আরসালান ব্রাদার্স কাণ্ডের রহস্যভেদে ইনফোটেনমেন্ট টেলিম্যাটিক্সকেই পাখির চোখ করলেন কলকাতা পুলিশ
গল্পের শিরোনামে শেকস্পিয়ার সরণি, তাও আবার অপরাধমূলক। শুনলেই যে কোন পাঠকেরই মন ডুবে যাবে স্যার আর্থার কোনানডয়েল সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লকের অসাধারণ বাকপটুতা, ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণের ধারাবিবরণীতে । ছোট ক্লু হাতে পেলেই হল হোমসের অনুসন্ধিৎসু চোখ খুঁজে বের করবেই তার অর্থ। শুধু তাই নয় একের পর এক ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণে সোজা হানা দিতেন অপরাধের অন্দরমহলে। অবশ্য সে সবই গল্প-কথায়।
তবে আজকের কাহিনীর শেকস্পিয়ার সরণির অবস্থান লন্ডন নয় কলকাতা। তাদন্তকারীর ভূমিকায় শার্লক নয়, রয়েছেন কলকাতার পুলিশ। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের খেতাব জয়ী কলকাতা পুলিশের অসাধারণ বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা সাহিত্য থেকে বাস্তব সর্বত্রই তাক লাগিয়েছে এমনকি গৌরবান্বিত করেছে বাঙালি সমাজকেও।
মগজাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিলোত্তমার পুলিশবাহিনীর জুড়ি মেলা বরাবরই ভার। তাঁদের কৃতিত্ব শুধু কল্পনা প্রসূতই নয় তা আরও একবার প্রমান করে দিল শেকস্পিয়ার সরণির জাগুয়ার কাণ্ডের সফলতা। হোমসের মতোই টুকরো টুকোর প্রমাণকে একত্রীভূত করে তারা ধরে ফেলল আসল অপরাধীকে। বুঝিয়ে দিল বাংলা গল্পকথার ব্যোমকেশ, কীরিটি, ফেলুদা বা তপনকুমারের দীপকরা যে ভাবে রহস্য সমাধান করে থাকেন, কলকাতা পুলিশেরও সেই ক্ষমতা রয়েছে।
বাস্তবজীবনে অপরাধীর সন্ধান পাওয়ার পথটা বেশ কণ্টকাকীর্ণ। তবে বাস্তব হোক বা গল্প কথায় অপরাধ কখনই চাপা থাকে না। অপরাধ লুকোনো অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো ঘটনা। অপরাধের দুনিয়ায় ‘পারফেক্টনেস’-র কোনও অস্তিত্ব নেই। তা আরও একবার প্রমাণ করল কলকাতা পুলিশের কর্মদক্ষতা।
দুর্ঘটনা গ্রস্ত গাড়ির এয়ারব্যাগ ফেটে যাওয়ার পরও এই বাগে থাকা সিলিকন বাইটের চিহ্ন পাওয়া যায়নি ধৃত আরসালানের শরীরে। এই ঘটনা থেকেই কলকাতা পুলিশের মনে জমতে থাকে রহস্যের দানা । রহস্যের খোঁজেই মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ বাহিনী। এরপরই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন ঘটনাস্থল থেকে শুরু করে আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করার। সঙ্গে সঙ্গে খতিয়ে দেখা হয় জাগুয়ার ইন্টারন্যাল ডেটা রেকর্ডারের তথ্যও। পরীক্ষা করা হয় আরসালান পরিবারের বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজেরও। এরপরই অভেদ্য রহস্য স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় কলকাতা পুলিশের সামনে।
এদিকে জাগুয়ার গাড়িতে রয়েছে কয়েকটি উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার। চুরি আটকাতেই গাড়িতে রয়েছে ইনফোটেনমেন্ট টেলিম্যাটিক্স। চালকের ফোন নম্বর এই স্পেশাল সিস্টেমে নথিভুক্ত হয়ে যায়। বাইরের অন্য কেউ গাড়ি ড্রাইভ করতে পারে না। তাই অতিসহজেই টেলিম্যাটিক্সের তথ্য বিশ্লষণ করলেই জানা যাবে ড্রাইভারের আসনে বসে থাকা ব্যক্তিটির ফোন নম্বর। এই ঘটনাতেও খলনায়কের ভূমিকায় ইনফোটেনমেন্ট টেলিম্যাটিক্স।
টেলিম্যাটিক্সের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী প্রাপ্ত ফোন নম্বরের হোয়াটস অ্যাপ অ্যাকাউন্টেও রয়েছে আরসালান নয় দাদা রাঘিব পারভিজেরই ছবি। শুধু তাই নয় বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজের তথ্য বিশ্লেষণ থেকেই উঠে এসেছে একই তথ্য। বাড়ি থেকে বেরনোর সময়েও গাড়ি ড্রাইভ করছিল দাদা নিজেই।
তবে এখন একটাই প্রশ্ন, দুর্ঘটনার ১২ ঘণ্টা পরও কেন ছোট ভাই আরসালানকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় পরিবার? শুধু তাই নয় উঠে এসেছে আরও কয়েকটি তথ্য। দুর্ঘটনা ঘটার আগের মুহুর্ত্বেও মধ্য কলকাতার মতো জনবহুল এলাকাতেও গাড়ির গতিবেগ ছিল ১০০ র বেশি। এমনকি গতি বাড়ানোর জন্য বিশেষ গ্যাস ও ভরা হয়েছিল গাড়িতে। তবে গতিবেগের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের জন্য ইতিমধ্যেই কলকাতা পুলিশের তদন্তকারীর দল ব্রিটেনে আবেদন জানিয়েছে। খুব তাড়াতাড়িই তথ্য এসে পৌঁছবে পুলিশের হাতে।
ঘটনাটি শেকস্পিয়ার সরণি থানার সামনে হওয়ায় পুলিশের নজর এড়াতে পায়ে হেঁটেই গা ঢাকা দেয় রাঘিব। পুলিশ সূত্রের খবর অনুযায়ী এরপর বাড়িতে ফেরেনি সে। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে তাকে রাখা হয়েছিল এক গোপন ডেরায়। এরপরই রাতারাতি শনিবার দুপুরেই রাঘিবের উড়ান পাড়া দেয় দুবাই।সেখানে আরসালানের ব্যবসার রমরমা থাকায় ভিসা সংক্রান্ত সমস্যাতেও পড়তে হয়নি তাকে। আসল দোষী যে রাঘিব তা জানা যেতেই কলকাতার পুলিশের দল পরিবারকে চাপ দিয়ে বড়ো ছেলেকে ফেরানোর ব্যবস্থা করে। মঙ্গলবার কলকাতায় পৌঁছেও গা ঢাকা দেওয়ার তালেই ছিল রাঘিব। অবশেষে বুধবার দুপুরেই সার্কস এভিনিউয়ের এক নার্সিং হোম থেকে কলকাতা পুলিশের জালে আটকে পড়ে আসল অভিযুক্ত।