পাঁচ নাটকের দৃশ্যকাব্য পাঁচ নাটকের সংকলন। রচনাকাল ৪২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৯৭১। যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের তীব্র প্রতিবাদ সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে রচনাগুলিকে এক মঞ্চে আনা হয়েছে।যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে এ-এক শান্তির ইস্তাহার যেন। এখানে দুই মলাটের মধ্যে জড়ো করা হয়েছে পাঁচ-পাঁচটি নাটক। যাদের বলা হয় দৃশ্যকাব্য।একটু নজর দিলেই দেখা যাবে, এখানে পঞ্চরঙ্গের সমাহার স্পষ্ট। এদের প্রাসঙ্গিকতার একটাই যোগসূত্র, […]
পাঁচ নাটকের দৃশ্যকাব্য
পাঁচ নাটকের সংকলন। রচনাকাল ৪২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৯৭১। যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের তীব্র প্রতিবাদ সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে রচনাগুলিকে এক মঞ্চে আনা হয়েছে।যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে এ-এক শান্তির ইস্তাহার যেন।
এখানে দুই মলাটের মধ্যে জড়ো করা হয়েছে পাঁচ-পাঁচটি নাটক। যাদের বলা হয় দৃশ্যকাব্য।একটু নজর দিলেই দেখা যাবে, এখানে পঞ্চরঙ্গের সমাহার স্পষ্ট। এদের প্রাসঙ্গিকতার একটাই যোগসূত্র, সব যুদ্ধের বিরুদ্ধে কখা বলা। নানা রকমভাবে। এদের প্রথমটিতে রয়েছে গ্রিক সভ্যতার অবদান।যেটা সম্ভবত রচিত হয়েছ ৪২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আর শেষটি প্রথম প্রচারিত হয়েছিল ১৯৭১-এর ইস্টারের রোববারে। ১১ এপ্রিল। অর্থাৎ যুদ্ধ প্রথম থেকেই মানুষের সর্বনাশ করে আসছিলই। আর মরে যেতে যেতে মানুষ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানিয়ে আসছিল। আর এই দুহাজার বছরের মধ্যে প্রতিবাদের ভাষা কিংবা ধরন সবসময় একরকম থাকেনি। এমনকী প্রতিবাদ না করে সবকিছু ভয় পেয়ে মেনে নিলেও যে কীরকম হয়, তারই নমুনা পাওয়া গেল পোল দেশের লেখক সোয়াভোমির ম্রোজেকের কারোল কিংবা স্ট্রিপটিজ-এ।এমনকী যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে কখনও কখনও যে হাতে রাইফেলও তুলে নিতে হয়, তারই উদাহরণ বের্টোল্ট ব্রেখটের সেনিওরা কারারের রাইফেল। যার পটভূমিকা ছিল এস্পানিয়ার গৃহযুদ্ধ। হেনেরাল ফ্রাঙ্কোর সর্বনেশে অমানবিক হামলা। কিন্তু ওই রাইফেলও তো শান্তির জন্য উদগ্রীব হয়েছিল।
আরিস্তোফানেস অন্তত চল্লিশ থেকে ষাটটি প্রহসন রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে সন্ধান পাওয়া গেছে মাত্র এগারোটি।শান্তির রচনাকাল সম্ভবত ৪২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আথেন্সের নাট্য প্রতিযোগিতায় এটা দ্বিতীয় হয়েছিল।পেলোপনেশীয় যুদ্ধের পটভূমিকায় অত্যন্ত ভয়াবহ ও রক্তাক্ত বিষয় নিয়ে এমন লঘু-তীব্র ঠাট্টা ও টিটকিরি আরিস্তোফোনেস ছাড়া অন্য কোনও গ্রিক নাট্যকারের রচনায় পাওয়া যায় না। সাধারণত গ্রিক নাটক বলতে ট্র্যাজেডির মহারথীদের কথাই হয়তো আমরা বুঝে থাকি। কিন্তু মনে হয় হাস্যরসের এই গুরুদেবটিকে এখানে পেয়ে গ্রিক মানসকে অনুধাবন করার পক্ষে যথেষ্ট।অবশ্য তাঁর ভক্তদের মধ্যে একজন ছিলেন প্লাতো। তাঁর পানসভায় আরিস্তোফানেসের প্রহসন পাওয়া গিয়েছিল।এখানে শান্তির প্রথম তিনশো পংক্তির তর্জমা পাওয়া গেল। যদিও অংশ, তবু প্রায় একটা একাঙ্ক নাটকের মতো মনে হল। তাঁর মর্মভেদী ঠাট্টারও যৎকিঞ্চিত পরিচয়ও আমরা পেলাম।
ব্রেখট লিখেছেন নানা ধরনের নাটক। কখনও প্রতিবাদের, তো কখনও হাসির নাটক। কিন্তু এস্পানিয়ার গৃহযুদ্ধের পটভূমিকায় আমরা পেলাম সেনিওরা কারারের রাইফেল। এই নাটকে কোথাও কোথাও ঠাট্টা থাকলেও কেমন যেন চাপা এক রুদ্ধশ্বাস মর্মপীড়ায় আগাগোড়া ভরে আছে। তুলনায় পোল দেশের নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক সোয়াভোমির ম্রোজেক তাঁর তীব্র টিটকিরিতেই, আমরা সেই দুঃসহ বাস্তবকে ছিন্নভিন্ন করে দেখিয়েছেন। যার ইঙ্গিত তাঁর গল্পগুলোতে পাওয়া যায়। ম্রোজেক দেখিয়েছেন, কাদের ভীরু মানসিকতা সন্ত্রাসকে জিইয়ে রাখে, যুদ্ধের আবহাওয়া তৈরি করে দেয়। যুদ্ধের পরিবেশ বজায় রেখে যুদ্ধের শরিক হয়ে ওঠে। আর এডওয়ার্ড বন্ড কখনও রেখেঢেকে নাটক সাজাননি। সংরাগ রচিত হয়েছিল নিউক্লিয়ার আর্মামেন্টের বিরুদ্ধে।
সব মিলে এমন একটি সংকলন সংগ্রহে রাখার মতো। পাঁচফোড়েনর মলাট, ছাপা, সাজানোগাছানো সবকিছুই প্রশংসার যোগ্য।
পাঁচফোড়ন ,অনুবাদ মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
স্পার্ক, কলকাতা, দাম ২০০
জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রতীক
অজানার প্রতি বাঙালির আগ্রহ চিরকালের। সে জানতে চায় চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডায় কিংবা বাজারহাটের সভাসমিতিতে, বৈঠকখানার আলোচনায়, মঠমন্দিরে, ঘরগৃহস্থালিতে, প্রতিবেশী সম্পর্কে, বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে, সমাজের ভালোমন্দ, কেচ্ছাকাহিনি সম্পর্কে, যা তার আকাঙ্ক্ষার স্পেসকে অপরের স্পেসের সঙ্গে গোপনে অথবা প্রকাশ্যে আদানপ্রদান করতে পারে। বাঙালিদের এটা বিশেষত্ব। এই দেওয়ালে আড়িপাতা থেকে তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-বিবাদ—নানা বিষয়ে নানা রকম মতামত দানে তার আগ্রহ বহুকালের। এতদিন যখন ছাপাখানা ছিল না তখন তার অবস্থান ছিল মৌখিকভাবে মানুষজনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা। আর যখন ছাপাখানা এল তখন সেই সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের জায়গাটা আরও বেশি করে নিজের হয়ে উঠল। মানুষের একক গুরুত্ব গেল বেড়ে। পাঠ-অধিকারের নতুন জায়গা তৈরি হল—কী কিনব, পড়ব, জানব। ছাপানো বই সুযোগ করে দিল এসবের। সামাজিক ধরন-ধারণ, কেচ্ছাকাহিনি, উচিত-অনুচিতের সঙ্গে এল পাঠকদের নতুন জায়গা। সঙ্গে পাঠকদের মধ্যে দুটি শ্রেণি তৈরি হল—উচ্চ এবং নীচ। নন্দনতত্ত্বের এই লড়াই থেকে বটতলার উত্থান। যাকে আমরা বটতলার সাহিত্য বলে থাকি। এই বটতলার সাহিত্যকে ঘিরে রয়েছে নানা গল্প, নানা কাহিনি।
