জেলা পরিষদের সভাপতি নির্বাচনে দলবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ এনে জেলা কংগ্রেস দলীয় চার পারিষদের মধ্যে তিনজনকে ছয় বছর এবং একজনকে আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করেছিল। এই ঘটনার রেশ ধরে জেলা কংগ্রেসের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল সরগরম হয়ে উঠেছে।
জেলা পরিষদের সভাপতি নির্বাচনে দলবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ এনে জেলা কংগ্রেস দলীয় চার পারিষদের মধ্যে তিনজনকে ছয় বছর এবং একজনকে আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করেছিল। এই ঘটনার রেশ ধরে জেলা কংগ্রেসের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল সরগরম হয়ে উঠেছে। একদিকে বহিষ্কৃতরা জেলা কংগ্রেসের একতরফা সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের দ্বারস্থ হতে চলছেন, অন্যদিকে দলীয় অন্যান্য জেলা পরিষদ সদস্যরা বহিষ্কৃতদের মিথ্যা রটনা থেকে বিরত থাকতে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।
জেলা কংগ্রেস কর্তৃক কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হেলাল খান শাসকদলের রিমোটে সিদ্দেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, অভিযোগ তুলেছেন মমতাজ বেগম-সহ দলীয় অন্যান্য সতীর্থরা। করিমগঞ্জ জেলা পরিষদের সভাপতি নির্বাচনে দলের পরাজয়ের ‘খলনায়ক অকৃতজ্ঞ’ হেলাল খানের মুখে এমন অভিযোগ বেমানান বলে মমতাজের পাশে দাঁড়ালেন দলীয় অন্যান্য জেলা পারিষদরা।
রবিবার আসিমগঞ্জে নিজের বাসভবনে এক সাংবাদিক বৈঠকে মমতাজ বেগম অভিযোগ করে বলেন, কংগ্রেসে থেকে হেলাল খান যে মানসম্মান পেয়েছেন তা দ্বিতীয়বার পেতে হলে আরেক জন্ম নিতে হবে তাঁকে। দলীয় প্রার্থী চয়ন সভায় হেলাল খানের প্রার্থিত্বের কোনও প্রস্তাবকই ছিলেন না বলেও সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করেন স্বদলীয় সদস্য-সদস্যারা। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার বিনিময়ে পারভিন বেগম ও পারভিন চৌধুরী সরকারি কোয়ার্টার উপহার পেয়েছেন। এমন চাঞ্চল্যকর অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন মমতাজ। লোভে পড়ে দলের ভরাডুবি ঘটিয়ে হেলাল খান নিজেকে যতই নায়ক মনে করুন না-কেন, তিনি যে আসলে খলনায়ক তা জেলাবাসীর বুঝতে আর বাকি নেই বলে মন্তব্য করে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ভাষায় হেলাল খানকে পাল্টা আক্রমণ করেন মমতাজ।
প্রাক্তন মন্ত্রী সিদ্দেক আহমেদের বিরুদ্ধে তাঁর উত্থাপিত যাবতীয় অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়ে দেন আসিমগঞ্জ জেলা পরিষদ সদস্যা তথা আইনজীবী মমতাজ বেগম। হেলাল খানকে ‘নিমকহারাম’ ও “বিশ্বাসঘাতক” আখ্যা দিয়ে অযথা সিদ্দেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ করার আহ্বান জানান মমতাজ। তার সঙ্গে উপস্থিত দলীয় অন্যান্য জেলা পরিষদ সদস্য-সদস্যারাও এ বিষয়ে সাংবাদিক বৈঠকে সহমত পোষণ করেন। ‘বিশ্বাসঘাতক’-এর কাছ থেকে কৃতজ্ঞতার সার্টিফিকেট নিতে হবে না মমতাজকে, এ-মন্তব্য করে মমতাজের বিরুদ্ধে মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন কংগ্রেসিরা।
জেলা পরিষদের সভাপতি নির্বাচনের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট প্রকাশ্যে এনে প্রদেশ কংগ্রেসের উপ-সভাপতি সিদ্দেক আহমদেকে ক্লিনচিট দিলেন মমতাজ ও অন্যান্য দলীয় জেলা পারিষদরা। দলীয় প্রার্থী চয়ন সভায় হেলাল খানের প্রার্থিত্বের কোনও প্রস্তাবকই ছিলেন না বলে দাবি তুলেন জেলা পরিষদের স্বদলীয় অন্য সদস্য-সদস্যারা। বিশ্বাসঘাতকতার বিনিময়ে পারভিন বেগম ও পারভিন চৌধুরী নগদ অর্থ-সহ সরকারি কোয়ার্টারর উপহার পেয়েছেন বলেও চাঞ্চল্যকর অভিযোগ প্রকাশ্যে আনেন মমতাজ বেগম।
