বুদ্ধদেব বসু: তোমার নিকটে এসে বৃক্ষের ভরসা পেত কবি

7 - মিনিট |

বুদ্ধদেব বসু সর্বতোভাবে কবি। আবার একইসঙ্গে সাহিত্যক্ষেত্রে এমন কোনো দূরতম প্রান্ত আছে কি, যেখানে তিনি নিজের ফসল ফলাননি …

অরিন্দম গোস্বামী

বুদ্ধদেব বসু সর্বতোভাবে কবিআবার একইসঙ্গে সাহিত্যক্ষেত্রে এমন কোনো দূরতম প্রান্ত আছে কি, যেখানে তিনি নিজের ফসল ফলাননি ? রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি আলোচনায় এইরকমই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন বুদ্ধদেববলেছিলেন, সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রেই তাঁর ভূমিকা এমনই সর্বাতিশায়ী- সাহিত‍্যের যে কোনো বিচরণভূমিতেই তিনি স্বরাট

   কিন্তু আজ যদি প্রশ্ন ওঠে, রবীন্দ্রনাথের পর এত বহুমুখী শিল্পকলায় সার্থকতা অর্জন করেছেন কে? যদি প্রশ্ন ওঠে, সৃষ্টির বহুলতায় সমকালীন সাহিত্যিকদের অনায়াসে ছাপিয়ে গেছেন কে? এইসব প্রশ্নের উত্তর যে সাহিত্যিকের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে- তিনি বুদ্ধদেব বসুঅবশ্যই এই দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরও ততোখানি সম্মানজনক হত না, যদি না আমরা জানতাম যে, তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই আমাদের কতখানি বিস্ময় উৎপাদন করে, প্রফুল্লতা এনে দেয়, আমাদের তাঁর সাহিত্যের প্রতি আরও আগ্রহী করে তোলে

   জন্ম ১৯০৮-এর ৩০শে নভেম্বর কুমিল্লায়- আজকের বাংলাদেশেআদিনিবাস ছিলো ঢাকা জেলার মালখানগরে। ছোটো থেকেই অসম্ভব মেধাবী১৯২৫-এ ঢাকা বোর্ডের ম‍্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগের পঞ্চম স্হান দখল করেন। কিন্তু বিস্ময়ের এই যে, তার একবছর আগেই প্রকাশিত হয়েছে নিজস্ব প্রথম কাব‍্যগ্রন্হ মর্মবাণীএরপর ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজেসেখানে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্হান অধিকার করে পান মাসিক কুড়িটাকা বৃত্তি

   বুদ্ধদেব পরে লিখেছেন, ‘মাসিক কুড়ি টাকা মানে মাসিক কুড়ি টাকাই। বন্ধুরা মিলে স্হির করা গেলো, হস্তলিপি পত্রিকা আর নয়, এবারে একটি মুদ্রাযন্ত্র-নিসৃত দস্তুরমাফিক মাসিকপত্র চাই এই উল্লাসের ফলশ্রুতিতেই প্রগতিমাসিকপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । যার সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল বুদ্ধদেব বসু ও অজিতকুমার দত্ত-র ।

   বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ঢাকার পুরনো পল্টন রমনার গাছপালা-রাস্তাঘাট, প্রকৃতি বারেবারেই উঠে এসেছে, শুধু তাঁর স্মৃতিচারণায় নয়, তাঁর গল্প-উপন্যাসের বিভিন্ন পৃষ্ঠাতেও। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন- প্রচুর ছাত্র, কয়েকজন মাত্র ছাত্রী- অধ্যাপকদের পেছন পেছন সারিবদ্ধভাবে তাঁদের লেডিস কমনরুম থেকে আসা আবার ক্লাস শেষে ঐভাবেই ফেরত যাওয়া- এই ছবিটিও বেশ প্রভাব ফেলেছিল ওই তরুণ মনে

