কবিতাই আমার মাতৃভাষা

5 - মিনিট |

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে খোলামেলা আড্ডা

শ্রীজীব

জীবনের দিকে ফিরে তাকালে সবার আগে কোন কোন ঘটনাকে আপনি প্রাধান্য দেবেন।

জীবনের দিকে তাকালে সবার আগে নিজের বিষাদগুলোর কথা মনে পড়ে।ব্রিটিশরাজ দেখেছি, ভারতবর্ষের খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়া, স্বাধীনতা লাভ, স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখা, পশ্চিমবঙ্গের একধরনের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির দিকে যাওয়া এসবই আমার জীবনের বড় ঘটনা।

আমার মনে হয় কবিতাই আমার মাতৃভাষা। তাহলে গদ্য?

আমি মনেই করি কবিতা আমার মাতৃভাষা। গদ্য নয়। গদ্য আমি লিখতে বাধ্য হয়েছি। পেশাগত কারণে। খবরের কাগজে কাজ করার দরুন লিখেছিও প্রচুর। কিন্তু কেবলই মনে হয়, কবিতাকে ফাঁকি দিয়ে, তার থেকে সময় চুরি করে আমি গদ্যকে দিচ্ছি।

আপনার কবিতা মানেই ছন্দে লেখা একটা না একটা গল্প…

কবিতায় গল্প বলার বিষয়ে কী জানো, সম্পূর্ণ গল্পটা তো আর আমি কবিতায় ধরে দিতে পারব না। গল্পের একটা আভাস আছে, একটা ইঙ্গিত আছে আমার কবিতায়। একটা আন্দাজ দিতে পারব। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, আমাদের বাংলা সাহিত্যের কবিতা সেই গোড়া থেকেই গল্প বলে। মহাভারত পুরোটা জুড়েই তো গল্প আর গল্প।গল্পের সমষ্টি। আমাদের মঙ্গলকাব্য গল্প ছাড়া আর কী!আর সেগুলো তো পদ্যেই লেখা। ছন্দে লেখা গল্প।

ময়মনসিংহ গীতিকা, কিংবা পাঁচালি?

পাঁচালি গল্প ছাড়া আর কী বলো। পাঁচালিতে কী রয়েছে—একটা পরিবার খুব অশান্তিতে ভুগছে।পরিবারের যিনি শ্মশ্রুমাতা, শাশুড়ি ঠাকরুন, তিনি বনে গেছেন আত্মহত্যা করতে।তারপর সেখানে বনলক্ষ্মীর সঙ্গে দেখা। বনলক্ষ্মী জিজ্ঞেস করছে, বনে এসেছ কেন? শাশুড়ি ঠাকরুন বলছে,আমি আত্মহত্যা করতে এসেছি। কেন? বলছে যে, আমার সাত ছেলে। কর্তা হয়ে, সাত হাঁড়ি হয়েছে এখন। বউরা জ্বালিয়ে মারে আমারে। বনলক্ষ্মী বললেন, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। বুড়িবারে সন্ধ্যাকালে মিলি বামাগণ, সকলে লক্ষ্মীর পূজা করো আয়োজন। তাহলে দেখবে সংসারে আবার শান্তি ফিরে আসবে। এটা গল্প ছাড়া আর কী। গল্প পুরনো ব্যাপার, আর কবিতায় গল্প বলার ব্যাপারটা কিন্তু নতুন নয়।

কিন্তু আপনার কথনভঙ্গি! গদ্যের চলনে অন্তমিলের মৌলিক খেলা

আসল কথাটা তা নয়। আসল কথাটা হচ্ছে, লিরিক কবিতা। লিরিক কবিতায় গল্প বলার চলনটা ছিল না। লিরিক কবিতায় আমরা একটা ভুল ব্যাখ্যা করি। লিরিক কবিতাকে আমরা বলি গীতিকবিতা। আসলে এটা গীতিকবিতা নয়, পার্সোনালাইজড পোয়েট্রি। এখানে গদ্যের মধ্যেও কবিতার সেই গীতিসুধাটা থাকে। তো সে অর্থে আমি কোনও নতুন কাজ করিনি। যেটা করেছি, সেটা হল আমি আমার ভাষায় করেছি। এবং আমি মনে করি, আমি যদি গল্প ঢুকিয়েও থাকি কবিতার মধ্যে সেটা কোনও অন্যায় করিনি।

আপনার প্রথম বই নীলনির্জন। তার পিছনে রয়েছে একটি গল্প!

কবিতা না লিখে তো আমার উপায় ছিল না। কিন্তু নিজের পয়সা দিয়ে বই বের করব এমন ইচ্ছা আমার কোনোকালেই ছিল না।কিন্তু হঠাৎ করে একদিন অরুণকুমার সরকার এসে বললেন যে, সিগনেট প্রেসের প্রকাশক দিলীপ গুপ্ত মহাশয় তোমার একটি বই চেয়েছে। উনি তোমার বই করতে চান। পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দাও। সত্যি বলছি,প্রথমে আমি বিশ্বাস করিনি। তো ওর জোরাজুরিতে একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিলাম। এবং সেটা ওঁর হাতেই দিলাম। বই বেরিয়ে গেল। বেরুবার পর জানেত পারলুম দিলীপবাবু আমার বই চাননি। তিনি অরুণকুমার সরকারের বই করতে চেয়েছিলেন। জানার পর ওকে জিজ্ঞেস করলুম, এটা তুমি কেন করলে? তোমার বই উনি চেয়েছেন আর তুমি আমাকে বললে আমার বই চেয়েছেন।অরুণ হেসে বললে, তুমি এটা ভেবো না যে তুমি আমার চাইতে ভালো লেখো। এবং তুমি আমার চেয়ে বড় কবি। কিন্তু তোমার বই বেরুনো দরকার! তাই করেছি।

উলঙ্গ রাজা-র জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি। সে কবিতায় রয়েছে সত্যবাদী সরল সাহসী একটি শিশুর কথা। যে বলছে, রাজা, তোর কাপড় কোথায়? তাকে কী দেখেছেন আপনি, আপনার জীবনে? পেয়েছেন তার দেখা?

আসলে কী জানো, আমরা যত বড় হই তত ধান্দাবাজ হই। কারো প্রশংসা করি, তার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায়।চারদিক কতকগুলো চাটুকারের দ্বারা পরিবৃত হয়ে গেছে। এরা সবসময় আমাদের মন রেখে কথা বলার চেষ্টা করে। আসলে বাচ্চারা এসবের ধার ধারে না। সত্য বলতে তাদের কোনও কিছু আটকায় না। সত্য কথাটা একমাত্র তারাই বলে। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের গল্পে আছে না—চালাক জোলা আর বোকা রাজার গল্প। আসলে কোনোরকম কাপড় নেই, সে কাপড় পরানোর একটা ভঙ্গি করে মাত্র। হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে, রাজাকে বোকা বানিয়ে টাকা নিয়ে চম্পট দেয়।

আহা রাজবস্ত্র চোখে দেখা যায় না!

হ্যাঁ, এত পাতলা সুতো যে চোখে দেখা যায় না। এ গল্পটা ঠাকুরের কাছে ছেলেবেলায় শুনেছিলুম। তারপর মনে হয়েছে চারদিকের অবস্থা দেখে, কেউ সত্য কথাটা বলছে না। সবাই যে শাসক তার মন রেখে কথা বলছে।

অমলকান্তি কি আপনি?

আমার স্কুলের যে বন্ধু তার নাম অমলকান্তিই বটে। গরিবঘরের ছেলে। একদিন, খেলার মাঠে-ময়দানে বসে কথা হচ্ছিল নিজেদের মধ্যে, কে কী হতে চায়! কেউ মাস্টার হতে চায়, কেউ ডাক্তার।

অমলকান্তি রোদ্দুরই হতে চেয়েছিল?

