চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা মহাপ্রকল্পে প্রাধান্য দেবো ভারতকে |চীন ঋণ দেবে, কিন্তু নেবার বেলায় হিসাব করে নেবো

5 - মিনিট |

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, যাকে পাবো তাকেই ধরবো – ট্রাম্পের ওপর হামলা, আমেরিকার মতো জায়গায় হয় কী করে?

সমীরণ রায়

বাংলাদেশ : তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিস্তা মহাপ্রকল্পে প্রাধ্যান্য দেবো ভারতকে। তিনি বলেন, তিস্তা প্রকল্প বহু যুগের। বহুদিন ধরে এটা চলে আসছিল। আমার মনে পড়ে, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়ও এটা ছিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে বহুবার এটা ছিল। তিস্তা প্রকল্প করতে হবে। চীনও কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল। তার সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে। ভারতও অফার দিয়েছে। তারও সম্ভাব্যতা যাছাই করবে।

এটা করার পরে যেটা আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত সেটা নেবো। তবে আমি বেশি প্রাধান্য দেবো, এটা ভারত করুক। কারণ, তিস্তার পানিটা ভারত আটকে রেখেছে। ভারতের কাছ থেকে আদায় করতে হলে প্রকল্পের কাজ তাদের করা উচিত। তারা প্রকল্প করে যা প্রয়োজন তা দেবে। এটা হচ্ছে কূটনীতি।

এখানে আর কোনো কথা না। চীনতো প্রস্তুত, কিন্তু আমি চাচ্ছি এটা ভারত করে দিক। কারণ এ প্রকল্পের জন্য যা দরকার ভারত দিতে থাকবে। এটা সাফ সাফ কথা। রাখঢাক নাই। আমাদের পিররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরীতা নয়। রোববার গণভবনে সাম্প্রতিক চীন সফর পরবর্তী আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী।

চীনের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চীনের সঙ্গে চুক্তির করার পাশাপাশি এটাও ঠিক করে এসেছিঠ, কোন কোন জায়গায় আমরা অর্থ নেবো এবং কাজে লাগাবো। সেটা যৌথভাবে তাদেরও লোক আসবে, আমাদেরও টিম করে বসে প্রত্যেকটা প্রকল্পে নির্দিষ্ট করে আমরা টাকা নেবো। তারা আমাদের বিরাট অফার দিয়েছে তা ঠিক, কিন্তু নেবার সময় এ হিসাবটা করে আমাকে নিতে হবে। চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও এ বিষয়েও আমার এ কথা হয়েছে।

অনুদান দেবেন, ঋণ দেবেন, কিন্তু নেবার বেলায় আমাদের মতো হিসাব করে নেবো। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজদের ধরলেই সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, এটা বিশ্বাস করি না। আমার দায়িত্ব, অনিয়মগুলো ধরে দেশকে একটা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। দুর্নীতি নিচের দিকে বেশি হচ্ছে। দুর্নীতি এমন পর্যায়ে ছিল, কাজই করা যেত না। সেখান থেকে পরিস্থিতি তো বদলেছে। হাত যখন দিয়েছি, ছাড়ব না। আপন-পর জানি না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সই থাকবে। যাকে পাবো, তাকেই ধরবো। যখন ধরছি, হাতেনাতে ধরা পড়বেন যারা, ব্যবস্থা আমরা নেবো।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। বাস্তব কথা। কী করে বানাল এত টাকা? যখনই আমি জেনেছি তাকে বাদ দিয়ে কার্ড-টার্ড সব সিজ করে আমার ব্যবস্থা আমি নিয়েছি। এটা তো হয়, এটা করে। ধরা পড়লে তো চোখে আসে। তাছাড়া তো হয় না। যখন ধরা পড়ে তখন ব্যবস্থা নিই।