   ‘প্রগতিপ্রকাশের অনেক আগে থেকেই বুদ্ধদেব কল্লোল‘-এর নিয়মিত লেখকসদ‍্যকৈশোর উত্তীর্ণ ভাববিলাস,তারুণ্যের চাঞ্চল্য, বিদ্রোহ ও স্বপ্নদর্শন-প্রবণতার দিক দিয়ে তিনিও তখন অপরাপর কল্লোলীয়ের সহধর্মী । রবীন্দ্রনাথকে আদ‍্যোপান্ত পড়ে ফেলার চেষ্টা ও তারপর সাহিত্যে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগ আনার চেষ্টাকে যদি রবীন্দ্র-বিরোধিতা বলা যায় তবে এই তরুণদল সেই পথেরও অভিসারী । সহযোগী অচিন্ত্যকুমারের ভাষায়- কল্লোলের সে যুগটাই সাহসের যুগ, সে সাহসে রোমান্টিসিজমের মোহ মাখানো

   পরবর্তীতে এই কল্লোল যুগের উন্মাদনা নিয়েই বুদ্ধদেব লিখবেন- ‘An Acre of Green Grass’ (1948), আর আরও অনেক প্রবন্ধ। এরমধ্যেই থাকবে সেই সময়কার রবীন্দ্র-অনুসারী কবিদের প্রতি সেই অমোঘ মূল‍্যায়ন- তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ, এবং অসম্ভব ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ

   অথবা কে ভুলতে পারেন বুদ্ধদেবের সেই স্পর্ধিত উচ্চারণ, যা প্রকাশিত হয়েছিল ওই পত্রিকাতেই ১৯২৭সালে- আমরা মোটের ওপর অনেক বেশি rational হয়েছি, অন্ধভক্তির উপর আমাদের আর আস্হা নেই; আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি বিজ্ঞানকে। ভগবান, ভূত ও ভালবাসা- এই তিনটি জিনিসের উপর আমাদের প্রাক্তন বিশ্বাস আমরা হারিয়েছি ।

   এরসঙ্গেই এই গোষ্ঠীর ওপর পড়েছিল ফ্রয়েড ও তাঁর অনুসারী অ্যাডলার, ইয়ুং বা হ‍্যাভলক এলিসের মনোবিকলন তত্ত্বের প্রভাব যা তাঁদের সাহিত্যকে পূর্ববর্তীদের চেয়ে করে তুলেছিল অনেক বেশি বাস্তবানুগ এবং ইন্দ্রিয়-নির্ভর । প্রথমাকাব‍্যের মানেকবিতায় প্রেমেন্দ্র মিত্র যখন গোটা মানুষের মানেখুঁজছেন রক্তমাংস হাড় মেদ মজ্জা/ ক্ষুধা তৃষ্ণা লোভ কাম হিংসা সমেত‘; তখন বুদ্ধদেব একে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে লিখলেন, মোরে দিয়ে বিধাতার এই শুধু ছিল প্রয়োজন / স্রষ্টা শুধু চাহে, এ বীভৎস ইন্দ্রিয় মিলন-/ নির্বিচারে প্রাণী সৃষ্টি করে থাকে যেমন পশুরা।‘  অনেকেই একে অশ্লীল বলেছেন।কিন্তু তবুও বুদ্ধদেব সৃষ্টির অন্ধ প্রেরণাকে‘- ‘জন্ম-জন্মান্তরের প্রেম-সম্পর্কনাম দিয়ে পাঠকদের প্রতারিত করতে চাননি । বরং তিনি বললেন, আমি যে রচিব কাব‍্য এ উদ্দেশ্য ছিলো না স্রষ্টার/তবু কাব্য রচিলাম এই গর্ব, বিদ্রোহ আমার

   বুদ্ধদেব ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর এবং শেলি, কিটস, বায়রন বা সুইনবার্নের মতো কবিদের কবিতা চিরদিনই ছিল তাঁর খুব ভালোলাগার জায়গায়। কিন্তু কোনো বিশেষ কবির কবিতা যদি তাঁকে খুব বেশি আলোড়িত করে থাকে, তবে তাঁরা দুজন হলেন ফরাসি কবি বোদলেয়ার আর জার্মান কবি রিলকে – দুজনেই ইউরোপীয় কিন্তু কেউই ইংরেজি সাহিত্যের নন ।

   রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয়াকে দেখেছেন অদেহী রূপে- প্রকৃতির বিচিত্র মহিমায় তাঁর প্রিয়া মানসবাসিনী, স্বপনচারিণীতুলনায় বুদ্ধদেবের নায়িকা রক্তমাংসের নারী । তাই তাঁদের নামকরণ-ও করেছেন  অপর্ণা, মৈত্রেয়ী, অমিতা, রমা ও কঙ্কাবতী হিসেবে-

মাঝরাতে আজ বাতাস জেগেছে শুনতে পাও / কঙ্কাবতী !

এলো এলোমেলো ব‍্যাকুল বাউল উতল বাও / কঙ্কাবতী !

হাহাকার করে বেহায়া হাওয়ার বেহালাখানি / কঙ্কাবতী !

  দীপ্তি ত্রিপাঠীর মতে , ‘প্রকরণের দিক থেকে বলা যায়, জীবনানন্দের কবিতা যদি হয় চিত্রধর্মী এবং সুধীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণু দের কাব্য ভাবধর্মী, তবে বুদ্ধদেবের কাব‍্য কঙ্কাবতী হলো সঙ্গীতধর্মী

  আসলে প্রেমের যে দুটি পর্যায় আবেগের জন্ম দেয়- পূর্বরাগ ও মিলন, বুদ্ধদেব তার কবি

তাঁর পরবর্তী কাব‍্যগ্রন্হগুলির মধ্যে শীতের প্রার্থনা ও বসন্তের উত্তর জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও অনেকেই মনে করেন, ‘যে আঁধার আলোর অধিক কে মনে করেন বুদ্ধদেবের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গরিলকে যেমন ভেবেছিলেন যে, দেবোপম অর্ফিয়ুসের পক্ষেই সম্ভব চিরন্তনের সঙ্গে যোগসাধনা, দ্বিখণ্ডিত চেতনার অধিকারী সাধারণ মানুষের পক্ষে নয়, বুদ্ধদেব সেই অর্ফিয়ুসকে প্রত‍্যক্ষ করলেন আরেক দেবতার মধ্যে- তিনি বাঙালির কাছের দেবতা রবীন্দ্রনাথ। অপর্যাপ্ত, চেষ্টাহীন, ভাস্বর রবীন্দ্রনাথ

তবু ছিলে প্রতিযোগিতা/পরপারে, বিশ্রামের শুভ্রতাময়, যেন তুমি কখনো করোনি / চেষ্টা, কিংবা যেন কলস গিয়েছে ভেসে, তুমি শুধু জল।/ যা পেয়েছি দু-দন্ড তোমার কাছে, নিশব্দে কেবল

এইভাবে প্রথমকাব‍্য থেকেই অজস্রবার রবীন্দ্র-অনুষঙ্গ ব‍্যবহার করেও কবি বুদ্ধদেব শামিল হয়েছিলেন যে রবীন্দ্র-অতিক্রমণের সাধনায়, শেষপর্যন্ত আবার এই প্রতীকের কাছে ফেরার মাধ‍্যমেই যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর রবীন্দ্রায়ণ।

   প্রেম যে নিন্দনীয় নয়, কিংবা ইন্দ্রিয়বিলাস দ্বারা যে তা আবিল নয়, কিংবা মরমীদের মতো যে সে শুধু ঈশ্বরের পথে সোপানের কাজ করছে না- এই কথাটি বুদ্ধদেব রোমান্টিকদের মতোই উপলব্ধি করেছেন। তাই লোকেরা যাকে কামনাম দিয়ে নিন্দে করে থাকে, তারই প্রভাবে দুজন মানুষ, দুটি নর-নারী কেমন করে পুণ‍্যের পথে নিষ্ক্রান্ত হবে- শুদ্ধশীল এই উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা বুদ্ধদেবের- হয়তো রোমান্টিকদের- তপস্বী ও তরঙ্গিনী‘, সেই অমৃতলাভের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

   বুদ্ধদেব লিখেছেন, ‘কবিতায় আমি আত্মহারা হতুম, গল্প অনেকটা খেলার মতো ছিলোহঠাৎ একদিন সে খেলা মারাত্মক হয়ে উঠল, যখন কল্লোলে আমার একটা গল্প বেরুল, যার নাম রজনী হল উতলা। বুদ্ধদেবের বয়েস তখনও আঠারো হয়নি। সবচেয়ে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন মহিলারা। একজন বলেছিলেন, আঁতুড়ঘরে এই ছেলেকে নুন দিয়ে মেরে ফেলা হয়নি কেন? পরে বুদ্ধদেব নিজেই জানিয়েছেন, নবযৌবনে আদিরস একটু উগ্র হয়েই প্রকাশ পায়- এ গল্পেও তাই হয়েছিল। হয়তো সেই উল্লেখ আজকের দিনে আর ততোখানি অশ্লীল বলে মনে হবে না। যাইহোক, এই নিন্দা লেখককে দমিয়ে না দিয়ে সত্যিকারের আগ্রহ এনে দিল গল্প লেখায়।

   কিন্তু বিতর্ক ছাড়াল কই? ১৯৩২-এর ডিসেম্বরে এরা আর ওরা এবং আরো অনেকগল্পগ্রন্থ-এর জন‍্যেও আদালতে অভিযোগ উঠেছিল। আবার জীবনের উপান্তে এসে বেশ কয়েকদিন আদালতে যেতে হয়েছিল রাত ভরে বৃষ্টিউপন্যাসের জন্য।

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার নর্থব্রুক হলে বুদ্ধদেবের উপন্যাস যেদিন ফুটল কমল‘- এর নাট‍্যরূপ মঞ্চস্হ হয় । যিনি নাট‍্যরূপ দিয়েছিলেন তাঁর নাম প্রতিভা সোম বা রানু। ঠিক পরের বছর এই রানুর সঙ্গেই বুদ্ধদেবের বিয়ে হবিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হনএই পরিয়-পর্বের দীর্ঘ বিবরণ আছে প্রতিভা বসুর আত্মজীবনী সেদিনের আলোছায়া‘-তেসঙ্গীত ও সাহিত্য উভয়ক্ষেত্রেই প্রতিভা ছিলেন অসামান‍্যা।পরবর্তীকালের পাঠক এই সাক্ষ্য-ই দেবেন।

   এর আগে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দেই বন্ধ হয়ে যায় প্রগতিকল্লোলও বন্ধ হয়ে যায় ওই সময়েই।বুদ্ধদেব ঢাকা ছাড়েন ১৯৩১-এ এবং ১৯৩৪-এই কলকাতার রিপন কলেজে ( আজকের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) অধ‍্যাপনায় যোগ দেন । এর ঠিক পরের বছর কবির সেই সময়কার বাসভবন- ভবানীপুরের ১২, যোগেশ মিত্র রোডের বাড়ি থেকেই প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক কবিতাপত্রিকা। যার সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র, সহ-সম্পাদক সমর সেন। ১৯৪০ থেকে অবশ্য সম্পাদক হিসেবে শুধু বুদ্ধদেবের নাম-ই মুদ্রিত হতে দেখা যায়। কবিতাপত্রিকা বাংলাদেশে হয়ে ওঠে কবিদের আশ্রয়স্হল।

১৯২২ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত এই অর্ধশতাব্দী জুড়ে প্রচুর ছোটোগল্পের রচয়িতা বুদ্ধদেব। জীবনের প্রতি, মানুষের প্রতি আর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা- এই গল্পগুলোতে তীব্রভাবে উপস্থিত। অনেক গল্পে আবার প্রাধান্য পেয়েছে নস্টালজিক ভাবনা, কখনও তা মধুর , কখনও বেদনামিশ্রিত, কখনও বা একটু মন কেমন করা। নাগরিকতা বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, যেমন চিত্তের ঔদার্য ও প্রসার, ভাবলোকের স্বচ্ছন্দ বিহার বা শিল্পলোকের উদার আমন্ত্রণ– এইসবই তার ছোটোগল্পে লক্ষ্য করা যায় । আর একটা বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর গল্পের অনেক চরিত্রের-ই প্রিয় বিষয় সাহিত্য।অনেক চরিত্রের মধ্যে লেখকের আত্মজৈবনিক উপাদান খুঁজে পেতে পাঠকের অসুবিধা হয় না ।

   বুদ্ধদেবের উপন্যাসেও প্রেমেরই প্রাধান্যএকদা তুমি প্রিয়ে‘, ‘তুমি কি সুন্দরবা বিখ্যাত তিথিডোরউপন্যাস প্রেম-ই এখানে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে। মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনি অবলম্বনে তিনি বেশ কিছু কাব‍্যনাটকও রচনা করেছিলেন কালসন্ধ‍্যা‘ , ‘অনাম্নী অঙ্গনা ও প্রথম পার্থপ্রমুখ । এছাড়াও তপস্বী ও তরঙ্গিনী , ‘পুনর্মিলন‘, ‘ইক্কাকু সেন্নিন নাটকের রচয়িতাও তিনিই ।

   কিন্তু নাট‍্যরচনার চেয়েও বাংলাসাহিত‍্য বুদ্ধদেবকে মনে রাখবে প্রাবন্ধিক হিসেবে।আত্মজৈবনিক বেশ কিছু রচনাও তিনি লিখেছেন, যেমন লিখেছেন সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে। বস্তুত, তিরিশের দশকের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আজও মানুষ হাতে তুলে নেন কালের পুতুল‘, ‘An Acre of Green Grassপ্রমুখ গ্রন্থ। আর লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য বা সঙ্গ ,নি:সঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থ দুটোই শুধু নয়, ‘রবীন্দ্রনাথ ও প্রতীচী‘,’রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক‘, ‘রবীন্দ্রনাথের গানে গদ‍্য ও পদ‍্যপ্রমুখ প্রবন্ধ আজও পাঠকের মনে উৎসাহের সঞ্চার করে। এর কয়েকটি প্রবন্ধ সাহিত‍্যচর্চাগ্রন্থেও স্হান পেয়েছে। আর জীবনের একেবারে শেষতম বছরে প্রকাশিত হওয়া মহাভারতের কথাআজও পাঠককে নতুন দৃষ্টিতে মহাভারতের কাহিনিকে অনুধাবন করতে শেখায়

   প্রথমে দুবছরের কিছু বেশি সময়ের প্রগতি‘, তারপর দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর ধরে প্রকাশ করেছেন কবিতাপত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই পত্রিকার শুভাকাঙ্ক্ষী, যতদিন জীবিত ছিলেন কবিতাও পাঠিয়েছেন মাঝে-মধ্যেইঅনেকের মতে, কবি জীবনানন্দ আবিষ্কৃত হয়েছিলেন সম্পাদক বুদ্ধদেবের চোখেই। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে পাঠকের সামনে হাজির করান তিনিইপদাতিকপ্রকাশিত হয় কবিতা-ভবনথেকেই । এছাড়াও সমর সেন শুধুমাত্র কবিতাপত্রিকাতেই কবিতা লিখেছেন। সমসাময়িক বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী-র অনেক কবিতাই এখানেই আগে প্রকাশিত হয়েছে। প্রচুর বিদেশি কবিতার অনুবাদ-প্রকাশও ছিল এই পত্রিকার একটা উল্লেখযোগ্য দিক।

   পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে অত্যন্ত ব‍্যস্ত হয়ে পড়েন বুদ্ধদেব। বিভাগের বিভিন্ন কাজকর্ম আর ঘনঘন বিদেশযাত্রার ফলে অবশেষে ক্ষীণ হয়ে আসে পত্রিকার জন্য সময়।

   বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে পাঠকমহলে একটি পরিচিত অভিযোগ যে, তিনি কলাকৈবল‍্যবাদী। সমসাময়িক প্রেমেন্দ্র মিত্র বা অচিন্ত্যকুমার যখন সামাজিক মানুষের সংকট দেখে আকুল হয়েছেন, বুদ্ধদেব তখনও ব‍্যক্তিগত শিল্পচর্চায় বিশ্বাসী গবাক্ষহীন ঘরে। যদিও ফ‍্যাসিস্টবিরোধী লেখক-শিল্পী সংঘ-র একসময় সদস্য হয়েছিলেন তিনি, বক্তৃতাও করেছেন, লিখেছেন স্বাজাতিকতা, দেশপ্রেম, বিশ্বমানবিকতাবা সভ‍্যতা ও ফ‍্যাসিজমনামের প্রবন্ধ-ও   নোয়াখালি দাঙ্গার পর গান্ধীজির সেখানে প্রাসঙ্গিকতা স্মরণ করে লিখেছেন নোয়াখালিনামের প্রবন্ধ- তবুও কবিতা, গল্পে, উপন্যাসে তিনি ছিলেন আত্মতার-ই সন্ধানী

   দীপ্তি ত্রিপাঠীর ভাষায়, ‘বুদ্ধদেব ব‍্যক্তিজীবনে বিশ্বাসী। বিষ্ণু দে-র মতো বিরাট সামাজিক জীবন তাঁর মনকে আকৃষ্ট করেনি। যে দীর্ঘ তিরিশ বছর তিনি কবিতা রচনা করেছেন সে তিরিশ বছর বাংলা তথা ভারতবর্ষের পটভূমিকা বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে মুহুর্মুহু কম্পিত হয়েছে। তবুও তিনি রাজনৈতিক প্রসঙ্গে নীরব ছিলেন, এমনকী সুধীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের মতো অনাস্থাও প্রকাশ করেননি।

   অনেক সমালোচক যদিও একথা বলেছেন যে, সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টির ওপর একের পর এক প্রবন্ধ রচনা করে যেভাবে তিনি উৎসাহ প্রদান করেছিলেন, বিপরীতক্রমে বুদ্ধদেবের রচনা সম্পর্কে কলম ধরতে কিন্তু সমকালীন লেখকদের ততখানি সোচ্চার হতে দেখা যায় না। তবুও নিজের লক্ষ্যে বুদ্ধদেব ছিলেন অবিচল।

   কিন্তু পরবর্তীকালের কবিরা প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন এই পূর্বজ সাহিত্যিককে। ছন্দের বারান্দাগ্রন্থে শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, তাঁর চরিত্রে আছে সুরের প্রতি আরোধ‍্য আকর্ষণ, তাঁর কবিতা বানিয়ে তোলে আসক্তি, ছড়িয়ে দেয় তীব্র মত্ত আত্মহারা ভালোবাসা।সেই গান সেই মত্ততা ছড়িয়ে যায় শিরায় শিরায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতায় লিখেছেন, ‘তোমার নিকটে এসে বৃক্ষের ভরসা পেত কবি, ছায়া পেত, সচ্ছলতা পেত সুন্দর।। আর শামসুর রহমান বুদ্ধদেব বসুর প্রতিকবিতায় লেখেন শব্দেই আমরা বাঁচি এবং শব্দের মৃগয়ায়/আপনি শিখিয়েছেন পরিশ্রমী হতে অবিরাম।/ …আপনার ঋণ / যেন জন্মদাগ, কিছুতেই মুছবে না কোনোদিন ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related news