ও যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। এমন একটা বস্তিতে থাকত যেখানে রোদ্দুরই ঢুকত না। ফলে ওর কাছে রোদ্দুর একটা প্রিয় জিনিস। কিন্তু সেই রোদ্দুরটা সে পাচ্ছে ন। নিজেই রোদ্দুর হয়ে যেতে চাইছে।

কবিতার ক্ষেত্রে তো সবসময়ই কল্পনার অবকাশ থেকে যায়। কিন্তু আপনার কবিতা বাস্তবতানির্ভর।সেখানে তেমন করে কল্পনার সুযোগ নেই। কিন্তু কেন?

বলতে পারো আমার কল্পনা অতি দরিদ্র। যে জগতে আমি বাস করি কবিতার জন্য তাকে জানা-বোঝাই আমার যথেষ্ট বলে মনে হয়েছে। কল্পনার প্রয়োজন হয়নি কখনও। চারপাশের মানুষজনদের দেখি, তাঁদের সুখ-দুঃখের খবর রাখি। হাটে-বাজারে যাই, শুনি তাঁদের কথা। বাসে-ট্রামে চলাফেরা করি, মানুষ দেখি। সারা জীবন ট্রামে-বাসে যাতায়াত করেছি। শুনেছি তাঁদের কথা। যা দেখেছি, যা শুনেছি—তা থেকেই আমার কবিতা। আলাদা করে আমার কিছু কল্পনা করতে হয়নি।

যে জীবন যাপন করি, বসত করি তার থেকে কবিতার অনেক কিছু নেয়ার আছে। নিয়েছিও। মানুষ যে ভাষায় কথা বলে—এরচেয়ে ভালো কবিতার উপাদান আর হয় না। আমার কবিতার ভাষা কখনও বানানো নয়। সেটা স্বতঃস্ফূর্ত। নির্মিত গদ্যের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই।

জীবনানন্দ দাশের কবিতা প্রসঙ্গে আপনি লিখেছিলেন আত্মঘাতী ক্লান্তির কথা। সে নিয়ে উঠেছিল নানা বিতর্ক

তখন ছিল আমার একুশ বছর বয়স। জীবনানন্দ দাশের আট বছর আগের একদিন কবিতা প্রসঙ্গে আত্মঘাতী ক্লান্তি কথাটি লিখেছিলেন। পরে পূর্বাশা পত্রিকায় এর জবাবও দিয়েছিলেন জীবনানন্দ। সেখানে তিনি লিখলেন, না, আমার ভেতরে কোনও আত্মঘাতী ক্লান্তি নেই। তবে পাছে ভুল বোঝাবুঝি আরও বাড়ে এ আশঙ্কায় তখন ওঁর কথায় কোনও উত্তর দিইনি। কিন্তু আমি এখনও বিশ্বাস করি একটা ভয়ংকর রকমের আত্মঘাতী ক্লান্তি আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তাঁকে। আরও এক বিপন্ন বিস্ময়/ আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/খেলা করে;/আমাদের ক্লান্ত করে/ক্লান্ত—ক্লান্ত করে;/লাশকাটা ঘরে /চিত হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।’—এই চরণগুলোর ভিতরে কি ক্লান্তি নেই? জীবনানন্দের জীবন সুখের ছিল না। এবং আমি জানতাম একটা আত্মঘাতী ক্লান্তি ওঁর মধ্যে কাজ করে। পরে অবশ্য তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে আমার কথাও হয়েছিল। ছেচল্লিশের দাঙ্গা-পরবর্তী সময়ের ঘটনা এটা। আমরা সে-সময় একসঙ্গে স্বরাজ নামে একটি পত্রিকায় কাজ করি। আমি নিউজে আর তিনি ছিলেন সাহিত্য বিভাগের দায়িত্বে। তখন তাঁকে বলেছিলাম, কোনও লোকের মধ্যে আত্মঘাতী ক্লান্তি থাকলে ক্ষতিটা কী? এটা নিয়ে কি মহৎ কবিতা হয় না? আমার কথা শুনে একেবারে চুপ হয়ে গেলেন জীবনানন্দ। আসলে তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন।

কবিতা বলতে কিছু গুণপনার কথা বুঝি, যা গদ্যের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝিলিক মেরে ওঠে। তখন আমরা বলি, কবিতার মতো গদ্য। রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠে দেখো, জলে আছে মাছ/গাছে থাকে পাখি/বনে থাকে বাঘ। এই সব পঙক্তির মধ্যে ভারসাম্য আছে, যাকে কবিতা বললে কম বলা হয়। এ হচ্ছে কবিতার গুণের দ্বারা আক্রান্ত গদ্য…

হ্যাঁ,গদ্য হচ্ছে যুক্তির ভাষা। আর কবিতা হচ্ছে কবির স্বগত সংলাপ। গদ্য হচ্ছে প্রতিপাদন করার ভাষা, প্রমাণ করার ভাষা। ধরো বলছি, জালাল পাজি লোক। এটা সিদ্ধান্ত। এখন জালাল সম্পর্কে যথাসম্ভব তথ্যসংগ্রহ করতে করতে প্রমাণ করতে হবে ওই সিদ্ধান্তকে।এখানে হেতুবাক্য বলে একটা কথা আছে। রাম-শ্যাম-যদু-মধু—কত লোককে মরতে দেখেছি। এবং তা থেকে সিদ্ধান্ত করছি মানুষ মরণশীল। অতএব নীরেন্দ্রনাথকে মরতে হবে। আমরা আগে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই, তারপর তথ্য বাছাই করি। তা করলে চলবে না। তথ্যসংগ্রহ করতে করতে দেখা গেল, জালাল পরের উপকার করে, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করে। কিন্তু একদিন তাকে রাতে কোথায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা গিয়েছে বা কারো সঙ্গে তর্ক করছে—শুধুমাত্র এইটুকু তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা হল সে পাজি লোক। কিন্তু সে পরোপকারী বা পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল—একথা বলা হল না। এরকম তথ্য বাছাই করে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কোনও গদ্য বা প্রবন্ধ দুর্বল হয়, তা শেষপর্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে না।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধের গদ্যকে আদর্শ গদ্য বলি। কারণ, সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে যুক্তি দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করেন।তাঁর বাহুবল ও বাক্যবল প্রবন্ধটির কথা ধরো। প্রথমে তিনি বুঝিয়ে বলছেন বাহুবল কী, বাক্যবল কী। এবং শেষে বলছেন, বাহুবলের চেয়ে বাক্য কেন শক্তিশালী। এ অনেকটা জ্যামিতির প্রতিপাদ্যের মতো।

যুক্তবিদ্যার প্রথম সোপান জ্যামিতি। নজরুলকে খারাপ কবি প্রমাণ করার জন্য কেউ কেউ তাঁর ত্রুটিগুলো শুধু তুলে ধরে। কিন্তু নজরুল কেন এত মানুষের প্রিয়—সে কথা বলে না। আবেগ হচ্ছে দুধ, আর উচ্ছ্বাস হচ্ছে তার ফেনা। এই ফেনিলতা পছন্দ নয় গদ্যে।

কবিদের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখবেন?

একজন চাষি যখন লাঙল কাঁধে মাঠে চাষ করতে যায়। বা একজন শ্রমিক যখন তার হেতের নিয়ে কারখানায় কাজ করে, তখন কি তারা সমাজের উপকার করছে বলে সেগুলো করে? তা তো নয়, তারা ওই কাজ করে তাদের জীবনধারণের জন্য, খাওয়াপরার জন্য। কিন্তু কাজগুলো এমনই যে তাতে সমাজের উপকার হয়। যে ভালো লোক, সে কারু উপকার করতে না পারুক, অপকার তো করে না। কিটসের কথা ধরো, তিনি কখনও সোশ্যাল কমিটমেন্টের কথা বলেননি। কিন্তু তাঁর কবিতা কি সমাজের কোনও অপকার করেছে!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related news