স্কুলের নাম বল্লভপুর ডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়। আদিবাসী অধ্যুষিত শান্তিনিকেতনের খোযাই জঙ্গল ঘেষা গ্রামের কচি-কাঁচারা এই স্কুলের পড়ুয়া। তাদের অনেকেই অনাথ। বিদ্যালয়ের বিল্ডিংটিও ভারী সুন্দর। সারা স্কুলে কোন চার দেওয়ালের ক্লাস রুম নেই
এই স্কুলে ভর্তি হলে প্রথমেই মাস্টার মশাই সবাইকে নিয়ে স্কুল ঘুরিয়ে দেখায়। চিনিযে দেন স্কুল চত্বরের বিভিন্ন গাছপালা। তারপরেই প্রতি ছাত্রছাত্রীদের একটি করে বোর্ড হাতে দেওয়া হয়। তাতে লেখা একটি গাছের নাম।
প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলেই পড়ুয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয় গাছের নাম ও পড়ুয়ার নাম লেখা একটি নেমপ্লেট। চিনিয়ে দেওয়া হয় গাছ । ভর্তির হওয়ার পরের দিন থেকেই সেই গাছটির সমস্ত দায়িত্ব ওই পড়ুয়ার। আর পডুযাকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন মাস্টার মশাই দিদিমণিরা।
ভর্তির পরদিন থেকেই স্কুল চত্বরের সেই গাছের দায়িত্ব পড়ে যায় ওই পড়ুয়ার উপর । সেই গাছই হয়ে ওঠে পড়ুয়ার আপনজন। সেবা-যত্ন, জল দেওয়া, সার দেওয়া, গোঁড়ার মাটি খুঁড়ে দেওয়া, পোকা-মাকরের হাত থেকে রক্ষা করা, আবার গাছে ফল ধরলে তা কিন্ত একার নয়। পাকা ফল স্কুলের সবাই কে ভাগ করে খাওয়ানোর আনন্দ পায় ঐ খুদেরা। এই সব কিছু প্রতিদিন নিজে হাতে করেন কচি-কাঁচারা। পড়াশোনার ফাঁকে গাছকে ভালোবেসে প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে ওঠার এমনই এক অভিনব উদ্যোগ একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!
স্কুলের নাম বল্লভপুর ডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়। আদিবাসী অধ্যুষিত শান্তিনিকেতনের খোযাই জঙ্গল ঘেষা গ্রামের কচি-কাঁচারা এই স্কুলের পড়ুয়া। তাদের অনেকেই অনাথ। বিদ্যালয়ের বিল্ডিংটিও ভারী সুন্দর। সারা স্কুলে কোন চার দেওয়ালের ক্লাস রুম নেই। স্কুলের মাঝ খানে একটি ঘর রয়েছে শুধু মাস্টার মশাই দের জন্য। তার চারপাশে দুই দেওয়ালের ছ’টি খোলা বারান্দা।বারান্দার মাথা থেকে বিভিন্ন লতানোর গাছের ডাল ঝুলছে। কোন টা কুন্দ, কোনটা কামিনী, মাধবী লতা। আরও কত কি । এমনই পরিবেশে ওরা পড়াশুনা করে। আর পড়াশোনার ফাঁকে নিজের গাছ টাকে লালন করে ওরা। এ যেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের আধুনিকরুপ।
স্কুল চত্বরে বকুল, পেয়ারা, আম, মসুন্ডা, ক্রিসমাস, কাঁঠাল, মত ফুল ফল, পাতাবাহারের গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছের মালিক এক-একজন পড়ুয়া। স্কুলে পৌঁছে অফিস ঘর থেকে নিজের গাছের নাম লেখা নেমপ্লেট নিয়ে দড়ি দিয়ে নিজের নিজের গাছে বেঁধে দেয় ওরা। তখনই নিজের গাছ টা ঘুরে ঘুরে দেখে নেয়। শুরু হয় পরিচর্যা। এর মাঝে ক্লাসের ঘন্টা পরলেও ছুটলাগায ওরা। আবার টিফিন হতে ওরা গাছ মুখী। যেমন চতুর্থ শ্রেণীর বিদ্যুৎ হালদার। তার দায়িত্বে রয়েছে একটি বকুল গাছ। গত তিন বছর ধরে সে ও তার বকুল গাছের টানে দিশেহারা।পরিচর্যা শেষে স্কুল ছুটির সময় আবার নেমপ্লেট খুলে অফিস রুমে রেখে বাড়ি যায় ওরা।
গাছের গোঁড়া পরিস্কার করা, মাটি খুঁড়ে দেওয়ার পাশাপাশি । কেউ কেউ বাড়ি থেকে গোবড সার ও নিয়ে আসে । এছাড়াও স্কুল চত্বরেই রয়েছে দুটি ভ্যাট। একটির নাম , ‘আমি পচি’ অপরটির নাম ‘আমি পচি না’। অর্থ্যাৎ গাছের আশপাশের ঘাস, শুকনো পাতা, মিডডে মিলে সব্জির খোসা জড়ো করে ‘আমি পচি’ এই ভ্যাটে ফেলে দেয় ওরা। মাটি চাপা দিয়ে তা থেকেই যে সার হয় সেই সার সবাই মিলে নিজের নিজের গাছের গোড়ায় দিয়ে গাছের যত্ন করে খুদেরা ।
এইভাবেই একটি ছাত্র লালন করে তার গাছটি কে। কখন যেন তারা একাত্ম হয়ে যায় গাছের সাথে। আর এই কাজে পড়ুয়াদের উৎসাহিত করতে স্কুলে গাছ পরিচর্যার মূল্যায়ন হয় প্রতি তিন মাস অন্তর। গাছ পরীক্ষা করে রিপোর্ট কার্ড দেন মাস্টার মশাই ।
তৃতীয় শ্রেণীর শৈবালিনি মার্ডি সে এবার গ্রেড এ পেয়েছে। সে একটি পেয়ারা গাছ দেখাশুনা করে। সে জানায় , ‘‘যতদিন এই স্কুলে পড়ব এই পেয়ারা গাছ টা আমার । এই গাছের খারাপ ভালো সব দায়িত্ব আমার। তবে যখন পেয়ারা ফলে তখন স্কুলের সবার। আমি যখন সবাই কে নিজে হাতে পেয়ারা বিলি করি তখন আমার খুব আনন্দ হয়। আমার গাছের ফল সবাই খাচ্ছে দেখে। শীতকালে এই গাছের তলায় চাটাই পেতে আমরা রোদ পোয়াতে পোয়াতে পড়াশুনা করি।”
প্রধান শিক্ষক ভগবান মিশ্র বলেন, একটি গাছের জন্য একজন পড়ুয়ার পরিচর্যার উদ্যোগ চলছে গত ১২ বছর ধরে। প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত একটি গাছের জন্য একটি পডুযা দায়িত্ব থাকে। সেই পাশ করে বেরিয়ে গেলে যে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হল তার উপর ওই গাছের দায়িত্ব বর্তায়। পডুযাদের উৎসাহ দিতে রিপোর্ট কার্ডের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।