আইনজীবী মমতাজ বেগমের আসিমগঞ্জের বাসভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সতীর্থদের পাশে বসিয়ে জেলা পরিষদ নির্বাচনের যাবতীয় প্রেক্ষাপট খোলসা করে সিদ্দেক আহমদের পাশে দাঁড়ান জেলা পরিষদ সদস্যরা। পাশাপাশি কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হেলাল খানের উত্থাপিত যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে বাস্তবে এ-ধরনের ভিত্তিহীন, মিথ্যা বিভ্রান্তি না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন আইনজীবী মমতাজ বেগম ছাড়াও কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত সরিষা-বাজারঘাট জেলা পরিষদ সদস্য সুখেন্দু শুক্লবৈদ্য, মাইজগ্রাম-সুতারকান্দি জেলা পরিষদ সদস্যা আমিনা বেগম চৌধুরী, সাদারাশি-লক্ষ্মীবাজার জেলা পরিষদ সদস্য হাজি আব্দুল শুক্কুর, বাখরশাল-নাইরগ্রাম জেলা পরিষদ সদস্য গুলজার হোসেন খান ও গান্ধাই-ব্রাহ্মণশাসন জেলা পরিষদ সদস্য শঙ্কর মালাকার।
দলের সঙ্গে বেইমানি করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি আদায় করার অভিযোগ তুলে তাঁরা একহাত নেন দল থেকে বহিষ্কৃত কংগ্রেসি সদস্যা আফরুজা পারভিন, পারভিন চৌধুরী ও পারভিন বেগমকে। কংগ্রেসি জেলা পরিষদ সদস্যরা এদিন রাতাবাড়ির জেলা পরিষদ সদস্য হেলাল খানকেই দলের ভরাডুবির জন্য দায়ী করেন। অকৃতজ্ঞ, বিশ্বাসঘাতক, নিমকহারাম ইত্যাদি কটু শব্দে হেলালকে আক্রমণ করে তাঁরা বলেন, দল তাঁকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত করেছিল। এমন-কি গত কংগ্রেস সরকারের আমলে রাজ্য গ্যাস কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টর পদেও মনোনীত করা হয়েছিল। এ-সব সম্মান জীবনে দ্বিতীয়বার পেতে হলে হেলাল খানকে পুনর্জন্ম নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন কংগ্রেসি জেলা পরিষদ সদস্যরা।
আফরুজা পারভিন ও পারভিন চৌধুরী বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্হের বিরুদ্ধে যে-সব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তা খণ্ডন করে তাঁরা বলেন, দলীয় সদস্য-সদস্যাদের যাবতীয় আবদার অভিযোগ মিটানোয় স্ব-ইচ্ছায় মমতাজ বেগমকে সভানেত্রীর পদে সমর্থন করেছিলেন আফরুজা। অথচ লোভের ফাঁদে পড়ে স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে দলের ভরাডুবি ঘটিয়েছেন আফরুজা-সহ তাঁর সঙ্গীরা।
এদিকে আজকের সাংবাদিক বৈঠকে মমতাজরা বোর্ড গঠন পর্বের সম্পূর্ণ ক্লাইমেক্স তুলে ধরে বলেন, প্রথমবার বোর্ড গঠনের তোড়জোড় শুরু হওয়ার পর দলীয় নয় সদস্য ও সদস্যা লিখিতভাবে দলকে জানিয়েছিলেন হেলাল খান ছাড়া যে-কোনও কাউকে সভাপতি প্রার্থী প্রজেক্ট করা হলে তাদের সমর্থন থাকবে। দলীয়ভাবে প্রার্থী চয়ন সভায় একাধিক দাবিদার থাকায় ভোটাভুটি হয়। তখন হেলাল খানের প্রার্থিত্বের পক্ষে কোনও প্রস্তাব না থাকায় প্রার্থিত্বের দাবি থেকে সরে দাঁড়ান খান। দুই প্রত্যাশী আফরুজা ও মমতাজের মধ্যে দলীয় ভোটাভুটিতে মমতাজ বেগম নির্বাচিত হন। কিন্ত রহস্যজনকভাবে দলীয় প্রার্থী চয়ন ভোটে হেরেও আফরুজা প্রার্থিত্ব থেকে সরে না দাঁড়ানোয় দলীয় অন্দরমহলে নতুনভাবে জটিলতার সৃষ্টি হয়। শেষপর্যন্ত দলের স্বার্থে আফরুজাকেই সমর্থন জানান মমতাজ বেগম। পরবর্তীতে ভোটাভুটিতে ১০-১০ ভোটে ফলাফল হয়ে ড্র। অবশেষে সর্বসম্মতিতে টসের সাহায্য নেওয়া হয়। এতে সভানেত্রী নির্বাচিত হন আফরুজা পারভিন। অবশ্য তৎকালীন জেলাশাসক ফণীভূষণ রায় শাসকদলের ইশারায় বিষয়টি উচ্চ আদালতে নিয়ে যান। দীর্ঘ দশ মাসের আইনি লড়াইয়ের পর আদালত পুনর্বার ভোটের নির্দেশ দিলে দলীয় সভায় সর্বসম্মতিতে মমতাজ বেগমকে সভানেত্রী প্রার্থী মনোনীত করা হয়। আদালতের নির্দেশ প্রদানেরর প্রাকমুহূর্তে শাসকদলের কোনও এক বিধায়কের দিশপুরে অবস্থিত সরকারি আবাসে বসেই নাকি দলের ভরাডুবির ছক তৈরি করেন হেলাল খান। এমনই চাঞ্চল্যকর অভিযোগ প্রকাশ্যে আনেন মমতাজ। তিনি বলেন, শুরু থেকেই পারভিন চৌধুরী, আফরুজা পারভিন, পারভিন বেগম ও হেলাল খানের ভূমিকা সন্দেহজনক ছিল। এমন-কি দলের ভোটিং ক্যাম্প থেকেও চুপিসারে রাতের অন্ধকারে শাসকদলের নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশে ছিলেন বহিষ্কৃত সদস্য-সদস্যারা, এই অভিযোগও আজকের সাংবাদিক বৈঠকে উত্থাপন করেন মমতাজ ও দলীয় অন্যান্য জেলা পরিষদ সদস্যরা।