ত্বেও অনেকটা সময় সমুদ্র পেরিয়ে এসে আর একবার তাঁদের স্মরণ
রবীন্দ্রনাথের তিন কন্যা–মাধুরীলতা, রেণুকা ও অতসী। ডাকনাম যথাক্রমে বেলা, রানি ও মীরা।সন্তানদের প্রতি তাঁর অশেষ স্নেহ। মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে যখন কোনোরকম যোগাযোগ এসেছে ছেলেটি কেমন সেইদিকেই রবীন্দ্রনাথ বেশি জোর দিতেন।তাদের পারিবারিক সচ্ছলতা সেভাবে গুরুত্ব পেত না। ভাবতেন, ছেলেটি তো ভালো, মেয়ে নিশ্চিত ভালো থাকবে, সুখী হবে।অন্যদিকে, পাত্রপক্ষ ঠাকুরবাড়ির ঐশ্বর্য, বিশেষ করে বরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথের জামাই হওয়ার মোহে আকৃষ্ট হত। তিনকন্যার পিতা রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন কীভাবে মানসিক ও আর্থিকভাবে কন্যা ও জামাতাদের নিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন সে চিত্র বড়োই বেদনাদায়ক।
রবীন্দ্রনাথকে যখন তাঁর মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা নিতে হল, তাদের জন্য সুপাত্র নির্বাচন ও বিবাহকর্ম সম্পাদনা ইত্যাদি কাজে তাঁর অসহায়ত্ব, নিতান্ত সাধারণ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো হতাশা, গ্লানি, ক্লেশ তাঁকে জর্জরিত করে। তখনই এই মহামানবের মলিন বিষণ্ণরূপ দেখতে পাওয়া যায়। সে যে কী যন্ত্রণা সারাজীবন তাঁকে বয়ে যেতে হয়েছে তা ভাবলে সাধারণজনও বিহ্বল হয়ে যাবে।
মাধুরীলতা
বন্ধু প্রিয়নাথ সেন সম্বন্ধটা নিয়ে এলেন। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র শরৎকুমাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়া শেষ করে বিহারের কোর্টে ওকালিত করছেন। রবীন্দ্রনাথের জেষ্ঠ্যা কন্যা মাধুরীলতার সঙ্গে শরৎকুমারের বিয়ের জন্য বিহারীলালের প্রতিবেশী প্রিয়নাথ তেরোশো সাত বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে প্রস্তাবটি দেন। অনেক কথা আদানপ্রদান হল। কিন্তু শেষে বিয়েটা আটকে গেল। কারণ, পাত্রপক্ষ কুড়ি হাজার টাকা পণ চেয়ে বসেছেন।রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে জমিদারি দেখাশোনা করতেন। কথা আর এগোচ্ছে না দেখে বন্ধুর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ কলকাতা এলেন। উত্তর কলকাতার নিমতলায় মথুর সেন গার্ডেনস লেনে থাকতেন প্রিয়নাথ। দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল। শরৎকুমারের দুই দাদা অবিনাশ ও হৃষীকেশ পণের ব্যাপারে কথাবার্তা বললেন। ব্যাপার যে সেখানেই মিটল তা নয়, এরপরেও অনেক কথা, চিঠিপত্র আদানপ্রদানের শেষে পণের অঙ্কের রফা হল। দশ হাজার টাকা। তবে সেখানেও একটা শর্ত– বিয়ের অন্তত তিনদিন আগে পণের টাকা পাত্রপক্ষের হাতে দিয়ে দিতে হবে। এই অপমানজনক প্রস্তাবে রবীন্দ্রনাথের অসম্মত হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কাছে সম্মান-অসম্মানের চেয়ে দায়মুক্তিই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল। অথচ মাধুরীলতা তখন তেরো বছরের মেয়ে। ঠাকুর পরিবারের প্রথানুযায়ী বিয়ের দুদিন আগে ভাবী জামাইকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা দেওয়া হত। শরৎকুমারের বড়দা অবিনাশ দীক্ষার দিনই পণের টাকা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। কোনোরকম চিন্তা না করেই তাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বিয়েতে মোটামুটি সবক্ষেত্রেই পাত্রপক্ষকে পণ দিতে হয়েছে। তবে তার চরিত্রটা একটু অন্যরকম ছিল। বিয়ের পরদিন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বরধূকে আশীর্বাদ হিসেবে নগদ অর্থ ও মোহন মিলিয়েমিশিয়ে যে যৌতুক দিতেন তাতেই বরপক্ষের চাহিদা পূর্ণ হত। অবিনাশদের সঙ্গে কথা বলার আগেই প্রিয়নাথ সেনকে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখছেন–‘বেলার যৌতুক সম্বন্ধে কিছু বলা শক্ত। মোটের ওপর দশ হাজার পর্যন্ত আমি চেষ্টা করতে পারি। সেও সম্ভবত কতক নগদ এবং কতক বাকি। সাধারণত বাবা মহাশয় বিবাহের পরদিন চার/পাঁচ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে আশীর্বাদ করে থাকেন– সেজন্য কাউকে কিছু বলতে হয় না। বিশ হাজার টাকার প্রস্তাব তাঁর কাছে উত্থাপন করতেই পারব না।’
এই সময় রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না।তাঁর দুই ভ্রাতুস্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথ শুধু জমিদারির টাকার ওপর ভরসা না করে নিজেরা নিজেদের নামে একটি পারিবারিক সংস্থা খুলে পাট, আখ ইত্যাদি কৃষিজ পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। প্রাথমিকভাবে ঠাকুরবাড়ি থেকেই তাঁদের মূলধন দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যবসাতে ক্রমাগত ক্ষতি হওয়ায় তাঁরা ঋণ নিতে বাধ্য হন। রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ দুকিস্তিতে মোট দশ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছে। সমস্ত ঋণের দায় রবীন্দ্রনাথের ওপর এসে পড়ে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের দ্বারস্থ হন। শেষপর্যন্ত মোতিচাঁদ নাথতার নামে এক মাড়োয়ারি রত্ন ব্যবসায়ী মহাজনের কাছ থেকে বার্ষিক শতকরা সাত টাকা সুদে চল্লিশ হাজার টাকা ঋণ নিলেন তিনি। মাধুরীলতার বিয়ের সময় সেই ঋণভার একইরকম ছিল। এছাড়া প্রিয়নাথ সেনকে লেখা চিঠি থেকে জানা যায়, জোড়াসাঁকোর বাড়ি তৈরির সময় বন্ধু লোকেন পালিত-এর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এছাড়াও কিছু খুচরো দেনা ছিল। ঋণভারে জর্জরিত রবীন্দ্রনাথ তাঁর গ্রন্থাবলি ও ক্ষণিকা সমেত সমস্ত কাব্যের কপিরাইট মাত্র ছ-হাজার টাকায় বিক্রি করতেও দ্বিধাবোধ করেননি।
এরকম আর্থিক দুরবস্থায় রবীন্দ্রনাথের পক্ষে পণের দশ হাজার টাকা দেওয়ার সামর্থ ছিল না। আবার পিতা দেবেন্দ্রনাথকে এই অসম্মানজনক শর্তের কথা বলার সাহাসও ছিল না। তাই মহর্ষিকে না জানিয়ে অন্য কোথাও থেকে ওই টাকা ধার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে জানান প্রিয়নাথ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পিতার প্রতি এতটাই ভক্তিপরায়ণ ছিলেন একথা গোপন করতে পারেননি। এবং দেবেন্দ্রনাথ এতে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন। তিনি বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, বরকন্যাকে আশীর্বাদস্বরূপই সবাই যৌতুক চাইছে, ওদের এতই অবিশ্বাস! কোনও উত্তর না দিতে পেরে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
শরৎকুমার খুবই কৃতী ছাত্র ছিলেন। আঠেরোশো চুরানব্বইতে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ইংরেজি ও দর্শনে অনার্স সহ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ঈষান স্কলারশিপ, হেমন্তকুমার মেডেল ও কেশবচন্দ্র সেন মেডেল পান। আঠেরোশো পঁচানব্বইতে এমএ পরীক্ষাতেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। বিষয়টি খুব আধুনিক–মেন্টাল ও মরাল সায়েন্স। পরের বছর আইনের ডিগ্রি লাভ করেন। এরকম বিদ্বান ছেলেকে জামাই করতে রবীন্দ্রনাথ আগ্রহী ছিলেন। আবার শরৎকুমারেরও এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। রবীন্দ্রনাথ শরৎকুমারকে তাঁর এই অবস্থা, বিয়ের আগে পণ দেওয়া নিয়ে পিতা দেবেন্দ্রনাথের অসন্তোষ ইত্যাদি জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। দাদাদের মতের বিরুদ্ধে তিনি যে কিছু করতে চান না তা স্পষ্ট জানিয়ে দেন শরৎকুমার। অবশেষে বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে সহায় হতে অনুরোধ করেন রবীন্দ্রনাথ। এই অচলাবস্থা কাটাতে বিহারীলাল ও দ্বিজেন্দ্রনাথের (রবীন্দ্রনাথ বড়দাদা)বন্ধু কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য জামিনদার হলেন। এবং তখনকার মতো সমস্যা মিটল। তবে রবীন্দ্রনাথের মনে যে যথেষ্ট দুঃখ, ক্ষোভ জন্মেছিল, তা প্রিয়নাথ সেনকে লেখা চিঠির অংশ থেকেই বোঝা যায়–
(ক্রমশ…)