বাণীকুমারের আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। সোমবার তাঁর জীবনের নানা অধ্যায়ের আপাত অজানা নানা কথা জানালেন জ্যোষ্ঠ পুত্র নৃশিংহ কুমার ভট্টাচার্য
১৯৩৪-এর ৮ ই অক্টোবর। মানে, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ। মহালয়ার সকাল ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত প্রচারিত হয় ঐতিহাসিক এক অনুষ্ঠান। গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ধর্মকে যারা চিরদিন বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়, সেই রক্ষণশীল দলের পক্ষ থেকে এটি ঘিরে তীব্র আপত্তি ওঠে। প্রতিবাদের মূল কারণ ছিল– এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কন্ঠে কেন চণ্ডীপাঠ শোনা যাবে? অনুষ্ঠানের রচনা ও প্রবর্তনায় ছিলেন বাণীকুমার। তিনি রুখে দাঁড়িয়ে বললেন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণই করবেন গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠ। সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। আর, তার পরেই তৈরি হল একটা ইতিহাস।
বাণীকুমারের আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। সোমবার তাঁর জীবনের নানা অধ্যায়ের আপাত অজানা নানা কথা জানালেন জ্যোষ্ঠ পুত্র নৃশিংহ কুমার ভট্টাচার্য| এখন বয়স ৭৯| বললেন, “আমি তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়| তবে, আমার দুই দিদি আছে| ওদের নাম অরুনলেখা ও সোমলেখা| এই নামদুটো ভীষনভাবে বিরল| মহিষাসুরমর্দিনী’র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত পঙ্কজকুমার মল্লিকও| তিনি আমার বাবাকে বলে বড় দিদির নামে নিজের মেয়ের নাম রেখেছিলেন|”
বাণীকুমারের জন্ম হাওড়ায় মাতুলালয়ে| জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে বাগবাজারে| উত্তর কলকাতার সেই বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট হয়েছে| নৃশিংহবাবু প্রায় দেড় যুগ আগে চলে এসেছেন কেষ্টপুরে| এক তলায় বসার ঘরে বাবার, অর্থাৎ বাণীকুমারের কাঠের বড় টেবিল, চেয়ার, আলমারি, প্রচুর বই আর বাবার স্মৃতি|
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত মনোবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক নৃশিংহবাবু বলেন, “এখনও আমি বইয়ে ডুবে থাকি| বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই|” ৫০ বছর আগে তিনি ট্রামে চড়ে শ্যামবাজার থেকে বাগবাজারে যেতেন। তাঁর মাসিক টিকিটে মূল নামটা অর্থাৎ বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য লেখা। সেই টিকিট দেখলাম নৃশিংহবাবুর কাছে। সঙ্গে সেকালের কিছু চিঠি, বাণীবাবুর পকেটঘড়ি, হাতঘড়ি, হরেক রকম কলম, পানদানি, জর্দাদানি, চশমা, বাঁধানো দাঁত, কাঠের চিরুনি প্রভৃতি| পুরনো পয়সার ঝুলিতে প্রচুর ব্রিটিশ আমলের মুদ্রা।
মহিষাসুরমর্দিনী’র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বাণীকুমার। অনেকের ধারণা। প্রথম দু’জনের তুলনায় একটু হয়তো আড়ালেই থেকে গেছেন বাণীকুমার। অথচ মূল অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও রচনা বাণীকুমারেরই| এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে অবশ্য বলেন, “এ রকম তুলনার অর্থ নেই| বাণীকুমার বাণীকুমারই| বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে ওরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন|”
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাণীকুমারের ধ্যানের ধন। কবিগুরুর বহু কবিতার নাট্যরূপ দান করেছেন তিনি । বাণীকুমারের সঙ্গে কবি নজরুলেরও হৃদ্যতা জন্মেছিল। এ সব বিস্তারিত জানিয়ে বলেন, আকাশবানীর প্রায় গোড়া থেকে যুক্ত ছিলেন বাণীকুমার। তাঁর সৃজনশীলতা কেবলমাত্র বেতারের জন্য নাটক রচনা ও প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। তাঁর বহু প্রবন্ধ ও গল্প বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। কোন পরিস্থিতিতে, কীভাবে তিনি পরিচিত হলেন বাণীকুমার হিসাবে- আলোচনা করলেন তা নিয়ে | কেন্দ্রীয় ডাকবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক দেবাশিস সুর এই প্রতিবেদককে বলেন, “১৯৬৫ অর্থাৎ ক্লাশ টু থেকেই আমি শৈলেন্দ্ৰ সরকার স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমার খুব মনে পড়ে ওনার বাড়ির কথা। বাড়িটা তখন খুব ভালো রং করা ছিল না। তেলিপাড়া দিয়ে যাওয়ার পথে ওই বাড়ি। উনি থাকতেন ১৯৯১ পর্যন্ত। স্কুল জীবনে বহুবার দেখেছি ওনাকে। তখন কিন্তু সেই রকম কোনও প্রচার ছিল না। পরে ওখানে ওনার একটি মূর্তি স্থাপন হয়।“ এই প্রসঙ্গে নৃশিংহবাবু বলেন, “হ্যা| স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আমাকেও থাকার অনুরোধ করেছিলেন| ছিলামও| জন্মস্থান বলে হাওড়াতেও একটা মূর্তির আবরণ উন্মোচন হয়েছে|”