সেরকম উনিশ সতকে জনসাধারণের রুচি ও চাহিদা অনুসারে একধরনের সস্তা দামের বই শোভাবাজার-চিৎপুর অঞ্চলে একটা বটগাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। যাকে বলা হত বটতলার বই। ধর্ম থেকে যৌন কেলেঙ্কারি, মদ্যপান, বেশ্যা-আসক্তি, বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহ,ইংরেজি শিক্ষার কুফল, মাকে ফেলে বউকে ভজনা, ইযংবেঙ্গল, উইকএন্ড, রেলগাড়ি, কলকাতার নতুন আমোদপ্রমোদ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, সামাজিক বিতর্ক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নৈতিকতা বিষয়ক লড়াই চালিয়ে গেছে এই বটতলা। ‘কলিকাতা’ নগরকে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নতুনভাবে একটা বাজারকে হাজির করেছিল বটতলা। লেখক বই লিখছেন আর সে বই বাজারে বিক্রি হচ্ছে—এমনটি উনিশ শতকের আগে ভাবা যায়নি। বই বিক্রির বহর দেখে সহজেই অনুমান করা যায়—কেবলমাত্র উচ্চবর্গের বই কেনার মধ্যে দিয়ে সম্ভব ছিল না। সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও বই কেনার মধ্যে দিয়েই এটা সম্ভব হয়েছিল। অথচ, উচ্চবর্গ সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এদের বিরুদ্ধে রুচিহীন, অপসংস্কৃতি বলে নিন্দায় মুখর হয়েছে। তাতে অবশ্য আটকানো যায়নি। বরং বাঙালির জন্য নতুন একটা বাজার খুলে দিয়ে সে হয়ে উঠেছে উনিশ শতকের জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রতীক। অথচ, উচ্চবর্গের সংস্কৃতি রাজনীতিতে বটতলা সংরক্ষিত হয়নি।
সেই বটতলার লুপ্তপ্রায় চল্লিশটি বই দেড়শো বছর পরে একসঙ্গে পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন অদ্রীশ বিশ্বাস। ‘জনপ্রিয়’ সাহিত্যে পাঠকের যে আগ্রহ এতদিন চোখের আড়ালে ছিল এখন তা হাতের নাগালে। সংকলক নিজেই স্বীকার করেছেন—এতবড় সংগ্রহ এর আগে সম্ভবত আর কখনও বের হয়নি। এর ফলে নিশ্চয় একটা বড় অংশ হারিয়ে যাওয়ার আগে বেঁচে গেল।
বইটির পাঠ নিতে গিয়ে মনে হয়েছে—উনিশ শতকের জনপ্রিয় মানসিকতার হদিশ যেমন মিলবে এখানে তেমনি সে দশকের মানুষ কী পছন্দ করত, কী বিষয়ে কোন বিষয়ে কোন যুক্তি দিত, কী পছন্দ করত না তার একটা ছবি মিলবে।
পুরনো বানান, বানান ভুল এবং সেকালের বাক্-রীতিসহ যেভাবে বেরিয়েছিল, একালের পাঠকদের কাছে ঠিক সেভাবেই এল বইটি।
আর-একটা কথা, বটতলার বইয়ের জনপ্রিয়তার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বটতলার বিজ্ঞানের। মূলত, পঞ্জিকা এবং প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে তারা একধরনের প্রচার চালাত, যা প্রচলিত ধারার একদম উলটো চিত্র।
এবং সেকালে বটতলার বইতে যেভাবে হিউমার বা স্যাটায়ার প্রচলন ছিল যা উনিশ শতকের বাঙালি সমাজকে হাসিয়েছিল। সামাজিক বিদ্রূপ যেমন ছিল, তেমন ছিল সাহসী। আজও যত কৌতুকের বই বের হয়, সেগুলি কিন্তু সেসব বইয়ের আদর্শকে অনুসরণ করে।
সব মিলিয়ে এটি একটি চমৎকার সংকলন। যাকে ইংরেজিতে বলা চলে ‘আনপুটডাউনেবল’। অর্থাৎ পড়া শুরু করলে শেষ না করে ছাড়া যায় না।
বটতলার বই, অদ্রীশ বিশ্বাস সম্পাদিত
গাঙচিল, দাম -৩০০