পুলিশি সমন পেয়েও গত দুই মাস থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। শেষ রক্ষার পথ না পেয়ে রবিবার রাতে করিমগঞ্জ সদর থানায় সশরীরে হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন
বর্তমান কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স”-এর প্রভাব পড়েছে প্রান্তিক জেলা করিমগঞ্জেও। করিমগঞ্জের সুতারকান্দি স্থলবন্দর জমি কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত একের পর এক এসিএস আধিকারিকের গ্রেফতারির ঘটনায় জেলা ছাপিয়ে গোটা বরাকের মানুষ রাজ্য ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সুশাসনের প্রমাণ পেয়ে খুশি সাধারণ জনগণ।
সুতারকান্দি স্থলবন্দর জমি কেলেঙ্কারির মূল অভিযুক্ত প্রাক্তন অতিরিক্ত জেলাশাসক তথা সদ্য নিলম্বিত কাছাড়ের ডিস্ট্রিক্ট ডেভেলপমেন্ট কমিশনার (ডিডিসি) নবারুণ ভট্টাচার্য রবিবার রাতে করিমগঞ্জ সদর থানায় সশরীরে হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করে। আজ সকালে নবারুণকে মুখ্য বিচারবিভাগীয় আদালতে পেশ করে পাঁচদিনের জন্য হেফাজতের আবেদন জানিয়েছিল করিমগঞ্জ পুলিশ। কিন্তু মুখ্যত বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত নবারুণ ভট্টাচার্যকে দু-দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ভারত-বাংলা সীমান্তবর্তী করিমগঞ্জ জেলার সুতারকান্দির জারাপাতায় স্থলবন্দর নির্মানের জন্য ল্যান্ডপোর্ট অথরিটি ৩০০ বিঘা জমি অধিগ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিল। অথরিটির নির্দেশ অনুযায়ী জেলা প্রশাসন ২০১৬ সালে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করে। জারাপাতা এলাকার নিচু ও জলমগ্ন জমি চিহ্নিত করে চড়া মূল্য নির্ধারণ করে রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৎকালীন অতিরিক্ত জেলাশাসক নবারুণ ভট্টাচার্য-সহ একটি বলিষ্ঠ দালালচক্র পরিকল্পিতভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার নাটেরগুরু ছিল জেলার বহু বিতর্কিত কয়লা ও ভূ-মাফিয়া আব্দুল আহাদ চৌধুরী।
পুলিশি সমন পেয়েও গত দু’মাস থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। শেষ রক্ষা হবে না ভেবে সম্ভবত গতকাল রাতে গুয়াহাটি থেকে সোজা করিমগঞ্জ সদর থানায় এসে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। তবে সুতারকান্দি স্থলবন্দরের জন্যি ক্রয় করা প্রায় ৫১ বিঘা জমির ৬ কোটি টাকার কেলেঙ্কারির নাটেরগুরু কয়লা মাফিয়া বলে পরিচিত আব্দুল আহাদ চৌধুরী এখনও পলাতক। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ড. দেবজিৎ নাথের দাবি, তাঁদের পাতা ফাঁদে খুব শীঘ্রই সে ধরা পড়বে।
জমি কেলেঙ্কারির ছয় কোটি টাকার মধ্যে সিংহভাগ টাকা যে বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এখনও কেন তদন্তের আওতায় নেই? সেই সঙ্গে যে এডিসি-র তত্বাবধানে বিশাল অঙ্কের সরকারি চেকগুলি ভুয়ো অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে, সেই এডিসিকেও কেন তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে না? এই প্রশ্ন গুলিই এখন সমগ্র জেলার জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সদর সার্কল অফিস ও জেলাশাসক কার্যালয়কে ম্যানেজ করে প্রায় ৫১ বিঘা অন্যের জমি নিজের নামে দেখিয়ে আব্দুল আহাদ কেলেঙ্কারির আশ্রয় নেয়। এব্যাপারে আহাদকে সব ধরনের সহযোগিতা করেন তদানীন্তন জেলাশাসক প্রদীপ কুমার তালুকদার, প্রাক্তন এডিসি নবারুণ ভট্টাচার্য, প্রাক্তন সদর সার্কল অফিসার হোমেন গোঁহাই বরুয়া, সার্কল অফিসের কানুনগো মিহির রঞ্জন মালাকার ও আমিন প্রণীত নাথ।
পুলিশ সূত্রের খবর, রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাক্তন অতিরিক্ত জেলাশাসক নবারুণ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সুতারকান্দি জারাপাতা এলাকার ৪৫ জন জমি মালিকের কাগজপত্র জালিয়াতি করে প্রতারক আব্দুল আহাদ প্রায় ছয় কোটি টাকার কেলেঙ্কারি সংঘটিত করে। করিমগঞ্জের একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বিয়ারার চেকে এই বিশাল পরিমাণের অর্থ নির্দিষ্ট কিছু ব্যাঙ্ক খাতায় জমা হয়। অথচ যাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, এব্যাপারে তাঁদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয়। পরবর্তীতে অধিগৃহীত জমির জারাপাতা এলাকার ৪৫ জন ভু-মালিক পুলিশের দ্বারস্থ হন। তাঁরা পৃথক পৃথক ভাবে করিমগঞ্জ থানায় ২১টি অভিযোগনামা দাখিল করেন। এগুলির ভিত্তিতে করিমগঞ্জ পুলিশ জামিন অযোগ্য ধারায় প্রত্যেকটি মামলা নথিভুক্ত করে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করে।
তদন্তে নেমে পুলিশ প্রথমেই সদর সার্কল অফিসের কানুনগো মিহির রঞ্জন মালাকার ও আমিন প্রণীত নাথকে গ্রেফতার করে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে এই বৃহৎ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত একের পর এক জেলার শীর্ষ আধিকারিকের নাম প্রকাশ্যে আসতে থাকে। এঁরা তদানীন্তন জেলাশাসক প্রদীপ কুমার তালুকদার, তদানীন্তন অতিরিক্ত জেলাশাসক নবারুণ ভট্টাচার্য ও প্রাক্তন সদর সার্কল অফিসার হোমেন গোঁহাই বরুয়া। তদন্তক্রমে পুলিশ দেঁড়গাওয়ে সার্কল অফিসার হিসাবে কর্মরত অভিযুক্ত হোমেন গোঁহাই বরয়াকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। হোমেন গোঁহাইকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, ছয় কোটি টাকার এই বৃহৎ জমি কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রদীপ কুমার তালুকদার ও নবারুণ ভট্টাচার্যের নাম। পরবর্তীতে ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪১ নম্বর ধারায় প্রদীপ কুমার তালুকদার ও নবারুণ ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে করিমগঞ্জ পুলিশ সমন জারি করে। সমন পেয়েও অভিযুক্ত উভয় আধিকারিক হাজির না হয়ে উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন করে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। তবুও শেষরক্ষা হয়নি। গোপন খবরের ভিত্তিতে করিমগঞ্জ পুলিশ গত ১৮ আগস্ট প্রদীপ তালুকদারকে গুয়াহাটির বশিষ্ঠ এলাকায় তাঁর নিজের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে করিমগঞ্জ নিয়ে আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেবজিৎ নাথ। বর্তমানে প্রদীপ তালুকদার জেল হাজতে বিচারাধীন বন্দি। প্রদীপ তালুকদারের গ্রেফতারের ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে অন্য অভিযুক্ত পলাতক নবারুণ ভট্টাচার্যও শেষপর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন।