সরকার সবচেয়ে বেশি লাভজনক তিস্তা প্রস্তাব গ্রহণ করবে ভারতে চিকিৎসা নিতে ভিসা সহজ করা হয়েছে
বাংলাদেশ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শেখ হাসিনা দেশকে বিক্রি করে না। আমি জাতির পিতার মেয়ে শেখ হাসিনা। এ জায়গায় কেউ আসতে পারবে না। আমি দেশ তো বেচি না, দেশের স্বার্থও বেচি না। দেশের স্বার্থ রক্ষা করে চলি। আমরা এই দেশ স্বাধীন করেছি, এটা মনে রাখা উচিত। একটা দেশের মধ্যে অন্য দেশের ট্রানজিট দিলে কোনো ক্ষতি নেই। তিনি বলেন, আমার একটা প্রশ্ন আছে, ওজনটা কিসে মাপছে?
ওজন মাপা হচ্ছে কীভাবে? আগে তো পাল্লায় হতো, এখন মেশিনে মাপা হয়। এখন তাহলে কীভাবে বিক্রি হবে? বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। মুক্তিযুদ্ধ করে এ দেশ আমরা স্বাধীন করেছি। যারা সমালোচনা করে, তাদের জানা উচিত, একটিমাত্র মিত্রশক্তি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ স্বাধীনে সহযোগিতা করেছে। পৃথিবীতে যারা মিত্রশক্তি, যারা যুদ্ধে সহযোগিতা করে, তারা কিন্তু ওই দেশ ছেড়ে যায়নি। এখনো জাপানে আমেরিকান সৈন্য, জার্মানিতে রাশিয়ান সৈন্য আছে।
কিন্তু এখানে ভারত ব্যতিক্রম। তারা মিত্রশক্তি হিসেবে আমাদের পাশে থেকে যুদ্ধ করে এসেছে। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখনই চেয়েছেন, তারা সৈন্য দেশে ফেরত যাক, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছেন। তিনি তাদের ফেরত নিয়ে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপরও যারা কথা বলে, ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে, তারা এ কথা বলে কীভাবে? আসলে যারা এ কথা বলে, তারা নিজেরাই ভারতের কাছে বিক্রি হওয়া। কারণ আমরা দেখেছি, যখনই মিলিটারি ডিক্টেটররা (সামরিক স্বৈরাচার) এসেছে, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া ওপর দিয়ে ভারতবিরোধী কথা বলেছে, আর ভারতের পা ধরে বসে থেকেছে। এগুলো আমার নিজের দেখা, জানা।
মঙ্গলবার গণভবনে সম্প্রতি ভারত সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, রেল যেগুলো বন্ধ ছিল ভারতের সঙ্গে, সেগুলো আস্তে আস্তে খুলে দিচ্ছি। অর্থনীতিতে এটা বিরাট অবদান রেখে যাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশে কি চারদিকে দরজা বন্ধ করে থাকব? ইউরোপের দিকে তাকান, সেখানে কোনো বর্ডার নেই। সেখানে কি এক দেশ আরেক দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছে? আমাদের স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ। সমস্ত যোগাযোগব্যবস্থা খুলে দিলাম, এর উপকার পাবে সাধারণ মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হবে।
ওষুধ শিল্পে ভারতের সঙ্গে নবায়ন করা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের মানুষ কী সুবিধা পাবে এবং কম খরচে চিকিৎসাসেবা মিলবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশি রোগী ও তাদের স্বজনদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ ভারতে চিকিৎসা নিতে যায়, তাদের জন্য আমরা ভিসা সহজ করে দিয়েছি।
এখন সহজেই সেখানে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে আসা যাবে। ওষুধ শিল্পের অনেক কাঁচামাল আমাদের ভারত থেকে আনতে হয়। কিছু কিছু ওষুধ আছে আমরা এখনো উৎপাদন করি না, করতে পারছি না। যদিও আমাদের ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টর অনেক উন্নত, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই আমরা ওষুধ রপ্তানি করি। এরপরও কিছু কিছু ওষুধ থাকে যেগুলো আমাদের উৎপাদন হয় না, সেগুলো আমাদের আমদানি করতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিস্তা চুক্তি ও গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যে চিঠি দিয়েছেন, তা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি যদি নবায়ন নাও হয়, তবু এ চুক্তি অব্যাহত থাকবে। তিস্তা নিয়ে আমরা প্রকল্প নিয়েছি। তিস্তা নদীটাকে ড্রেজিং করা, পানি সংরক্ষণ এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি যদি নবায়ন না-ও হয়, তবু এ চুক্তি অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন এবং আমরাও সম্মত হয়েছি যে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একটা টেকনিক্যাল গ্রুপ করা হবে। মমতা ব্যানার্জি যে চিঠি লিখেছেন তার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমার সঙ্গে ভারতের সব দলের সম্পর্ক ভালো। মমতা ব্যানার্জির সম্পর্ক ভালো আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্কও ভালো। ভারতের দলমত-নির্বিশেষে আমার সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে।
