বাংলাদেশ | কক্সবাজার উপকূলে ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডব

3 - মিনিট |

উপকূলবর্তী কক্সবাজার জেলার আট উপজেলায় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে

সমীরণ রায়

বাংলাদেশ : অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা উপকূলে আঘাত হানার পর কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে তাণ্ডব চালিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বৃষ্টি ঝরিয়ে শক্তি হারিয়ে পরিণত হয় স্থল গভীর নিম্নচাপে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে ঝড়ের বিপদ কেটে যাওয়ায় কক্সবাজার বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৩ নম্বর এবং মোংলা বন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে কক্সবাজার উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। সেন্টমার্টিনে গাছচাপায় নারীসহ দুই জন আহত হয়েছে। উপকূলবর্তী কক্সবাজার জেলার আট উপজেলায় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ঝড়ের প্রভাবের শিকার হয়েছে প্রায় তিন লাখ ৩৪ হাজার মানুষ। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান গণমাধ্যমকে জানান, কক্সবাজারে ১০ হাজারের বেশি কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত এবং ২ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রচুর গাছপালা ভেঙ্গে পড়েছে। কাঁচা ঘরবাড়ি সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান খান রোববার রাত সাড়ে ৮ টায় সাংবাদিকদের জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখা উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে রোববার সন্ধ্যা ৬ টায় কক্সবাজার উপকূল সম্পন্ন করে এবং দুর্বল হয়ে মায়ানমারের সিটুয়েতে স্থল গভীর নিন্মচাপে পরিনত হয়। রোববার সন্ধ্যার মধ্যে এ ঝড় সাগর থেকে পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

এর আগে রোববার বিকেল ৩টায় আবহাওয়ার ২১তম বিশেষ বুনেটিনে সন্ধ্যা নাগাদ ঘূর্ণিঝড় মোখা দুর্বল হতে পারে বলে জানানো হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, বিকেল ৩টায় ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র মিয়ানমারের সিটুয়ের কাছ দিয়ে কক্সবাজার-উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করে মিয়ানমারের স্থলভাগের ওপর অবস্থান করছে। সম্পূর্ণ ঘূর্ণিঝড়টি সন্ধ্যা নাগাদ উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন ও ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে পারে। তবে দুর্বল হলেও ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফে প্রচণ্ড গতিবেগে বাতাস বইছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক আসাদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, কক্সবাজার জেলা, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের ওপর ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে। টেকনাফে বেলা সাড়ে ১১টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে গেছে। সেন্টমার্টিনে দুপুর ১টায় ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে, ২টায় ১২১ কিলোমিটার, ২টা ২০ মিনিটে ১১৫ কিলোমিটার, আড়াইটায় ১৪৭ কিলোমিটার গতিতে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়টির বড় অংশ মিয়ানমারের ওপর দিয়ে অতিক্রম করেছে।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোখায় কারও মৃত্যুর তথ্য জানা না গেলেও সেন্টমার্টিন, টেকনাফ ও কক্সবাজারে ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে খবর পাওয়া গেছে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ভারী বর্ষণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ পার্বত্য জেলাগুলোতে পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোববার সকাল থেকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়তে শুরু করে কক্সবাজার জেলা শহর, টেকনাফ উপজেলা ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এবং অন্যান্য উপজেলায়। দুপুরের দিকে বৃষ্টি ও বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। বিকাল ৪টার পর উপকূল সংলগ্ন এলাকায় তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ‘সহনীয়’ ছিল জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা: মোঃ এনামুর রহমান বলেছেন, আমরা পাঁচ বছরে যত দুর্যোগ মোকাবেলা করেছি, তার মধ্যে এবারের ব্যবস্থাপনাটি ছিল সর্বোচ্চ সঠিক। রোববার সচিবালয়ে তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সেন্ট মার্টিনে ৩৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে ৮ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ ছাড়া কক্সবাজারে ৫৭৬টি কেন্দ্রে ২ লাখের বেশি, চট্টগ্রামে ১ হাজার ২৪ আশ্রয়কেন্দ্রে ৫ লাখ মানুষ আশ্রয় নেন। কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সন্দ্বীপ, সুবর্ণচরের মানুষকেও নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়।

কিছু আশ্রয়কেন্দ্রে সুপেয় পানি না থাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কক্সবাজারের একটি কেন্দ্রে সুপেয় পানি ছিল না। আমি অভিযোগ পেয়ে সেখানকার জেলা প্রশাসককে বলেছি। সেখানে তিনি পর্যাপ্ত মিনারেল ওয়াটারের ব্যবস্থা করেছেন”। তিনি বলেন, এবার আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা তাদের মিনারেল ওয়াটার খাওয়াব, সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যায় যা করেছিলাম, যেন দুর্যোগের পর সেখানে পানিবাহিত কোনো রোগ না হয়।

দুর্যোগকালীন লাখ লাখ মানুষের ব্যবস্থাপনা সহজ নয় জানিয়ে এনামুর রহমান বলেন, হাজার হাজার আশ্রয়কেন্দ্র, লাখ, লাখ মানুষ। এদের ব্যবস্থাপনা বাস্তবিক অর্থে এত সহজ না। আমরা দেখেছি এর আগেও সক্ষমতা ১০০ জনের হলেও ২০০ মানুষ আসে। তাদের খাওয়া-দাওয়া, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা খুব সহজ নয়। তবে এবারের ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ ও কক্সবাজারের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাজের প্রশংসা করেন প্রতিমন্ত্রী।

প্রথমদিকে ‘সুপার সাইক্লোনের’ কথা বলে পরে পরিবর্তন প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তখন পূর্বাভাস দেখে আমরা সুপার সাইক্লোনের কথা বলেছিলাম। পরে বাতাসের গতিবেগ দেখে তা আমরা প্রত্যাহার করে বলেছি, সুপার সাইক্লোন হবে না, কারণ এর গতিবেগ ১৫০ থেকে ১৬০। সুপার সাইক্লোন হলে তখন বাতাসের গতিবেগ থাকে ২২০ কিলোমিটারের মধ্যে, সেটা হয়নি।

আবহাওয়ার পূর্বাভাসের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বলেছিলাম শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে এটা উপকূলে আঘাত হানতে পারে। তখন এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২ কিলোমিটার। শনিবার এটি গতি কমিয়ে হয়েছে ৭ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। যে কারণে এটি আঘাত হানতে দেরি হয়েছে। যখন যা পূর্বাভাস পেয়েছি তার ভিত্তিতে আমরা বক্তব্য দিয়েছি। ঘূর্ণিঝড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এটা হতে পারে। যেকোন সময় এর গতিপ্রকৃতি বদলাতে পারে, এর ভিত্তিতে আমাদের বক্তব্য দিতে হয়।ৃপ্রত্যেক কথার পেছনে যুক্তি আছে, এখানে কোনো বিভ্রান্তি নেই।

প্রসঙ্গত, গত ৮ মে সকালে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। ওইদিন মধ্যরাতে এটি ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়। ৯ মে সন্ধ্যার পর সুস্পষ্ট লঘুচাপটি আরও শক্তিশালী হয়ে নিম্নচাপ এবং গত বুধবার সকালে তা গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার সকালে সেটি আরও শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় রূপ নেয়। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় দেশের উপকূলীয় জেলা-উপজেলাগুলোতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় স্থানীয় প্রশাসন। এসব এলাকার নারী-শিশুসহ বহু মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয় স্থানীয় সাইক্লোন সেল্টার সেন্টারে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *