বিপ্লবীর কন্যা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ই মেলে জানতে চাইলেন কারাগারের শহিদ-স্মৃতি সংরক্ষণ পরিকল্পনার কী হল?
নেতাজি, অরবিন্দ থেকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু সেনানীর স্মৃতি বিজড়িত এই দুই সংশোধনাগারই সরে যাচ্ছে বারুইপুরে
আলিপুর সংশোধনাগার তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে আগেই। বারুইপুরের নয়া সংশোধনাগারে চলছে বন্দি স্থানান্তর। রাজ্য বিধানসভার চলতি অধিবেশনেও এর আঁচ এসে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে এক অমর বিপ্লবীর কন্যা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ই মেলে জানতে চাইলেন কারাগারের শহিদ-স্মৃতি সংরক্ষণ পরিকল্পনার কী হল?
নেতাজি, অরবিন্দ থেকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু সেনানীর স্মৃতি বিজড়িত এই দুই সংশোধনাগারই সরে যাচ্ছে বারুইপুরে। রাজ্য কারা দফতর সূত্রের খবর, প্রথমে আলিপুর সংশোধনাগারকে সরানোর কাজ হবে। তার পর ধাপে ধাপে সরবে প্রেসিডেন্সি। গত জুলাই মাসে আলিপুর সংশোধনাগারের বন্দিদের অন্য জেলে সরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। আলিপুর থেকে বন্দিদের সরানো শেষ করতে বলা হয়েছিল এক বছর আগে। গত বছর বর্ষার কারণে তা সাময়িক স্থগিত ছিল। সূত্রের খবর, সেই প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি।
বাংলার সেকালের দুই দামাল কন্যা শান্তি-সুনীতি কারাবন্দি ছিলেন। সুনীতি চৌধুরীর মেয়ে ভারতী সেন ওখানে গিয়ে সব দেখে এসেছেন। মুম্বাইয়ের এসএনডিটি কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপিকা ভারতী দেবী মনে করেন, ঐতিহাসিক ওই জায়গায় প্রোমোটিংয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হোক স্মৃতি সংরক্ষণে। বিষয়টা কোন পর্যায়ে আছে, তা জানতে তিনি মেল করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এরপরে মুখ্যমন্ত্রী পুরসভার মেয়র ও কমিশনারের কাছে রিপোর্ট চান। প্রায় এক মাস বাদেও ভারতী দেবী মুখ্যমন্ত্রীর অবশ্য উত্তর পাননি।
মুখ্যমন্ত্রীকে ভারতী দেবী লিখেছেন, “১৯৩১ সালে আমার মা সুনীতি চৌধুরী (ঘোষ) ও শান্তি ঘোষ (দাস) ১৪ বছর বয়সে কুমিল্লার ডগলাসকে গুলি করে হত্যা করেন। ওঁরা ছিলেন আলিপুরের প্রথম মহিলা বন্দী। প্রথমদিকে আলিপুরে মহিলা বন্দিদের পৃথক সেল ছিল না। আপনি বাঙালির সংস্কৃতি সংরক্ষণে আগ্রহ দেখান। আমাদের কেবল বর্তমান প্রজন্ম নয়, ভাবী প্রজন্মের স্বার্থে ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। আমি কলকাতায় থাকি না। শুনেছি পুরণো জেল ভেঙে ফেলা হবে। কিছু প্রস্তাব দিচ্ছি। জেলের সম্মুখভাগ অবিকৃত রাখা হোক। বাঙলার বিপ্লবীদের স্মরণে করা হোক গ্যালারি। পুরনো ফাঁসিকাঠের আদল এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ওখানে দেখানোর ব্যবস্থা করুন।”দুই সংশোধনাগারই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বহন করছে। তাই এই স্থানান্তর নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কারা আধিকারিকরা অবশ্য জানান, ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে, দুই সংশোধনাগারের এমন বেশ কিছু জায়গা সংরক্ষণ করা হবে। কিন্তু ঐতিহ্য সংরক্ষণের নকশা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন অতিরিক্ত কমিশনার সন্ধি মুখোপাধ্যায় বলেন, “কারার ঐতিহ্যের পরিকল্পিত সংরক্ষণ করে গোটা বিশ্বের বাঙালিদের কাছে একটা তীর্থক্ষেত্র করে তোলা সম্ভব। বিপ্লবীদের ছবি, স্মৃতি— এ সব নিয়ে ওখানে আলো ও ধ্বণি প্রকল্প করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে এ শহরের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংবেদনশীল কিছু মানুষ উদ্যোগী হয়েছেন। আমি ওঁদের সঙ্গে সহমত পোষন করছি।”
শান্তি ঘোষের নাতি মুম্বাইনিবাসী চন্দ্রাদিত্য দাশ এই প্রতিবেদককে জানান, “আগামী প্রজন্মের স্বার্থেই আলিপুর জেলের এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ দরকার। এই স্মৃতির একটা অপরিসীম মূল্য রয়েছে।” ১৯৪০-এ প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারেরই ইউরোপিয়ান ব্লকের দোতলার একটি সেলে কয়েক মাস (২ জুলাই থেকে ৫ ডিসেম্বর) বন্দি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারেও বেশ কয়েক মাস বন্দি থাকতে হয়েছিল তাঁকে। সেটা ১৯৩০-এর জানুয়ারি। এখানে অন্তরীন ছিলেন বীণা দাশ, সুহাসিনী গঙ্গোপাধ্যায়, কমলা দাশগুপ্ত, লীলা রায়, উজ্জ্বলা মজুমদারের মত বিপ্লবীরা।
নবনির্মিত বারুইপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে গত ৩১ মে পর্যন্ত মোট ৯০৮ জন বন্দিকে আলিপুর সংশোধনাগার থেকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। বুধবার বিধানসভা অধিবেশনে এই বিষয়টি প্রশ্নপত্রে থাকলেও তা সময়ের অভাবে উত্থাপন করা যায়নি। পরে অধিবেশন কক্ষের বাইরে রাজ্যের কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস বলেন, আলিপুর সংশোধনাগারে ছিল মোট ১৭০০ জন বন্দি। এর মধ্যে ৯০৮ জনকে বারুইপুর সংশোধনাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। যাদের মধ্যে রয়েছে ৩৫৮ জন সাজাপ্রাপ্ত এবং ৫৫০ জন বিচারাধীন বন্দি। বাকি প্রায় ৮০০-র কাছাকাছি বন্দিকে অন্য সংশোধনাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যে, যে জেলার বন্দি, তাদের সেই এলাকার সংশোধনাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে রাজ্যের ৫৯টি সংশোধনাগারে মোট ২৫ হাজার বন্দি রয়েছে।