তিনি বলেন, সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশ ও জনগণের জন্য যে প্রস্তাব সবচেয়ে বেশি লাভজনক তা গ্রহণ করবে। আমরা তিস্তা প্রকল্প নিয়েছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীন ও ভারত আলাদা আলাদা প্রস্তাব দিয়েছে। আমাদের দেশের জনগণের জন্য কোন প্রস্তাবটি অধিক লাভজনক ও উপযোগী হবে সেটাই আমরা গ্রহণ করবো। তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে চীন আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতও দিয়েছে। আরও প্রস্তাব এসেছে। অবশ্যই আমরা বিবেচনা করবো, কোন প্রস্তাবটি গ্রহণ করলে তা আমার দেশের মানুষের কল্যাণে আসবে সেটাই গ্রহণ করবো।
কোন প্রস্তাবটা নিলে কতটুকু ঋণ নিলাম এবং কতটুকু আমাদের পরিশোধ করতে হবে, কতটুকু দিতে পারবো-এসব কিছু বিবেচনা করেইতো আমাদের করতে পরিকল্পনা নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভারত যেহেতু বলেছে তারা করতে চায় এবং টেকনিক্যাল গ্রুপ বানাবে, তারা অবশ্যই আসবে। আমরা যৌথভাবে সেটা দেখবো। চীন একটা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ভারতও একটা করবে এবং এটার পর আমাদের কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রহণযোগ্য ও লাভজনক মনে হবে আমরা সেটাই করবো।
শেখ হাসিনা বলেন, যেহেতু ভারতের কাছে আমাদের তিস্তার পানির দাবিটা অনেক দিনের সেক্ষেত্রে ভারত যদি আমাদের তিস্তা প্রকল্পটি করে দেয় তবে আমাদের সব সমস্যারই সামাধান হয়ে যায়। তাহলে সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ হলো-আপনারা নিজেরাই বিবেচনা করে দেখেন। কাজেই ভারত যখন এগিয়ে এসেছে আমরা এটাই মনে করি যে ভারতের সাথে যদি আমরা এই তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করি তাহলে আমার দেশের পানি নিয়ে প্রতিদিন সমস্যায় পড়তে হবে না। আমরা সেই সুবিধাটা পাব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের জাতির পিতার দিয়ে যাওয়া পররাষ্ট্র নীতি সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’। আমিতো এখানে কোন সমস্যা দেখি না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন আমাকে তার শপথ অনুষ্ঠানে যাবার দাওয়াত দিলেন, আমরা গেলাম। তারপর তিনি রাষ্ট্রীয় সফরের দাওয়াত দিলেন, সে সফরও করে আসলাম। চীন আমাকে দাওয়াত দিয়েছে আমি চীনে যাব। আমার বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ এবং সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়েই আমি চলবো। কার কি সমস্যা সেটা তাদের সঙ্গে থাক আমার নয়, আমার দেশের মানুষের কতটুকু উন্নতি করতে পারি সেটাই আমার লক্ষ্য। ভারত বাংলাদেশের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, সরকার ইউনূসের বিরুদ্ধে সব যন্ত্রই ব্যবহার করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি কাউকে ঈর্ষা করি না। নোবেল পুরস্কারের আকাঙ্খা আমার নেই। নোবেলের জন্য আমার কোনো আকাঙ্খাও নেই। আর লবিস্ট রাখার মতো টাকাও নেই। আমি কখনো ওটা চাইনি। পার্বত্য চুক্তি যখন করি, তখন দেশে বিদেশে অনেকে আমার জন্য লিখেছে। আমি তো কখনো তদবির করতে যাইনি। কী পেলাম, না পেলাম, ওগুলো আমার মাথার মধ্যেও নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আমি করেছি। পৃথিবীর যত শান্তি চুক্তি হয়েছে, খুঁজে বের করেন, কয়টা অস্ত্রধারী আত্মসমর্পণ করেছে। ১ হাজার ৮০০ জন আমার কাছে অস্ত্র জমা দিয়েছে। তাদের সবাইকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে পুনর্বাসন করেছি। ভারতে যারা ছিল, তাদের ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন হয়েছে। আমার কাছে অনেকে এসেছে। আমি বলেছি, আমার ওসব পুরস্কারের দরকার নেই। এখানে আন্তর্জাতিকভাবে যারা পায়, তাদের কতটুকু অবদান সেটা না, এখানে আলাদা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। ওর মধ্যে আমার কোনো আকাঙ্খা নেই। কিন্তু বলে দিল ওটা নিয়ে আমি নাকি জেলাস।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল করতে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দল করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন কেন? গ্রামের মানুষকে এত কিছু দিয়ে থাকলে সেই মানুষগুলো ঝাঁপিয়ে এল না কেন? কারণ, সুদের চাপে মানষ মৃতপ্রায় ছিল। তার ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। সে দায় কি আমার? তিনি তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এ ডাবল প্লাস দিয়ে আসছে। আমার বিরুদ্ধে একের পর মামলা হয়েছে। আমার সঙ্গে তার তুলনা করা যায় না।
ড. ইউনূস বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন, সে টাকা কোথা থেকে এসেছে? উনি এর জবাব দিক। সরকারি চাকরি করা অবস্থায় তিনি বাইরে ব্যবসা করেছেন। আইন কী বলে? এখন সব দোষ আমার। আজকে সবচেয়ে বেশি আমি যাকে দিলাম। উনাকে ঈর্ষা করার কী আছে। সে মাঠে আসুক। চলুক আমার সঙ্গে। ডিবেট হয় না? আসুক, কথা বলব। উনার পয়সা আছে উনি লেখাচ্ছেন। বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাপতে হয়। তার জন্য কেউ তো আমাকে কখনো কিছু বলল না।
এতে আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফরউল্লাহ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান প্রমুখ। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন।