রবিবারের সকালে কালীঘাট থেকে মেট্রো করে কবি নজরুল এবং সেখান থেকে অটোর ভাড়া গুণে তাদের মায়েদের নিয়ে পৌঁছয় গড়িয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আরও এক সনাতনের ফাঁদ পাতা সেখানে। গল্পের শুরু এইবার। বিশাল লাইন।বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত প্রচুর মেয়েরা লাইনে দণ্ডায়মান। তাদের মাথাপিছু একজন অভিভাবক এসেছেন সঙ্গে।
সর্বত্র আজ সনাতনদের উত্তরোত্তর রমরমা। জ্যোতিষ, তন্ত্র, বশীকরণ, ব্ল্যাক ম্যাজিকের পাশাপাশি সনাতন প্রথায় বেকারত্ব দূরীকরণের প্রলোভন দেখায় তারা। শহরতলির বুকে তাদের প্রত্যন্ত আপিসে পা দিয়েই ফাঁদে পড়েছিল উচ্চমাধ্যমিক পাশ, বছর উনিশের কিশোরী কুসুম আর তার অনেক সহপাঠিনীরা।এদের মায়েরা সামান্যা, সাধারণী কিন্তু সমাজের অতি প্রয়োজনীয় বন্ধু। মেয়েগুলি কেউ গৃহ পরিচারিকার কন্যা, কেউ একক মায়ের কষ্টে মানুষ করা কন্যা। কারোর বাবা দর্জি অথবা বাজারে বসে ফল সবজি নিয়ে। কারও বাবা দিন রাতটির মেয়েকে চোখ রাঙায়, বলে রোজগেরে কবে হবি রে? অনেক তো পড়লি! কারোর বাবা ভয় দেখায় বিয়ে দিয়ে দেবার। বলে আর পড়ে কি হবে তোর?
মেয়েগুলি এবছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে তাদের কন্যাশ্রীর মহার্ঘ্য অর্থ ব্যয় করে এখন কলেজে ভর্তি হয়েছে। সবেমাত্র প্রাতঃকালীন কলেজে তাদের ফার্স্ট ইয়ার। হাল্কাপুল্কা পড়ার চাপ। পাসকোর্স তাই। সারাটা দিন তাদের অঢেল সময়। কোনোদিন সন্ধ্যায় ক্যাটারিংয়ের কাজ করে কিছু অর্থ প্রাপ্তিতে তাদের মন ভরে ওঠে কানায় কানায়। কোনোদিন কোনও ইভেন্টের কাজে গিয়ে নাচতে নাচতে বিরিয়ানির প্যাকেট মায়ের হাতে, ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে আনন্দ পায়। এহেন মেয়েগুলি একদিন তাদের এক বন্ধুর ফাঁদে পড়ল।
এক রবিবারের সকালে কালীঘাট থেকে মেট্রো করে কবি নজরুল এবং সেখান থেকে অটোর ভাড়া গুণে তাদের মায়েদের নিয়ে পৌঁছয় গড়িয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আরও এক সনাতনের ফাঁদ পাতা সেখানে। গল্পের শুরু এইবার। বিশাল লাইন।বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত প্রচুর মেয়েরা লাইনে দণ্ডায়মান। তাদের মাথাপিছু একজন অভিভাবক এসেছেন সঙ্গে।
এবং প্রধানত এসেছে মেয়েদের মায়েরাই কারণ মায়েদের টুপি পরানো সহজ। বেঞ্চিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসেই থাকে তারা। অতঃপর আমাদের পরিচিত কন্যাশ্রী কুসুমের ডাক পড়ে। মাত্র আট হাজার টাকা (যাদের মায়ের মাসিক আয় পাঁচ-ছ’হাজারের বেশি নয়) তাদের দিতে অনুরোধ জানালেন সেই সনাতন। এর বিনিময়ে মেয়ে ও তার মা পাবেন বিস্তর সুবিধা। যেমন?
১)অপুষ্টি নিবারক মাল্টিভিটামিন ক্যাপস্যুল ২) মখমলি ত্বকের জন্য অনন্য সাধারণ বডি লোশন ৩) রেশমি ও পশমি কেশের জন্য ভাইটালাইজিং শ্যাম্পু ৪) ব্রণ চিরতরে দূর করবার ফেসপ্যাক ৫) মেনোপজের পর মেয়েদের মায়ের শরীর ঠিক রাখবার জন্য ‘অল উইমেন ওয়েল বিইং’ ট্যাবলেট এবং আরও কতকিছু থাকবে সেই আট হাজারি গিফট হ্যাম্পারে। মেয়েগুলি মুখ চাওয়াচাউয়ি করে। এর নাম চাকরি?
সনাতন এও জানায় মেয়েদের। বিধিসম্মত সতর্কীকরণ হিসেবে। তারা কাউকেও বিক্রি না করতে পারলে নিজেরাই ব্যবহার করে দেখুন এই প্রোডাক্টের মাহাত্ম্য। যেন ‘পাইলেও পাইতে পারেন অমূল্য রতন’ টাইপ ব্যাপারস্যাপার আর কী।
গ্যাঁটের কড়ি খরচ খরচা করে দলে দলে কন্যাশ্রীরা সনাতনের হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করে ফিরে এসেছিল সেদিন, সেটাই আনন্দের। সনাতনদের পিরামিড ব্যবসায়ের প্রলোভনের ফাঁদ পাতা এ ভুবনে। কখন কে ধরা পড়ে কে জানে! আটহাজারি চাকরি চাই। আট হাজারের বিনিময়ে। আর আছে রহস্যের মোড়কে আবৃত রূপলাগির বিজ্ঞাপন। যাহারা স্যানিটারি প্যাড পর্যন্ত কিনতে পারে না, যারা জ্বর হলে প্যারাসিটামল চেয়ে খায়, যারা কাজের বাড়ির দাতব্য করা সালোয়ার কামিজ টেঁকে নিয়ে দিনের পর দিন পরেই চলে তাদের এরূপ প্রলোভন সনাতনেরা আর কতদিন দেখাবে? চালাক সনাতন নিজে পিরামিডের ব্যাবসা দিব্যি বুঝে শীর্ষে উঠে গেছে, হয়তবা বিদেশও যাচ্ছে টার্গেট মিটিয়ে তবে দেশ উদ্ধার করবার বাসনায় সাধারণ এই মানুষগুলোর মাথা আর কতদিন খাবে তারা? সনাতন সাবধান! দিন আগত ওই!
সনাতনরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবেই। আশ্চর্যের কিছু নেই। বেকারত্বের হাহাকার। ওদের লোক ঠকিয়ে খেতেই হবে।এদিকে কুসুমরাও বেকার। ওদেরো চাকরি পেতেই হবে। অতএব সনাতন প্রথাগুলির বিনাশ হবে না। আইন করে সনাতন প্রথার বিনাশ অথবা সনাতনদের ধরপাকড় করে লাভ নেই। সনাতন পদ্ধতিতে শিল্পে জোয়ার এলেই সনাতন প্রথায় চাকরি পাবে কুসুমরা।ততদিন কুসুমদের জন্য আশীর্বাদ। পড়ুক ওরা। নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে যাক। ঈশ্বর কুসুমদের মাথায় সেদিন বুদ্ধি জুগিয়েছেন সেটাই আনন্দের।নয়তো ফুলের মতো কুসুমদের কন্যাশ্রীর বাকি টাকাগুলো জলে যেত।