ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষে মিলেমিশে একাকার গোটা বাংলা

2 - মিনিট |

প্রথম দিন মাঠে এসে ময়মনিসংহ থেকে এপার বাংলায় এসে ঘাঁটি গড়া পরিবারটির কনিষ্ঠ সদস্যটি ইস্টবেঙ্গলের জয়ে কিছু না বুঝেই বাকিদের দেখে সেই যে মাতোয়াড়া হয়ে উঠেছিলেন তা এখনও চলছে যুগ যুগ ধরে

সৌম্য বাগচী

বৃহস্পতিবার বাংলার রং ছিল লাল-হলুদ। প্রতীক ছিল জ্বলন্ত মশাল। সব ধর্ম মিলেমিশে একটাই ধর্ম ছিল- ইস্টবেঙ্গল। বাজারে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল ইলিশের দাম।

নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে লক্ষ্মীবারের সন্ধেয় যেন বসেছিল চাঁদের হাট। কলকাতায় শেষ কবে ক্রীড়াজগতের এতজন মহাতারকাদের একই মঞ্চে দেখা গিয়েছিল, হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিলনে না বেলঘড়িয়ার সত্তোরর্ধ্ব কাঠবাঙাল সন্তোষবাবু। বয়স হয়েছে বলে এখন আর রাজ্যের বাইরে যেতে পারেন না প্রিয় দলের খেলা থাকলে। তবে ময়দানে ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ মানেই ‘লজেন্স মাসির’ মতো দর্শকাসনে অবধারিত ভাবে উপস্থিত তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বাবার হাত ধরে বেলঘড়িয়া থেকে সেই যে প্রথমবারের মতো ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে এসেছিলেন উদ্বাস্তু পরিবারের এই সন্তান আজও তাতে ছেদ পড়েনি। প্রথম দিন মাঠে এসে ময়মনিসংহ থেকে এপার বাংলায় এসে ঘাঁটি গড়া পরিবারটির কনিষ্ঠ সদস্যটি ইস্টবেঙ্গলের জয়ে কিছু না বুঝেই বাকিদের দেখে সেই যে মাতোয়াড়া হয়ে উঠেছিলেন তা এখনও চলছে যুগ যুগ ধরে। ‘ইস্টবেঙ্গল’ শব্দটি শুনলেই আবেগতাড়িত হয়ে শৈশবে ফিরে যান সন্তোষবাবু। এবার প্রিয় ক্লাব শতবর্ষে পা দিয়েছে, সেই উপলক্ষে অনুষ্ঠান! আর তিনি বসে থাকবেন বাড়িতে! তাই জ্বর উপেক্ষা করেই সাতসকালেই হাজির হয়ে গিয়েছিলেন ক্লাবের জন্মভিটে সুরেশ চৌধুরির বাড়িতে। সঙ্গে জুটিয়ে এনেছেন ক্লাস এইটে পড়া নাতি চিন্টুকে। সকালে সুরেশ চৌধুরির পরিবারকে ফলক প্রদান থেকে শুরু করে কেক কাটার পর লেসলি ক্লডিয়াস সরণিতে ঘোরাফেরা ও নাতিকে ময়দান চেনানো, এরপর নেতাজি ইন্ডোরে মূল অনুষ্ঠান দেখে শিয়ালদা স্টেশন হয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় বারোটা।

অবশ্য নানা বয়সের এরকম অনেক সন্তোষবাবুই বৃহস্পিতবার গোটা দিন জুড়ে যুক্ত ছিলেন লাল-হলুদ ব্রিগেডের শতবর্ষের অনুষ্ঠানে। টালা থেকে টালিগঞ্জ, বেহালা থেকে বেলঘড়িয়া, সিউড়ি থেকে শিলিগুডড়ি কোথা থেকে সমর্থকরা ভিড় জমাননি এদিন! প্রিয ক্লাবের অনুষ্ঠানের সঙ্গে বাড়তি পাওনা ছিল তারকা সঙ্গ।

ধূসর রঙা সাফারি, ফেঞ্চ কাট দাড়িতে ময়দানের ‘বড়ে মিঞা’ মহম্মদ হাবিবের শরীরে পারকিনসন রোগ থাবা বসিয়েছে। টলমল পায়ে হাঁটা হাবিবকে দেখে এগিয়ে এলেন একদা সতীর্থ সুভাষ ভৌমিক। হাত ধরে তুলে দিলেন। পাশে বসা ভাস্কর গাঙ্গুলি দু’হাত তুলে প্রণাম করলেন হাবিবকে। অশক্ত শরীর নিয়েই হাজির ভারতীয ফুটবলের পিকে- প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব, বাংলা সিনেমার আইকন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শেষ লগ্নে বাংলার মহারাজ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, এছাড়া ইস্টবেঙ্গলের বর্তমান ও প্রাক্তন ফুটবলাররা তো ছিলেনই।

সত্যজিৎ রায়ের অপু বললেন তাঁর ফুটবলের প্রতি প্রেমের শুরু পিকের খেলা দেখেই। আর সেই সূত্রে যে বন্ধুত্বের শুরু তা থেকে যাবে আজীবন। ঠিক মতো এখন আর কথা বলেত পারেন না ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা উইঙ্গার ও এদিন শতবর্ষের সেরা কোচের সম্মান পাওয়া পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই পাঠ করা হল তাঁর লিখিত ভাষণ। শতবর্ষের সেরা আবিষ্কারের পুরস্কার নিতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন বাইচুং ভুটিয়া। ভারতীয় ফুটবল দলের বর্তমান অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী জানালেন তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোয রীতিমতো গর্ব অনুভব করছেন। জীবনকৃতি সম্মান পাওয়া দুই ঘরের ছেলে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ও ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় তো একে অপরকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। পাঠ করা হল ভারতে খেলে যাওয়া সর্বকালের অন্যতম সেরা বিদেশি মজিদ বাসকারের পাঠানো চিঠি। এদিন থাকতে না পারার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে মজিদ জানিয়েছন, ১৪ তারিখের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি ১১ অথবা ১৩ আগস্ট কলকাতায় পা রাখছেন।

অনুষ্ঠানের সেরা আকর্ষণ কপিল দেব নিখাঞ্জ বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্মৃতিচারণ করে জানালেন, নব্বই-এর দশকের শুরুতে তাঁর ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার কথা। ঐদিন তাঁর চোট লাগবে এই ভয়ে সতীর্থরা তো পাস দেনই-নি বিপক্ষের ফুটবলাররাও তাঁর ধারে কাছে ঘেষতে চায়নি। তারকাদের এরকম টুকটাক নানা কথায় তখন নেতাজি ইন্ডোর তখন সরগড়ম।

মঞ্চে যখন এই সব চলছে প্রাক্তন ফুটবলাররা বহুদিন পর একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করে চলেছেন, হাঁটছেন স্মৃতির সরণিতে। আর সমর্থককূল তখন নিজেদের হারিয়ে ফেলেছেন স্পর্ধিত লাল-হলুদ রঙে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related news