সরকার কঠোর হওয়ার কারণেই দুর্নীতিবাজরা ধরা পড়ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর আগে কেউ দুর্নীতির বিরুদ্ধে এভাবে অভিযান করেনি। এর আগে জঙ্গিবাদমুক্ত করেছি। দুর্নীতি দীর্ঘদিনের সমস্যা। এসব জঞ্জাল সাফ করতে হবে। আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি বলেই জানতে পেরেছেন। বাংলাদেশ কেন, সারা বিশ্বে বড় বড় পত্রিকা-চ্যানেলের মালিক যারা বড়লোক তারাই হয়। সাধারণ মানুষ তো এটা চালাতে পারে না। তাদের ধরতে গেলে নানা কথা শুনতেও হবে।

তারপরও আমি যখন-আমি ছাড়বো তো না। অন্য কারও কথা জানি না। আমি তো ছাড়বো না। নিচের দিক থেকে দুর্নীতি বেশি হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দুর্নীতি নিচের দিক থেকেই বেশি হচ্ছে, এটা হচ্ছে বাস্তবতা। উৎসমুখ, কোন জায়গায় কোন উৎসমুখ, কয়টা খুঁজবেন। এখানে কোন ড্রাইভার কত টাকা বানালো, কে কী টাকা বানালো! এখন ড্রাইভার লেভেলে যদি করে, সেটা খোঁজ করে বের করে আজ ধরছি বলেই জানতে পারছেন। এতকাল তো জানতে পারেননি।

করোনাকালের সরকারি কেনাকাটার প্রসঙ্গে টেনে সরকার প্রধান বলেন, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সব জায়গায় দুর্নীতি তো এমন পর্যায়ে ছিল যে কোনো কাজই তো করা যেত না। সেখান থেকে ধীরে ধীরে আমরা অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসছি। আর করোনার সময় বিষয়টা ছিল, কেনাকাটার যে নিয়ম যেমন টেন্ডার দেওয়া, এগুলো করতে গেলে তো রোগী বাঁচানো যেত না। তখন আমাদের কতগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। যেমন আমার সিরিঞ্জ কিনতে হবে, এটা টেন্ডার দিয়ে করতে গেলে ভ্যাকসিন দেবো কবে? আমি সোজা প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছি কোথায় পাওয়া যায়? ছোটটা পাওয়া যায় না দাম বেশি।

আমার দরকার, দাম বেশি দিয়েও আনতে হবে। তিন দিনের মধ্যে প্লেন পাঠিয়ে চার দিনের মধ্যে নিয়ে এলাম। এখন যদি ওটার দুর্নীতি ধরতে চান ধরতে পারেন। কিন্তু তখন আমার কাছে ছিল মানুষ বাঁচানো ফরজ। মানুষকে আমি কীভাবে বাঁচাবো। ভ্যাকসিন বুকিং দিতে হবে। সরকারিভাবে করতে গেলে দীর্ঘসময়, টেন্ডার করতে হবে, টাকা দিতে হবে, হেনতেন। আমি কী করলাম, বেক্সিমকোকে বললাম এত টাকা আগেই ডিপোজিট দিয়ে বুকিং দিতে হবে।

এটা প্রাইভেট সেক্টর-প্রাইভেট সেক্টর দিলে সমস্যা নেই। টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি, তুমি বুকিং দাও। এভাবে বুকিং দেওয়ালাম। ভ্যাকসিন রাখার জন্য ফ্রিজার দরকার। ফ্রিজ কিনতে হবে। টেন্ডার দিয়ে কিনতে গেলে কত সময় লাগবে? সোজা অনলাইনে বুকিং দিয়ে কোথায় পাওয়া যায়। প্লেনে করে উঠায়ে নিয়ে আসবে। স্যানিটাইজারের বিরাট মেশিন। প্লেনে ধরে না। সেটা ভেঙে নিয়ে আসা হলো। আমি তো এভাবে কাজ করেছি। যদি দুর্নীতি ধরতে চান এসব জায়গায় দুর্নীতি ধরতে পারবেন্

চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না। অপরাধটা কী? নিজের জীবনবাজি রেখে, সংসার সব ফেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। দিনরাত খেয়ে না খেয়ে, কাদামাটি ভেঙে, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মোকাবিলা করে যুদ্ধ করে এ দেশের বিজয় এনেছে।

বিজয় এনে দিয়েছিল বলে সবাই উচ্চপদে আসীন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনা সবকিছু মুছে ফেলা হয়েছিল। মনে হয়েছিল পাকিস্তানিদের প্রদেশ হয়ে গেছি আমরা। সেইখান থেকে বাংলাদেশ ফিরে এসেছে। জয়বাংলা ফিরে এসেছে। সাতই মার্চের ভাষণ ফিরে এসেছে। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনলে ভালো লাগে না! মানে গায়ে জ্বর আসে! বড় অদ্ভুত লাগে আমার মুক্তিযোদ্ধার নাতনি, সে ভর্তি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। উনি বলেন কোটা থাকবে না।

ব্যাটা তুই তাহলে চলে আয়, পড়াশোনার দরকার নেই। তুই মুক্তিযোদ্ধার নাতি হিসাবে কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এখন বলে কোটা লাগবে না। তোকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া উচিত। কোটা নেই তোর পড়াও নেই, বাড়ি যেয়ে বসে থাকা উচিত। যদি লজ্জা থাকতো তাহলে আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে বলুক যে কোটা লাগবে না। বিচিত্র এ দেশ। অবশ্যই আমাদের দেশটা বিচিত্র। বিচিত্র মানসিকতা। ছয় ঋতুর দেশ তো, ঋতুও বদলায় বোধও বদলায়।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নভেম্বরে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত বড় গণতন্ত্রের দেশে এরকম হামলার ঘটনা কীভাবে ঘটে, এটা কতটা সঙ্গত সেই প্রশ্নও রাখেন। তিনি বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনক। একজন প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট, আর তার ওপর এই ধরনের হামলা করা আমরা এটার অবশ্যই নিন্দা জানাই।

KRC-TIMES-Subscription

আমেরিকা তাদের গণতন্ত্র নিয়ে অনেক গর্ববোধ করে। অথচ সেখানেই দেখা যাচ্ছে! আমরা তো গুলি-বোমা খেয়েই অভ্যস্ত, অনবরতই খাচ্ছি। সেখানে একজন অপোনেন্টকে এভাবে গুলি করা। তারপর তিনি ফরমার প্রেসিডেন্ট, তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। তার একেবারে কানের ওপর দিয়ে চলে গেছে। যদি একটু এদিক-ওদিক হতো বাঁচতো না। এটা আমেরিকার মতো জায়গায় হয় কী করে? আমেরিকার মতো সভ্য দেশে, যারা গণতন্ত্র এত বড় প্রবক্তা, এত বড়ৃ সেই দেশে এই ঘটনা ঘটবে কেন? সেটাও তো আমাদের একটা প্রশ্ন।

এই ঘটনা বাংলাদেশে হলো তো সরকারকে দায়ী করতো। এক গ্রুপ সরকারকে দায়ী করতো, আরেক গ্রুপ, যেমন আমি গ্রেনেড হামলায়, আমি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে নিজেই মেরেছি, বলে দিলো। কিন্তু ওরা (যুক্তরাষ্ট্রে) সরকারকে দায়ী করেনি, আবার প্রেসিডেন্ট বাইডেনও এটার নিন্দা করেছেন। কাজেই এইটুকু সভ্যতা তাদের আছে। যাদের কথায় কথায় আমাদের দেশের দোষারোপ করার চিন্তা, তাদের ওখান থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।

শেখ হাসিনা বলেন, সাংবাদিকদের সমস্যা জানি বলেই যে পেনশন স্কিম দিয়েছি, তারা যদি এখন থেকে যুক্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যৎটা চিন্তামুক্ত থাকবে। এখন মালিকদের ওপরে চাপ দিতে হবে পেনশন স্কিমে তারাও কিছু অংশ দেবে। ৫০ শতাংশ মালিকরা দিয়ে দিতে পারে। লাইসেন্স দিচ্ছি বলেই এত চাকরি হচ্ছে। না হলে হতো না। সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ডের বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো। আবার সেখানে একটা নওয়াব হয়ে আছে। এত নবাবগিরি দেখানো হয়, আমরা কোথায় যাবো? বেসরকারি খাত উন্মুক্ত করেছি বলেই মানুষের কাজের সুযোগ হয়েছে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related news